“রাজা মারে ছলে বলে/প্রজা ভাসে চোখের জলে।” এমনটাই চলছিল। তার পর এই সেদিন, হঠাৎ তাল কাটল। পঞ্চনদীর তীরে একেবারে আক্ষরিক অর্থে আটকা পড়লেন তিনি। এ কিসের ইঙ্গিত, লিখছেন মইনুল হাসান
অবশেষে পাঞ্জাবে গিয়ে তাল সামলাতে পারলেন না মোদিজি। মনে করেছিলেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু বড় দেরি করে ফেলেছেন। সারা বিশ্ব জেনে গেল। নির্বাচনের আগে এটা ছিল তাঁর প্রথম পাঞ্জাব সফর। কিছু সরকারি কাজ আছে। বিশেষ করে শিলান্যাস অথবা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। শেষকালে ভাতিন্ডায় পার্টির ডাকে জনসভা। সেখানে মানুষজন বসার জন্য ৭০ হাজার চেয়ার লাগানো হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন-করোনা আক্রান্তদের চাঙ্গা করতে নয়া উদ্যোগ হ্যালো, মহকুমাশাসক বলছি
এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। বাদ সাধল প্রকৃতি ও মানুষ। বিমানবন্দরে নেমে হেলিকপ্টারের অকুস্থলে যাবেন ঠিক ছিল। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি বিশেষ বিমান নামল বিমানবন্দরে। তখন বৃষ্টি। কপ্টার ওড়া সম্ভব নয়। ২০ মিনিট অপেক্ষা করে ঠিক করলেন রাস্তা দিয়ে যাবেন। পাঞ্জাব রাজ্য সরকারকে জানানো হল সামান্য সময়ের ব্যবধানে। সঙ্গে লোকলস্করের কোনও অভাব নেই। রওনা দিলেন ভাতিন্ডার উদ্দেশে। দু’ঘণ্টার পথ। এক উড়ালপুলে আটকে গেল। সামনে গাড়ির লম্বা লাইন। কারণ, কাছাকাছি কোথাও নাকি কৃষকরা অবস্থান করছেন। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা অন্য রাস্তায় যেতে বললেও প্রধানমন্ত্রী রাজি হলেন না। মুখ গোমড়া করে ২০ মিনিট দম ধরে বসে থেকে দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার পথ ধরলেন। আসার সময় দেখলেন নাটক কোনওমতেই জমে উঠল না। তাই, নাট্যরস জমাতে সাংবাদিকদের বলে এলেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারছেন এটাই যথেষ্ট… মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।” কথাটির অর্থ কী, কিসের ইঙ্গিত, সেকথা সবাই জানেন।
আরও পড়ুন-পড়ুয়াবন্ধু পুলিশের অভিনব ‘কৌশিশ’ নিখরচায় পরীক্ষা প্রস্তুতি–তালিম
গাড়ি। জুতো। কলম। এসব নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুব চিন্তাভাবনা করেন। পকেটে সব সময় মঁ ব্লঁ-র কলম দেখা যায়। কয়েক লক্ষ টাকা তার দাম। ডঃ মনমোহন সিংকে দেখতাম ১০ টাকার একটা ডটপেন পকেটে রাখতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকাশ্যেই দেখা যায় সই করার বা কিছু লিখবার দরকার হলে পাশের জনের কাছে কলম চাইছেন। পোশাক-আশাক নিয়ে তো নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কারও তুলনা হবে না। তাঁর পোশাকের ডিজাইন করার জন্য যে কোম্পানিকে নিয়োগ করা হয়েছে তাদের বাৎসরিক ফি নাকি ১৯ কোটি টাকা। আমাদের এমন রসেবশে থাকা প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলেন কেন?
তাঁর নিরাপত্তার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বিশেষ বিমান কেনা হয়েছে। সে বিমান আমেরিকার রাষ্ট্রপতির বিমানকে হার মানাচ্ছে। ১২ কোটি টাকা দিয়ে মার্সিডিজ বেঞ্জ মে ব্যাক গাড়ি কেনা হয়েছে। ২টির দাম ২৪ কোটি। সে গাড়িতে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র কার্যকরী নয়। তাহলে এত ভয় কেন? কাকে ভয়? নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি’র প্রতি দেশের মানুষের আস্থা যে অতিদ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, সেটা কি তবে ওঁরা বুঝতে পারছেন! কৃষকদের আন্দোলনে তাদের বিজয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে সেটা বিশ্ববাসী জেনে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী তাই আজ দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
আরও পড়ুন-ফোন করলেই বাড়িতে হাজির হবেন স্বাস্থ্যকর্মী
বলা হচ্ছে, ভাতিন্ডা যাবার পথে তাঁর গাড়ি আটকানো হয়। মূর্খেও এ কথা বিশ্বাস করবে না। কারণ, কৃষকরা ছিলেন না সেখানে। তাঁরা উড়ালপুলের ধারে কাছে নেই। উড়ালপুল থেকে বহুদূরে কৃষকদের অবস্থান চলছিল। কৃষক আন্দোলনের এক বছরে কম করে ৭০০ কৃষক শহিদ হয়েছেন। তাঁদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য অন্নদাতারা ধরনায় বসেছেন। পাঞ্জাব রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১৫০ শহিদ পরিবারের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু সংসদে মোদির সরকার লিখিতভাবে জানিয়েছে— কোনও কৃষকের মৃত্যু হয়েছে, এমন কোনও খবরই তাদের কাছে নেই। অর্থহীন এই তঞ্চকতা দেশবাসী আর সহ্য করতে রাজি নয়, সেটা ক্রমেই বুঝতে শুরু করেছেন নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং তিনি নিজে। উড়ালপুলের উপর কৃষকরা যে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছেন তা তো প্রধানমন্ত্রীর গোয়েন্দা প্রধানরা জানেন। আর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটা জানা তাঁদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। তবে কি, সেখানেও গন্ডগোল? তারই তদন্ত হোক আগে। অযথা পাঞ্জাব রাজ্য সরকারকে দোষ না দিয়ে।
আরও পড়ুন-সোমবার থেকে পঞ্চায়েত দফতরের উদ্যোগে করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে পৌঁছবে রান্না করা পুষ্টিকর খাবার
আর একটা কথাও বাতাসে ভাসছে। ভাতিন্ডার জনসভায় লোকজন মোটেও হয়নি। প্রচুর বাসের ব্যবস্থা করে রাজস্থান থেকে কিছু মানুষ নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে কাজ হয়নি। স্থানীয় কৃষকরা নরেন্দ্র মোদির সভাতে যেতে রাজি হয়নি। ডেকরেটরদের লোকজন, স্থানীয় বিজেপি নেতাদের ধরে মাথাগুলো গুনলে সর্বসাকুল্যে ২০০ মানুষ। চেয়ার ৭০ হাজার। এমন সংবাদ শোনার পর প্রধানমন্ত্রীজি আর কোনও ঝুঁকি নেননি। সোজাসুজি পিঠটান দেবার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে ফেলেন। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, এত কিছুর পর যদি ফাঁকা সভায় ভাষণ দিতে দেশবাসী দেখেন তাহলে তো দফারফা।
প্রধানমন্ত্রীজি! আপনি হেরে গেছেন। আপনি হেরেছেন দিল্লির কাছে সিংঘু সীমান্তে। আপনি হেরেছেন ভাতিন্ডা যাওয়ার পথে উড়ালপুলে। আপনি গো হারান হেরেছেন পশ্চিমবাংলায়। আপনি মুখে যতই বাঘ-সিংহ মারুন না কেন, আপনি হেরে গেছেন। হেরেছেন এদেশের কোটি কোটি কৃষকের কাছে, কোটি যুবকের কাছে, কোটি কোটি ভারতবাসীর কাছে। তাই আপনার সাজানো নাটক আর কাজে লাগছে না। মানুষ জেনে গিয়েছে সব সংলাপ। আপনার মুখে পরাজয়ের বলিরেখা স্পষ্ট। সারাদেশ নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষা করছে। সাধারণ মানুষের হৃদয় থেকে সেই নেত্রী উঠে আসবেন। আমরা তাঁরই অপেক্ষায়।