বঞ্চনার তালিকা অন্তহীন। এবং তাতে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। আমরা বেশ বুঝে গেছি, দিল্লির বাবুরা বাংলাকে ভালবাসেন না। আদিবাসী-তফসিলিদের ভালবাসেন না। বঞ্চনা করেন। বাংলার (West Bengal) মানুষের ভাত মারেন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বনাচনের আগে বাংলায় ২০০’র বেশি আসন দখল করার দাবি করেছিলেন মোদি-শাহরা। আর তা সফল করতে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা থেকে বিজেপির হেভিওয়েট নেতারা এসে একের পর এক জনসভা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। তা সত্ত্বেও এ-রাজ্যে ৭৭টি আসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। দিল্লির বাবুদের বাংলায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি ধোপে টেকেনি।
নির্বাচন এলে দিল্লির বাবুরা সব বড় বড় কথা বলেন। কিছু কিছু গরিব মানুষকে লুকিয়ে লুকিয়ে উজ্জ্বলা গ্যাসের কানেকশন দিচ্ছেন বলেও জানা যাচ্ছে। এবার যদি ভোট জেতেন, তাহলে ফের গ্যাসের দাম ১০০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০০ টাকা করে দেবে ওরা। আমাদের ফের পুরনো দিনে ফিরে যেতে হবে। জঙ্গলে গিয়ে কাঠ জোগাড় করতে হবে।
ওদের লক্ষ্য, এনআরসি’র নামে মানুষকে দেশ থেকে তাড়ানো। আর জননেত্রী বলছেন, ‘আমি একটা মানুষকেও তাড়াতে দেব না। আপনারা সবাই নাগরিক। পরিষেবা পান, ভোট দেন।’ তিনি বলছেন, এখন উন্নয়নের পালা। রাজ্যে অনেক রক্ত ঝরেছে, এবার আরও উন্নয়ন করতে হবে। ধর্ম এবং জাতপাতের ভিত্তিতে ভাগাভাগির সমস্ত চক্রান্ত ভেস্তে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন তিনি সাধারণ মানুষকে। কেন্দ্র না দেওয়ায়, রাজ্যের ৫৯ লক্ষ বঞ্চিত জবকার্ড হোল্ডারের মজুরি বাবদ বকেয়া ২৬৫০ কোটি টাকা মেটাচ্ছে তাঁর সরকার।
১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রাপ্যের পর এবার কোপ পড়তে চলেছে শিক্ষাক্ষেত্রে। ‘সমগ্র শিক্ষা অভিযানে’ বরাদ্দ ১ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা আটকানোর ব্যবস্থা চলছে। পিএম-শ্রী প্রকল্পে গোটা দেশে সাড়ে ১৪ হাজার স্কুলকে ‘মডেল’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান নরেন্দ্র মোদি। জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-র প্রস্তাব অনুযায়ী কেন্দ্র এই টার্গেট স্থির করেছে। প্রকল্পটি সংক্রান্ত মন্ত্রকের ‘নোট’ থেকে জানা যাচ্ছে যে, এখনও পর্যন্ত ২৮টি রাজ্যের ৬ হাজার ৪৪৮টি স্কুলকে বেছে নিয়েছে মোদি সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ৮৬৩টি প্রাইমারি এবং সেগুলি উন্নতিসাধনে চলতি অর্থবর্ষে চার হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দও হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আগ্রহী নয়। তাই অন্য খাতের টাকা আটকে চাপ তৈরির চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন উঠছে, একটিমাত্র প্রকল্পে অনাগ্রহী হওয়ায় সমগ্র শিক্ষা অভিযানের টাকা আটকানোর পরিকল্পনা কেন? বাংলার ১ লক্ষ ১৬ হাজার কোটি টাকার বকেয়া ইস্যুতে মুখ খুলতেই হবে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের।
আরও পড়ুন: সৌজন্য সাক্ষাতেও বাংলার বকেয়া-দাবি জানালেন মুখ্যমন্ত্রী
আমাদের ১০০ দিনের শ্রমিকদের ‘মন কি বাত’ আপনি শোনেন না। আপনার সরকার তো ওই খাতে বরাদ্দ টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বাংলার সমস্ত বঞ্চিত শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজের টাকা মিটিয়ে দিচ্ছে।
সিবিআইয়ের এফআইআরে নাম থাকা শুভেন্দু অধিকারীকে কি আপনি দল থেকে বহিষ্কার করবেন? না কি ওঁর সঙ্গেই এক মঞ্চে থেকে দুর্নীতিগ্রস্তদের আশ্রয় দেওয়ার ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ প্রমাণ করবেন আরও একবার? শাহজাহানকে সাসপেন্ড করে দল হিসাবে তার ভূমিকা পালন করেছে তৃণমূল। কিন্তু বিজেপি কি শুভেন্দু অধিকারীর মতো দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দেবে?
২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ৬৬৮টি নথিভুক্ত ঘৃণাভাষণের ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি-র একটি গবেষণা সংস্থা ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নেমে আসা ঘৃণাভাষণের ঘটনার হিসাব কষে দেখিয়েছে, মোট ঘটনার প্রায় ৭৫ শতাংশই ঘটেছে নানা বিজেপি-শাসিত রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং দিল্লিতে— যার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি কেন্দ্রাধীন। সংখ্যাগুরুত্বের দিক থেকে তালিকা করলে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড আছে প্রথম দিকে। মোদিজি! দয়া করে বলে যাবেন, এই ঘৃণা ছড়ানোর কাজটা আপনি বাংলায় কতটা তীব্রভাবে করতে চান? ঘৃণাভাষণের ঘটনা মাত্রা ছাড়াচ্ছে, তুঙ্গ স্পর্শ করেছে অগাস্ট থেকে নভেম্বরে, যখন রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ তেলঙ্গানা ছত্তীশগড়ে চলছে বিধানসভা নির্বাচন। আর এবার লোকসভার আগে বাংলায় (West Bengal) ওই পথেই তো আপনাকে হাঁটতে হবে, তাই না? ভোটের আবহে জনমোহিনী মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আর সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ, এই দুয়েতেই তো আপনার গভীর আস্থা, তাই না? লোকসভা নির্বাচনের দামামা বাজলেই, রামমন্দির প্রতিষ্ঠা আর জ্ঞানবাপী মসজিদের ‘পুনরাধিকার’-এর গৌরবভাষ্যে সংখ্যালঘুদের স্থানটি বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটিও পূর্ণোদ্যমে শুরু করতেই হবে, তাই না?
বাংলায় এসেছেন যখন, তখন এই প্রশ্নগুলোর উত্তরগুলো দিয়ে যাবেন, প্লিজ।
‘আয়ে হো তো বতা কে যাও’।