ভোট-যুদ্ধ : দেওয়াল থেকে ওয়াল

রাত জেগে দেওয়াল লেখার দিন শেষ হয়েছে। লড়াই এখন ওয়ালে ওয়ালে। দেওয়ালের ছড়া, ব্যঙ্গচিত্র, প্যারোডি অনেকটা ফিকে হয়েছে। কিন্তু এক বিন্দুও কমেনি ভোট প্রচারের যুদ্ধ। রাজনৈতিক নেতাদের এবং দলের ওয়াল আলোকিত করে আছে প্রচার। পাড়ায় পাড়ায় দেওয়াল দেখে ওয়ালে ওয়ালে উঁকি মারলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

টেল অফ টু সিটিস
শহরে তখনও পৌঁছায়নি যুদ্ধের আঁচ অথচ মকর্শাল এবং গ্রামে যুদ্ধ লেগেছে। ভোট যুদ্ধ। শুরু হয়েছে দেওয়াল দখলের লড়াই। অজয় সারা রাত না ঘুমিয়ে পাহারা দিয়েছে পাশের পাড়ার ভট্টাচার্য বাড়ির দেওয়াল। ভোরের আগে না লিখতে পারলে সকালে সদলবলে ওই দেওয়াল লিখে দেবে পল্টুর দল। তাই অজয়-পল্টুদের চোখে রাতে এখন আর ঘুম নেই। তাও মেতে উঠেছে বাঙালির ভোট পার্বণে।
এদিকে বেশ ক’দিন বুবাইয়ের রমরমা। দল তাকে দায়িত্ব দিয়েছে প্রতিদিন তার দলের ফেসবুক পেজে একটা করে রাজনৈতিক ছড়া লেখার। দায়িত্ব দিয়েছে বিরোধী দলের পেজগুলোকে স্টক করার। তাই বুবাই দিনরাত আকাশকে দিয়ে ডিজিটাল কার্টুন আঁকাচ্ছে সেগুলো প্রকাশ করছে কখনও রিল বানিয়ে আবার কখনও ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। পাড়ায় তার দলের আইটি সেল চালানোর দায়িত্ব বাবাইয়ের। তাই প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন মিমস, রিলস কার্টুন এমনকী স্লোগান।
শহর থেকে গ্রাম এখন ছুটছে দেওয়াল ধরে রাখার লড়াইয়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে এখন এক মুহূর্তও সময় নেই। দম ফেলারও সময় নেই। ভোটের রাজনীতির চক্রব্যূহে তারা খাবি খাচ্ছে। বাঙালির এই ভোটপার্বণ এখন দেওয়াল জুড়ে। ভোট প্রচারের মাধ্যম এখন আর শুধু দেওয়াল নয়, ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, মোবাইল মেসেজ তবে ফ্লেক্স, হ্যান্ডবিল, ফ্ল্যাগ, মিটিং, মিছিল, স্লোগান— এইগুলোও কিন্তু অতীত হয়নি। বরং এখন দেওয়াল থেকে ওয়াল রাজনীতির ছন্দে ছড়ায় রঙিন হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন-চাকরিহারা শিক্ষকদের ধরনায় বিজেপির মিছিল থেকে হামলা, পিছনে গদ্দারের উসকানি

দাদাঠাকুরের পরম্পরা
দল আর দলাদলি নিয়ে রাজনীতির ‘আকছা-আকছি’ দেখিয়েছিলেন দাদাঠাকুর। তবে এখন ডিজিটাল যুগেও তুলির ছোঁয়ায় দেওয়ালের নানা রং-ই বলে দেয় ভোটের ‘আগমনী’। রাস্তা কিংবা বাজারের পাশে এতদিন যেসব দেওয়াল অবহেলায় পড়েছিল সেগুলিতে তুলির টানে নিত্যনতুন ব্যঙ্গচিত্র ও ছড়ায় রঙিন হয়ে উঠছে। কোথাও তীব্র রাজনৈতিক স্লোগান, কোথাও মজার টিপ্পনী রচনা করে একে অপরকে রাজনৈতিক আক্রমণ করার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই চলছে বঙ্গ রাজনীতিতে। লোকসভা নির্বাচনে এখন সেই দেওয়াল লিখতে ব্যস্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর অন্যতম সহজ মাধ্যম হয়ে উঠেছে খেউড় ব্যঙ্গচিত্র, কার্টুন, ছবি, স্লোগান— কত কী! দেওয়াল যেন ক্ষমতা দখলের অদৃশ্য ক্যানভাস। বহু জায়গায় দেওয়াল দখল নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। যার ক্ষমতা বেশি তার দেওয়াল বেশি। অনেকের বিশ্বাস এলাকার মানুষ দেওয়াল দেখে বুঝতেই পারে যে ওই এলাকায় ভোট জিতছে কে! দেওয়াল জুড়ে থাকে রাজনীতি, দেওয়াল জুড়ে থাকে ইস্যু। তবে সম্প্রতি মাটির দেওয়ালের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার ওয়ালও মেতে উঠেছে প্রচারে। এখানেও তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক হিংসা। ফেসবুকে দেওয়ালের ছবি পোস্ট করা, কারওর ছবি লাইক করা বা কমেন্ট করা কোনও পোস্ট এবং অ্যাক্যাউন্ট রিপোর্ট করা সব কিছুর ওপর পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক অনুসন্ধিৎসা। এমনকী সাইবার ওয়ালে ভোট প্রচারের কারণে এ-দেশের জেলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ছাড় মিলছে না ছাত্র থেকে অধ্যাপক— কারওরই।

আরও পড়ুন-১০০ দিনের কাজে সবংয়ের মাদুরশিল্পীরা কেন্দ্রের টাকা থেকে বঞ্চিত, পাশে মুখ্যমন্ত্রী

এখন অবশ্য দেওয়াল লেখায় নানা প্রশাসনিক বিধিনিষেধ রয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন কমিশন প্রতি বর্গফুট রঙিন দেওয়াল লেখার জন্য ১২ টাকা দর বেঁধে দিয়েছিল। চুনের দেওয়ালে লেখার দর ছিল দেড় টাকা প্রতি বর্গফুট। এই খরচের হিসাব প্রার্থীর নির্বাচনে খরচের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোন প্রার্থী কতটা দেওয়াল লিখল তার সঠিক হিসেব রাখা সম্ভব হত না। রাজনীতির চোরাবালিতে নির্বাচন কমিশনকে হিমশিম খেতে হয় দেওয়াল খুঁজতে গিয়ে। গ্রাম থেকে শহরে, পথে ঘাটে, মাটির বাড়ি, গোয়াল ঘর, বাথরুম, ভাঙা প্রাচীর, পাকা বাড়ি, দোকান ঘর, যাত্রিনিবাস, রেল স্টেশন, স্কুল কলেজ, অফিস কাছারি, বাস-ট্রেন, হাসপাতাল, এইগুলির দেওয়াল দখল শুরু হয়। নির্বাচন কমিশন অবশ্য বলেই দিয়েছে সরকারি বাড়ির দেওয়ালের দখল নেওয়া চলবে না।
খবরের কাগজ-আলতা-দেওয়াল
দেওয়াল দখলের এই লড়াই জনপ্রিয় হয়েছিল বাম আমলে। একসময় পুরনো খবরের কাগজে লাল আলতা দিয়ে লেখা হত স্লোগান। সাবুর আঠা অথবা বেলে আঁঠা দিয়ে সেগুলি সেঁটে দেওয়া হত দেওয়ালে দেওয়ালে। ১৯৬৭ সাল থেকে বামেরা রাতারাতি রঙিন পোস্টার লিখতে থাকে। লাল, কালো এবং প্রুসিয়ান ব্লু দিয়ে পোস্টার ছাপতে শুরু করে। তখন দেওয়ালে দেওয়াল সেই পোস্টার সেঁটে দেওয়া হত। ছয়ের দশকের শেষ দিকে আলকাতরা, ভুসোকালি, রঙিন ব্লু, আলতা এদের ছিল আধিপত্য দেওয়ালে দেওয়ালে। বিজ্ঞান তখনও অত উন্নত হয়নি তাই ভোট প্রচারে তেমন বিজ্ঞানভিত্তিক গতি আসেনি। পাড়ার দেওয়ালই তখন পৌঁছে যেত অনেক বেশি মানুষের কাছে। তবে দেওয়ালের প্রাসঙ্গিকতা এখনও আছে।

আরও পড়ুন-নিজ্জর খুনে কানাডায় গ্রেফতার ৩ ভারতীয়

ডাউন মেমোরি লেন
রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারের অভিমুখ প্রযুক্তি-নির্ভর হলেও দেওয়াল কিন্তু মুখ লুকায়নি। এই দেওয়ালই জন্ম দিয়েছে প্রশ্রয় দিয়েছে নতুন সৃষ্টিকে, তৈরি হয়েছে নানা ছড়া। কোনও রাজনৈতিক দলই বাদ যায়নি। দেওয়ালে কেউ লিখছেন ‘ভোট দিন বাঁচতে, তারা হাতুড়ি কাস্তে’। আবার কেউ লিখছেন ‘চীনের দেওয়া কাস্তে আর পাকিস্তানের তারা/ এখনও কি বলতে হবে দেশের শত্রু কারা?’। আবার কোনও কোনও দেওয়ালে ফুটে উঠছে ‘রোদ বৃষ্টি বর্ষা/ তৃণমূলই ভরসা’ অথবা ‘চুপ চাপ ফুলে ছাপ’ অথবা ‘এই আমি মমতা চাই পেতে ক্ষমতা/কাগজের ভাঁওতায় ভোলায় যে জনতা, হেরেছি যাদবপুর জিতিবার বড় স্বাদ/ এবারে হেতাই আমি সিম্বল কাটা হাত’ আবার কখনও দেওয়ালে লেখা হয়েছে ‘কী পরিবর্তন আনলে কাকা বাজার করতে পকেট ফাঁকা’ কোথাও লেখা হয়েছে ‘কাল ছিল ডাল খালি আজ ফুলে যায় ভরে’। আবার বিজ্ঞাপনেরই ঢঙে অভিনব কোনও দেওয়ালে লেখা হয়েছে ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল সব কেন্দ্রে তৃণমূল’ বা ‘ঝকঝকে রাস্তা চকচকে আলো, সবাই বলছে এর থেকে তৃণমূল ভালো’ বা ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ বোমা নিয়ে কয়েকশোটা, পার করাস ইলেকশনটা/ বাঁচাস দিদির সম্মানটা’। সরকার, বিরোধী কেউই দেওয়ালকে খুব একটা হালকা ভাবে নেয়নি। জনমুখী ছড়া লিখেছেন কেউ। বলেছেন ‘ভোট দেবে কিসে?/ কাস্তে ধানের শীষে’। কেউ লিখেছেন ‘ভোট দেবেন কোথায়?/ জোড়া বলদ যেথায়’ আবার কোনও দেওয়ালে লেখা হয়েছে ‘জোড়া বলদের দুধ নেই, কংগ্রেসের ভোট নেই’। আবার এও লেখা হয়েছে ‘গাছের উপর জোড়া ফুল, আমরা সবাই তৃণমূল’।

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যের ক্ষেতে উদ্ধার দলিতকন্যার ঝলসানো দেহ

গান-কবিতা-ছড়ার প্যারোডি
বিভিন্ন কবির কবিতা এবং গানের প্যারোডি ব্যবহার করা হয়েছে দেওয়াল লেখায়। ৬,৭ এবং ৮ এর দশক জুড়ে দেওয়াল ছিল এইসব লেখায় সড়গড়। ‘রাস্তার মোড়ে লাল বাতি জ্বেলে/ শকুনেরা দেয় সন্ধে/ জোড়া বলদকে দেওয়ালে লটকে,/ ঠোঁট চেটে বলে ভোট দে’। আবার কোনও দেওয়ালে লেখা হয়েছিল ‘সন্ধেবেলায় লাল বাতি জ্বেলে/ দালালেরা দেয় সন্ধে/ কাস্তে হাতুড়ি দেওয়ালে লটকে/ ঠোঁট চেটে বলে ভোট দে’। কোনও কোনও দেওয়ালে জনপ্রিয় গান থেকে গানের আদলে লেখা হয়েছে স্লোগান— ‘সাধের মহা যোগ বানাইলো মোড়ে বৈরাগী’ কেউ লিখেছেন ‘কাদের কুলের দিদি গো তুমি? কাদের কুলের দিদি’ আবার কোনও দেওয়ালে লেখা হয়েছে ‘প্রথমত আমি মহাজোট চাই/ দ্বিতীয়ত আমি বিজেপিকে চাই,/ তৃতীয়ত আমি কংগ্রেসকে চাই/ চতুর্থত না জানি কাকে যে আমি চাই’ আবার কখনও লিখছেন ‘শুন হে দেশের ভাই/ যুক্তফ্রন্টে গোদিই সত্য/ দেশপ্রেম কিছু নাই’ আবার এমন দেওয়ালও দেখা গেছে যেখানে লেখা হয়েছে ‘গত ভোটের ভুলের মাশুল দিলাম ন-মাস ধরে/ ফ্রন্ট বাবুদের ভোট দিয়ে তার পেলাম হারে হারে’। আবার কোথাও দেখা গেছে ‘নতুন নতুন মন্ত্রীগুলি ছোটন বেঁধেছে, ওপারে তে জর্জ ভায়া ভেসে উঠেছে কে দেখেছে? তহেলকা দেখেছে, তলেহকার হাতে ডট কম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে। উফফ দিদি বড্ড লেগেছে।’ আবার কোনও দেওয়ালে দেখা গেছে ‘হাত উঠেছে ফুল ফুটেছে, যোগ করেছে কে? দিদি নাচছে দাদু নাচছে, দেশ ভোগে যাগ্গে’। কোথাও আবার লিখেছে ‘অনেক দেখেছি, ঢের হয়েছে/ ভেগেছে তোদের জোট, লজ্জা যদি থাকে তবে আর, চাসনি করে ভোট’।

আরও পড়ুন-দেবের কপ্টারে ধোঁয়া, জরুরি অবতরণে রক্ষা

দেওয়ালে ব্যক্তি আক্রমণ
ভোট প্রচারে পাড়ার দেওয়াল হয়ে উঠেছিল ব্যক্তি কুৎসা এবং আক্রমণের পীঠস্থান। এই বাংলার দেওয়ালই দেখিয়েছে নানা ব্যক্তি-বিরোধী স্লোগান। আবার কোথাও দেখিয়েছে ‘দু-আনা সের বেগুন কিনে / মন হল প্রফুল্ল/ বাড়িতে এসে কেটে দেখি সব / কানা অতুল্য’। আবার কোথাও লিখেছে ‘দেহের শত্রু প্যাঁচড়া খোস/ দেশের শত্রু জ্যোতি বোস’ বা ‘যেখানেই জ্যোতি সেখানেই ক্ষতি’ বা ‘বাংলার দুই পশু ইয়াহিয়া, জ্যোতি বসু’। আবার এটাও দেখা গেছে ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম বাজে/ সেন প্রফুল্ল ঘোষ প্রফুল্ল আর অতুল্য নাচে’। আবার ছোটদের ছড়াও স্লোগানের বিষয় হয়ে উঠেছে— ‘ইন্দিরা মাসি বাজায় কাঁসি/ প্রফুল্ল বাজায় ঢোল/ আয় অতুল্য ভাত খাবি আয়/ দিয়ে কানা বেগুনের ঝোল’। আবার একই ভাবে অন্য দেওয়ালে দেখা গেছে ‘অনিলা মাসি বাজায় কাঁসি/ জ্যোতি বাজায় ঢোল/ আয় প্রমোদ ভাত খাবি আয়/ দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল’। আর একটি জনপ্রিয় ছড়ার আদলে দেওয়ালে লেখা হয়েছে— ‘কিল মারেনি ঢিল মেরেছে/ তাতেই তোমরা রুষ্ট হলে/ তোমরা যখন হুকুম দিয়ে চালাও গুলি দুষ্টু বলে/ তার বেলা/ তোমরা কেবল শৃঙ্খলা চাও, আইন করো চাও বিচার/ বলছ না তো ব্যর্থ শাসন/ অক্ষমতার দাও বিচার/ তার বেলা?’ আবার জনপ্রিয় গানের প্যারোডি করে এই বাংলার দেওয়ালে এক সময় লেখা হয়েছে— ‘শোনো বন্ধু শোনো, ফ্রন্টের ওই নো মাসের ইতিকথা/ ১৪ জনের গোঁজা মিলের সে এক বীভৎসতা/ ওদের নীতি নেই/ ওদের স্থিতি নেই ভাঁওতা দিতেই ভুল বোঝাতেই/ ওদের দক্ষতা’।
আবার এমন অনেক দেওয়াল লেখার ছবি ছড়িয়ে আছে স্মৃতি জুড়ে। যা দেখলেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কোথাও লেখাছিল ‘বাংলা থেকে পাকিস্তান কে বিদায় করল ঝেঁটিয়ে, আর কেউ নয়, জহরলালের বেটিয়ে’। কোথাও লেখা হত— ‘রায়বেরিলি ভুল করেছিল চিকমাগালুর করেনি, সিপিআইএম মনে রেখো ইন্দিরাজি মরেনি’। কোথাও আবার ফুটে উঠেছিল ‘বড়লোকের বেটি লো সাদা কালো চুল, বাপের কোটে গোঁজা ছিল লাল গোলাপ ফুল, সেই বেটির বেটা লো পাতলা পাতলা চুল, দেশ জুড়ে ফুটিয়ে দিল, হলুদ সর্ষে ফুল’। আবার ছোট ছোট বাক্যে স্লোগানও লেখা হয়েছে দেওয়াল জুড়ে— ‘ভিক্ষা নয় চাইছি ঋণ হাত চিহ্নে ছাপ দিন’ বা ‘শুনলেও হাসি পায় কাটা হাত ভোট চায়’ বা ‘শুনলেও হাসি পায় খুনি কংগ্রেস ভোট চায়’ আবার এটাও লেখা হয়েছে— ‘জলের শত্রু কচুরিপানা দেশের শত্রু অতুল্য কানা’। কোথাও লেখা ছিল— ‘ওপরে ভরা নিচে ভরা মধ্যিখানে সর্বহারা’। কোথাও আবার ‘গলি গলি মে শোর হে রাজীব গান্ধী চোর হে’। কোথাও লেখা ছিল— ‘জ্যোতি বসু বুদ্ধ বিমান কোথায় গেল বোফর্স কামান’। কোথাও আবার লেখা হয়েছে— ‘জহরের নাতি তুমি ইন্দিরার ছেলে, বোফর্স কামান কিনে কত টাকা পেলে’।

আরও পড়ুন-প্রকাশিত ফল: হাইমাদ্রাসা-আলিম-ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

দেওয়াল জুড়ে কবিগান
দেওয়াল লেখার এই খেলায় কবি গানের আঙ্গিকও বাদ যায়নি। কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েনি। কোনও দল লিখেছে— ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে চাদনা তলায় কে?/ হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে জ্যোতিবাবুর বে’। তার নিচে বিরোধীরা লিখে গেছে— ‘ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ভাই/ ইন্দিরাকে ছাঁদনাতলায় সাজিয়ে আনা চাই’। আবার কোথাও দেওয়ালে লেখা হয়েছে— ‘টাটা আর ন্যানো গেল বাংলা হল শুদ্ধ/ আর কটা দিন সবুর করো এবার যাবে বুদ্ধ’। ঠিক তার নিচেই বিরোধীরা লিখেছে— ‘দিদি যখন ন্যানো তাড়ায় দাদারা যায় সাথে বেকার যুব ভোট দেবে না ফুলে কিংবা হাতে’।
সরাসরি ভোটযুদ্ধ ওয়ালে
দেওয়ালের ভোট যুদ্ধ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রতি মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠছে মিমিস আর রিলে। থাকছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আক্রমণ। থাকছে তাঁদের মুখ ফসকে বলে ফেলা কোনও কথা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নেতা-মন্ত্রীরা সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার নিয়োগ করেছে। প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যেখান থেকে নিয়মিত নিজেদের এবং দলীয় মতামত, কর্মকাণ্ডগুলো প্রচার করা হয়। লক্ষ লক্ষ সমর্থক, বিরোধী দলীয় পক্ষের ভোটারদের সাথে সরাসরি কৌশল বিনিময়, বিভিন্ন মতামত আদান-প্রদানে এই ডিজিটাল মাধ্যমগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি এত বেশি সহজ আর কার্যকর যে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো থেকে শুরু করে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে নিয়মিত ভাইরাল হচ্ছেন। এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান, নির্বাচনী প্রচার বাজেটের প্রায় ৫০ শতাংশ টাকা ইন্টারনেট-ভিত্তিক মাধ্যমগুলোতে ব্যয় করেছে।
ফেসবুক, ট্যুইটার, ইউটিউবের মতো মিডিয়াগুলো রাজনীতিবিদদের সরাসরি ভোটারদের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে টাকার বিনিময়ে প্রচারের প্রথাগত পদ্ধতিগুলো থেকে বের হয়ে বর্তমানে নামমাত্র খরচে প্রায় প্রত্যেকের কাছে প্রার্থীরা পৌঁছে যেতে পারছেন।

আরও পড়ুন-প্রকাশিত ফল: হাইমাদ্রাসা-আলিম-ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

কম খরচে সবার কাছে ওয়াল
একটা সময় ছিল, যখন টেলিভিশন, রেডিও এবং প্রিন্ট মিডিয়াই ছিল নির্বাচনী প্রচারণা মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে প্রচারের অভিপ্রায়ে এসব মাধ্যমগুলোর সময় কেনার জন্য ব্যয় করতে হত মোটা টাকা। কিন্তু বর্তমানে খুব সহজেই ইউটিউব, ফেসবুক, ট্যুইটারের মাধ্যমে এসব প্রচার চালানো যায়। আর যেহেতু ইন্টারনেট-ভিত্তিক মিডিয়াগুলোতে যেকোনও সময় প্রায় সবরকমের উপায়ে প্রচার চালানোর সুযোগ রয়েছে, সেহেতু কেবল প্রিন্ট মিডিয়ার মতো নির্ধারিত সময় এবং বাধ্যবাধকতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। ফলে নির্বাচনী প্রচার ব্যবস্থা দিন দিন পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়ামুখী হয়ে যাচ্ছে।
শেয়ার এবং রি-ট্যুইটে প্রচার
ফেসবুকের শেয়ার এবং ট্যুইটারের রি-ট্যুইট ফিচারগুলো বর্তমানে যেকোনও জিনিসকে খুব সহজেই ভাইরাল করে দিতে পারে। নির্বাচনী প্রচারণায়ও এদের ভূমিকা চোখে লাগার মতো। নির্দিষ্ট কোনও দলের সম্ভাব্য ভোটাররা তাঁদের নেতা-নেত্রীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া ভাষণের ভিডিও-সহ বিভিন্ন সংবাদ খুব সহজেই নিজেদের প্রোফাইলে শেয়ার এবং রি-ট্যুইট করার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারে। তাছাড়া কোনও একটি নির্বাচনী ইভেন্টে লোক জড়ো করার জন্য পূর্বের মতো আর বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন কিংবা পোস্টার ছাপানোর প্রয়োজন হয় না। দলীয় ইভেন্টগুলোতে লোক জড়ো করার অভিপ্রায়ে খুব সহজেই নির্দিষ্ট কোনও দলের ফেসবুক ইভেন্টগুলোকে সমমনস্ক লোকদের কাছে শেয়ার করে ছড়িয়ে দিতে পারে।
ওয়ালে ভোটারের মন বোঝা
বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের সবরকমের তথ্যের ব্যাপারেই ওয়াকিবহাল। ফেসবুক, ট্যুইটারের মতো কোম্পানিগুলো নিজেদের সাইটে এমন সব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যেগুলো গ্রাহকদের পছন্দ, অপছন্দ, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা করে নিতে পারে। আর এই সুবিধাটিই তারা বিজ্ঞাপন ব্যবসায় কাজে লাগায়। ব্যবহারকারীর বয়স, সামাজিক, ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান চিহ্নিত করে কোনও একটি নির্দিষ্ট দলে ভাগ করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী তাদের পছন্দসই দলের ব্যাপারে পছন্দসই বিজ্ঞাপন উপস্থাপন করে। এ-ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষ যদি নির্দিষ্ট কোনও দলের নির্বাচনী প্রচারের জন্য বেতনভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে ওই দলটির ব্যাপারে ইতিবাচক হিসেবে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, এমন সব তথ্য বিরোধী মনোভাবের গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়, যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অধিকাংশ ভোটারকে দল পরিবর্তনে উৎসাহিত করে।

আরও পড়ুন-ভোটের মুখে মহিলা কমিশনের কয়েকশো কর্মীকে ছাঁটাই!

খোলামেলা বিতর্ক
যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া সর্বসাধারণের কাছে উন্মুক্ত এবং খুব সহজেই যে কেউ যেকোনও পোস্টে মন্তব্য করতে পারে, সেহেতু কোনও রাজনৈতিক নেতার কোনও মন্তব্য হঠাৎ করেই কিছু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, আবার অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায় যা পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্কের সৃষ্টি করে।
বাঙালির রাজনৈতিক দেওয়াল চর্চার অনেকটা জুড়ে ছিল কার্টুন। সেই কার্টুনের কিছু কিছু এখন চোখে পড়লেও দেওয়াল থেকে অধিকাংশ কার্টুন ছুটি নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালেও তাদের তেমন হাজিরা নেই। কিন্তু একটা সময় ছিল, না-বলা কথা বলার সেরা মাধ্যম এই কার্টুন। পাড়ায় পাড়ায় শঙ্কর, চণ্ডী লাহিড়ীর উত্তরসূরিরা হারিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের প্রাপ্তি শুধু ওয়ালে ওয়ালে ব্যঙ্গ ভিডিওর কূটকচালির। আগামী দিনে সেই ওয়ালই হয়তো হয়ে উঠবে বদলে যাওয়া প্রচারের অন্যতম অস্ত্র।

Latest article