ক্যানসারের বিভিন্ন ধরনের চলতি চিকিৎসা-পদ্ধতি যেমন— কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ইত্যাদি রয়েছে তবে তা দিয়ে অল্প কিছু ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় সম্ভব হলেও সব ক্ষেত্রে এখনও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। আর এই কারণের জন্যই আপামর বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা চালাচ্ছেন এই মারণ রোগের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার আর তারই ফসল হল এই ভাইরাস দ্বারা চিকিৎসার আবিষ্কার, যেখানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার যেমন কম তেমনই ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করার প্রবণতাও বেশি।
আরও পড়ুন-মাংস ভাত খেয়ে শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং ছাত্রীর মৃত্যু
গবেষণার সূত্রপাত
সম্প্রতি কিছু তথ্যসূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে যে বিখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট তথা শল্যচিকিৎসক ইউম্যান ফং এই ভাইরাসথেরাপি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যানসারের এক মরণাপন্ন রোগীকে সুস্থ করেছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভাইরাসথেরাপি স্তন ক্যানসার, জরায়ুর ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার-সহ মোট আট ধরনের ক্যানসারের মোকাবিলায় সাহায্য করে। তবে এখন প্রশ্ন হল এই ভাইরাস থেরাপি কি সত্যিই আমাদের ক্যানসার থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় দিতে পারবে? এর জন্য ইতিহাসকে জানতে হবে।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম একটি ঘটনা সবার নজর কেড়েছিল তা হল এক লিউকেমিয়া আক্রান্ত রোগী যখন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিল, সেই রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে জর্জ ডক নামক আমেরিকান এক ডাক্তার লক্ষ্য করেন যে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রভাবে সেই রোগী ক্যানসার থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে এবং শুধু তাই নয় ক্যানসারের প্রভাবে সেই রোগীর ফুলে ওঠা যকৃৎ ও প্লিহাও ঠিক হতে থাকে, সেই প্রথম ভাইরাসের বিষ দ্বারা ক্যানসার নির্মূল হয়। এরপর গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে বিজেপি বিধায়কের সরকারি ফ্ল্যাট থেকে যুবকের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার
এর বেশ কিছু বছর পর বিখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট ও ইমিউনোলজিস্ট চেস্টার সাউথহ্যাম ১৯৫৬ সালে প্রথম ট্রায়াল করেন তিরিশ জন ক্যানসার রোগীর ওপর। তিনি এই তিরিশ জন ক্যানসার রোগীর দেহে প্রথমে অ্যাগডিনোভাইরাস প্রবেশ করিয়ে লক্ষ্য করেন যে এই তিরিশ জন রোগীর মধ্যে ২৬ জন রোগীর দেহেই টিউমারের আকার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। প্রথম ট্রায়ালের এই সাফল্য দেখে তিনি এর দ্বিতীয় ট্রায়াল করেন। এই ট্রায়ালে তিনি ক্যানসার রোগীদের হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দেন এবং লক্ষ্য করেন প্রথমে এই ট্রায়ালের ফলও প্রথম ট্রায়ালের মতোই আসছিল তবে কিছুদিন পর এই গবেষণা ব্যর্থ হয়।
আরও পড়ুন-আধারের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুললো আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা
এরও বেশ কিছু বছর পর ১৯৯০ সালে আবার এই ভাইরাসথেরাপি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। যুগটা ছিল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর, ফলতই বিজ্ঞানীরা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়, যার মধ্যে ছিল ওই ভাইরাসের বাইরের আবরণে থাকা HBs অ্যান্টিজেন। যা মানুষের দেহে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে হেপাটাইটিস বি-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা সফলভাবে সম্ভব হল। এই সফল্যের পর ১৯৯৬ সালে আবারও একদল বিজ্ঞানী, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক ম্যাককরমিক ও তাঁর দলবল অ্যাগডিনোভাইরাসকে জিনগতভাবে পরিমার্জন করে এক নতুন ধরনের ভাইরাস ONYX-015 তৈরি করেন। এই ONYX-015 এর মূল কাজই হল সেই সমস্ত কোষকে ধংস করা যার মধ্যে P53 নামক একটি প্রোটিন নিষ্ক্রিয় রয়েছে। আসলে এই P53 স্বাভাবিক কোষে সক্রিয় অবস্থায় থেকে কোষের বিভাজনকে তথা মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করে ফলে টিউমার অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ঘটে না।
আরও পড়ুন-নির্মলচন্দ্রের দ্রুত শপথের উদ্যোগ, রাজ্যপালকে চিঠি পরিষদীয় মন্ত্রীর
কিন্তু ক্যানসার কোষে এই P53 নিষ্ক্রিয় থাকায় তা টিউমারের বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে আর এই বৃদ্ধিকে রুখতেই ONYX-015 সাহায্য করে। তবে সমস্যা এখানেও ছিল। কিছুদিন পর দেখা গেল এই ভাইরাসগুলি নিজেদের যে নতুন প্রতিলিপি তৈরি করছে সেগুলি একই গুণসম্পন্ন নয় এবং প্রতিলিপিকরণেও এরা বেশি সময় নিচ্ছে। তাই তারা ক্যানসার কোষের পাশাপাশি স্বাভাবিক কোষকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এরপর তারা বসন্ত রোগের ভাইরাস অর্থাৎ ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস নিয়ে কাজ শুরু করে। এই ভাইরাস নেওয়ার কারণ ছিল দুটি। এক, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের দেহে আগে থেকেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে তাই নতুন করে এরা মানুষের দেহে তেমনভাবে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না আর দুই, এর জিনধারণ ক্ষমতা বাকি ভাইরাসের তুলনায় বেশি। তাই ক্যানসার চিহ্নিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রোটিন তৈরি করার জিন এর মধ্যে খুব সহজেই প্রবেশ করানো যেতে পারবে।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গু রোধে অভিযান, পরিত্যক্ত কারখানায় লার্ভা নিধনে ড্রোন ওড়াল পুরসভা
ক্যানসারের বিরুদ্ধে কীভাবে কাজ করে?
প্রফেসর ইউম্যান ফং এই ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাসের জিনগত পরিমার্জন ঘটিয়ে তাকে ক্যানসার কোষ ধ্বংসের উপযোগী করে তোলেন। সাধারণত এই ভ্যাক্সিনিয়াতে এমনভাবেই জিনের পরিবর্তন করা হয়েছিল যাতে এরা কোষে প্রবেশের পর অন্যান্য ভাইরাসের মতো আমাদের অনাক্রম্য তন্ত্রকে সক্রিয় না করে, শুধু এমন ধরনের প্রোটিন তৈরি করে যা এদের ক্যানসার কোষকে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে। এই ভাইরাস কোষে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে Max-প্রোটিন তৈরি করে যা ক্যানসার কোষকে চিনে তার মধ্যে প্রবেশ করে থাইমিডিন কাইনেজ নামক একধরনের উৎসেচক ক্ষরণ করে, যা সেই কোষে সাইটোটক্সিনের পরিমাণ বাড়াবে অর্থাৎ এমনভাবে বিষক্রিয়া ঘটাবে, যাতে সেই কোষটি মারা যেতে বাধ্য হয়। এই প্রোটিন ছাড়াও এই ভাইরাস থ্রম্বোস্পন্ডিন নামক একধরনের প্রোটিন ক্ষরণ করে যা একটি বিশেষ পদ্ধতিতে ক্যানসার কোষগুলির তৈরি করা রক্তবাহগুলিকে ব্যাপকহারে নষ্ট করে দেয় ফলে ক্যানসার কোষগুলিও অতি সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এই সমস্ত কাজ ঠিকঠাক চলছে কিনা তার নজরদারি করার জন্য থাকে HNIS (Human sodium iodide symporter) যা শুধুমাত্র ক্যানসার কোষকেই চিহ্নিত করতে পারে এবং এর অবস্থান ও পরিমাণ সম্পর্কেও অবগত করে।
আরও পড়ুন-বিদ্যুৎ পরিকাঠামো আধুনিকীকরণে জোর, সব সরকারি দফতরেই এবার বসছে স্মার্ট মিটার
বর্তমানে ভ্যাক্সিনিয়ার ব্যবহার
ভ্যাক্সিনিয়া সর্বপ্রথম ইঁদুর তারপর গিনিপিগ এবং তারও পর বাঁদরের দেহে প্রবেশ করানো হয় এবং সমস্ত ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের পরই FDA একে মানুষের ওপর ট্রায়াল করানোর জন্য ছাড়পত্র দেয়। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের সিটি অফ হোপ হাসপাতালের ১০০ জন ক্যানসার রোগীকে নিয়ে এই ট্রায়াল করা হয়। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে অন্য প্রাণীদের মতো মানুষের শরীরেও এটি সমান মাত্রায় কার্যকর। আমাদের দেশেও মুম্বইয়ে টাটা মেমোরিয়াল, আইআইটি বোম্বে এরা মিলে এমন এক ধরনের ড্রাগ তৈরি করছে যার মধ্যে আমাদের T-কোষও যুক্ত রয়েছে। একে কাইমেরিক T-কোষ থেরাপি বা CAR-T-কোষথেরাপিও বলা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই এটিরও হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হবে।