একটা পুরনো বছর গিয়ে আর একটা নতুন বছর আসে আর সেই সঙ্গে বাড়ি হোক বা অফিস, দেওয়ালে জায়গা করে নেয় নতুন ক্যালেন্ডার। আমরা ইংরেজি সাল বা খ্রিস্টাব্দ বলতে যা জানি তা আসলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। ১ জানুয়ারিতে আমরা যে নতুন বছর উদযাপন করি তা-ও ওই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে। আবার বিখ্যাত সম্রাট জুলিয়াস সিজার শুরু করেছিলেন মিশরীয় ক্যালেন্ডার যার নাম ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। বঙ্গ-জীবনের অঙ্গের মতো আমাদের জীবনে ডেট ক্যালেন্ডার। ঘুম থেকে উঠে তারিখটা একবার ঝালিয়ে না নিলে দিনপঞ্জি গড়বড় হতে মুহূর্ত লাগে না। সোমবারকে রবিবার ভাবলে মিস হয়ে যেতে পারে অনেক প্ল্যান, প্রোগ্রাম। ক্যালেন্ডার এখন আমাদের রিস্টওয়াচ, স্মার্ট ওয়াচ, মোবাইল ফোনে থাকলেও ওয়াল-হ্যাঙ্গিং আর ডেক্স ক্যালেন্ডারের একটা আলাদা মূল্য রয়েছে। হাতে পেন, নোট বুক আর চোখের সামনে ক্যালেন্ডার— ব্যাস নেমে যাবে বড় বড় মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডা, পরীক্ষার প্রিপারেশন, বিজনেসের টুকিটাকি থেকে বড়সড় হিসেবনিকেশ। এহেন বন্ধু ক্যালেন্ডার আরও বন্ধু হয়ে উঠেছে দুই ভিন্নতর ভাবনায়। আর সেই ভিন্নতর ভাবনার দুই উদ্যোগী হলেন পারমিতা মুন্সী এবং সায়ন্তনী চাকী। দুজনের অভিনব উদ্যোগের প্ল্যাটফর্ম হল ক্যালেন্ডার। সেখানে সৃষ্টিশীল ভাবনায় তাঁরা রেখেছেন অনন্যতার স্বাক্ষর।
আরও পড়ুন-লীলায়িত ভুবন
পেট ক্যালেন্ডার
পথপশু। খুব গোদা বাংলায় বলে রাস্তার কুকুর, বেড়াল। খুব অবহেলা লুকিয়ে রয়েছে এই শব্দটায়। মালিকানাহীন, গৃহহীন কুকুর, বেড়াল। কেউ দয়া করে দুটো খেতে দিল, কেউ দিল না, কেউ-বা একটু মাথায় হাত বুলিয়ে সামান্য সহানুভূতি প্রদর্শন করল আবার কেউ খানিকটা ভয়, খানিকটা বিরক্তিতে, খানিকটা ঘিনঘিনে ভাব নিয়ে দূরে সরে রইল। এই সব পথপশু নানাভাবে অত্যাচারিতও হয়। কেউ রাগে তাদের ঢিল ছোঁড়ে, কেউ গরম জল, কেউ-বা অ্যাসিড! সত্যি কত যন্ত্রণা— চোখের সামনে জন্মানো এই পশুদের অসহায় মৃত্যু দেখে কিছু করার থাকে না। পাড়ায়-পাড়ায়, গলিতে-গলিতে এমন কত বেড়াল-কুকুর রয়েছে কে-ই বা গুনে দেখেছে। পথের ধারে অনেকগুলো বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে। কোনটা বেঁচে আছে? বেশিরভাগই গাড়ির তলায় বা অসুখেবিসুখে মারা যায়। আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী এরা অথচ আলাদা করে আমরা কেউ কি ভাবি এদের জন্য? আর রয়েছে ঘর থেকে বিতাড়িত গরু, ছাগল, অবসরপ্রাপ্ত পরিত্যক্ত ঘোড়া। রয়েছে ব্রিড ডগ, যাদের একটা সময় প্রজননক্ষমতা চলে গেলে, অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে মৃত্যুর জন্য ফেলে রেখে দেওয়া হয়। এদের পাশে দাঁড়ালেন পারমিতা মুন্সী। পাশে রাখলেন বাড়িতে যত্নে লালিত সেই পোষ্যদের। যারা প্রিয় পরিজন, ফ্যামিলি মেম্বার হিসেবে জায়গা করে নেয় তার মানুষ বাবা-মায়ের ঘরে। সকাল থেকে রাত নিশ্চিন্ত আস্তানায় তাদের জীবনযাপন। কত যত্নআত্তি তাদের। কত ভালবাসা। সেই পশুরাই পথপশুদের জন্য হয়ে উঠল বেঁচে থাকার হাতিয়ার।
এই দুই মেরুর মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক অভিনব উদ্যোগকে সফল করে তুললেন চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক পারমিতা মুন্সী। পারমিতার প্রিয় পোষ্য নিউটনের স্মৃতিতে তিনি তৈরি করলেন ‘পেট ক্যালেন্ডার ২০২৩’। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করলেন স্বামী আর্ট ডিরেক্টর সুদীপ ভট্টাচার্য এবং প্রজেক্টের ক্রিয়েটিভ সুপারভাইজার সুকন্যা রক্ষিত গুপ্ত। এই ক্যালেন্ডারে মডেল হিসেবে রয়েছেন এই শহরের নামী অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাংসদ, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিদগ্ধ মানুষজন।
আরও পড়ুন-লস্ট, থ্রিলারের মোড়কে প্রেম প্যাশন আর অন্বেষণ
জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ওয়াল-হ্যাঙ্গিং ও ডেক্সটপ ক্যালেন্ডার এটি। এই ক্যালেন্ডারের জন্য তাদের প্রিয় পোষ্যদের সঙ্গে নিয়ে যাঁরা মডেল হলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, অনন্যা চ্যাটার্জি, শ্রীলেখা মিত্র, দেবলীনা দত্ত, কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিজিৎ দত্ত, কাঞ্চনা মৈত্র, রূপাঞ্জনা মিত্র, এনা সাহা, রূপম ইসলাম, নিখিল জৈন, জয় গোস্বামী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সমু মিত্র প্রমুখ। অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন সঞ্চয়িতা তালুকদার, আবির ব্যানার্জি, সেবন্তী ঘোষ, তন্ময় দাস প্রমুখ।
আর যাদের ছাড়া এই ক্যালেন্ডার অসম্পূর্ণ সেই পোষ্য বা পেট মডেলরা হল— পান্ডা, জিজি, কোকো, আম, আটি, পণ্ডিত, কিউবা, পপকর্ন, গোল্ডি, কোকো ঘোষ, পটকাই, গাজর, চেরি, স্ন্যাপ আর ব্রুনো। ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে এই পেট ক্যালেন্ডারের। যা তখন থেকেই বেশ চর্চিত।
আরও পড়ুন-মাধ্যমিক আজন্ম প্রতিবন্ধী সায়নদীপের
এই ক্যালেন্ডার তৈরি এবং তা বিক্রির যে মহৎ উদ্দেশ্য তা হল সেই ক্যালেন্ডারের বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে প্রতিদিন ৩০০-র বেশি পথকুকুর ও বেড়ালদের খাওয়ানো। বার্ষিক ১০০টি কুকুরের স্টেরিলাইজেশন। অসুস্থ, বয়স্ক, পরিত্যক্ত পথপশুদের ফস্টারিং করানো। আর একটি পেট ক্যাব ও ২৪X৭ পরিষেবা-সহ পেট অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের সব জেলার পথপশুদের নিয়ে রয়েছে অনেক পরিকল্পনা।
এমন একটি অভিনব বিষয়ের ওপর শ্যুটিংয়ের কনসেপ্ট ও পরিকল্পনায় ছিলেন পারমিতা মুন্সী, প্রোডাকশন ডিজাইনার সুদীপ ভট্টাচার্য, ক্রিয়েটিভ সুপারভাইজার সুকন্যা রক্ষিত গুপ্ত, প্রযোজনা শিবানী মুন্সী, প্রোডাকশন কলম্বাস ডিজিপ্লেক্স, ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি সৌরভ মুখার্জি প্রমুখ।
পথপশুদের প্রতি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই এই পেট ক্যালেন্ডার তৈরি এবং বিক্রি।
আরও পড়ুন-সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের হামলায় জখম ১১ তৃণমূল নেতা-কর্মী
ইচ্ছেপূরণের
ক্যালেন্ডার
ইচ্ছেপূরণের ক্যালেন্ডার! শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও ভাবতে কিন্তু বেশ লাগে। হ্যাঁ এমন এক অভিনব ভাবনায় শামিল সায়ন্তনী চাকী এবং তার ‘আর্ট ইমপ্রেশন’। সৃষ্টিশীল শিল্পী মন সবসময় নতুনের সন্ধান করে। নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকে। সায়ন্তনীর শিল্পীসত্তা সবসময় এমনটাই চেয়েছে যা স্বাভাবিক তবে নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অন্যকে শিল্পী করে তোলা বা অপরের মনে শিল্পবোধের সঞ্চার করা কিন্তু সহজ কাজ নয়।
সায়ন্তনী এবং তার স্বামী শুভদীপ দাঁ দুজনেই ছিলেন বিজ্ঞাপন সংস্থায় ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার সুবাদে নতুন পাশ করা ছেলেমেয়েদের জন্য চেয়েছিলেন কিছু করতে যাতে তারা ভবিষ্যতের দিশা খুঁজে পায়। তাই ২০১৯-এ শুরু করেছিলেন বিজ্ঞাপনের ওয়ার্কশপ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পীদের চিঠি লেখা, সেই চিঠিতে কী কী ছবি আঁকা হত সেই নিয়ে আলোচনা, ফোটোগ্রাফির ওপর ওয়ার্কশপও। এরপরেই অনলাইন স্টোর তৈরি করার ভাবনা। ইচ্ছে ছিল সেখানে থাকবে এইরকম ক্রিয়েটিভ জিনিসপত্র। যেটার সূচনা হল হাতে-তৈরি সামগ্রী দিয়ে। অনলাইন স্টোরে পাওয়া যেত হাতে-তৈরি আলপনা, জয়নগরের পুতুল যা লোকে পায় না সচরাচর। এরপর কোভিডে বড় গ্যাপ। ক্যালেন্ডার নিয়ে পরিকল্পনার শুরু তখন থেকেই। সেই পথে বাধা ছবিতে ভরা ডেট ক্যালেন্ডারগুলোয় যেন কোথাও শিল্পসুষমার অভাব রয়েছে— মনে হত সায়ন্তনীর। তাই তাঁর ভাবনায় মনের এক নতুন ক্যানভ্যাস তৈরি হল ক্যালেন্ডারের পাতায়। কাস্টম মেড ক্যালেন্ডার আনলেন তিনি ও তাঁর সংস্থা ‘আর্ট ইমপ্রেশন’। পুজোর পর লঞ্চ হল নতুন ওয়েবসাইট। যার মাধ্যমে এই ক্যালেন্ডার বিক্রি হবে। এই ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো থাকবে ফাঁকা এবং শুধু ডেট দেওয়া।
ছোট থেকে বড়— যার যা মন চায় সে এঁকে নিতে পারবে বা আর্টওয়ার্ক করতে পারবে সেই ফাঁকা পাতায়। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো অ্যাসিড-ফ্রি আর্টিস্ট কোয়ালিটির পেপার যাতে জলরঙ, মোমপ্যাস্টেল, ওয়েল প্যাস্টেল, ওয়েল কালার— সবকিছুই ধরে যাবে নিমেষে। পাতা নষ্ট হবে না। শুধু কি আঁকিবুকি? নিজের ইচ্ছেমতো সেঁটে নেওয়া যাবে ছবি, কোলাজ, বানানো যাবে ট্রাভেলগ, অরিগামি, লিখে নেওয়া যাবে পছন্দের কবিতা, স্মৃতিচারণ বা নিতান্ত রোজকার দিনলিপি। চোখের সামনে নিজের সৃষ্টি— যার অনুভূতিটাই আলাদা।
আরও পড়ুন-কৃষকদের প্রশংসায় রাজ্যপাল
ক্যালেন্ডার লঞ্চ করার সঙ্গে সঙ্গেই দারুণ সাড়া পড়ে গেল। ছটা পাতার ডেক্সটপ ক্যালেন্ডার। দশ ইঞ্চি বাই দশ ইঞ্চি এই ক্যালেন্ডারে প্রথম পাতাটাও পুরো ফাঁকা সেখানেও আঁকা যাবে। বাকিগুলোয় শুধু ডেট দেওয়া। সেই ফাঁকা অংশে মনের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবে যার যা ইচ্ছা। এর জন্য করা হয়েছে একটা জ্যাকেট কভারও। ফলে পরবর্তীকালে এটা সংরক্ষণও করা যাবে। এই ক্যালেন্ডার খুব জনপ্রিয় হয়েছে ছোটদের মধ্যে। বড়রাও নিজেদের ইচ্ছেমতো সাজিয়েছে এই ক্যালেন্ডার। প্রথমে ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে ক্যালেন্ডারের উদ্বোধন হয়। আপাতত artimpression.in এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কিনতে পারবেন এই ক্যালেন্ডার। দাম ৪০০ টাকা