গোবলীয় বিজেপি নেতাদের এই এক সমস্যা। এরা চায় গোটা দেশটা এক্কেবারে তাদের মতোন করে চলবে। যেমন বিজেপির ঘোষিত নীতি ‘এক দেশ, এক আইন, এক নেতা, এক দল, এক ভাষা’ আগে থেকে ছিলই এবার সংযোজিত হয়েছে ‘এক খাবার’। বহুত্ববাদে বিশ্বাসী এই উপমহাদেশে যা এক প্রকার অসম্ভব। উত্তর ভারত বা পশ্চিম ভারতে এক শ্রেণির ভারতীয় আছেন, যাঁরা কড়াভাবে নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন-বড়দিনের আগে ফুটপাথ মুক্ত করতে বড় পদক্ষেপ পুরসভার
এতে অসুবিধার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভগবত বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহরা এই তালিকাভুক্ত। তাঁরা নিরামিষ খেতেই পারেন, এটা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। কিন্তু তাই বলে, যে দেশে ৭০%-এর ওপরে নাগরিক আমিষ খাবার খায় তাদের ওপর জোর করে নিরামিষ চাপিয়ে দেওয়াটা শুধু অসাংবিধানিকই নয় অনৈতিকও বটে! এই নিরামিষ ফতোয়া নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি প্রচার চালাচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে নয়া মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব শপথ নিয়েই মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে মধ্যপ্রদেশে কোথাও প্রকাশ্যে মাছ/মাংস বা ডিম বিক্রি করা যাবে না! গত ১৫ ডিসেম্বর উজ্জ্বয়িনীতে আমিষ খাবারের দোকান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে মধ্যপ্রদেশ সরকার। স্বাভাবিকভাবেই প্রাথমিক প্রশ্ন উঠবে, এত বছর ধরে মাছ-মাংস-ডিম অথবা রাস্তার ধারে আমিষ খাবারের স্টল দেওয়া মানুষগুলোর আগামী দিন কী হবে? তাদের এত বছরের জীবিকার কী বিকল্প কর্মসংস্থান করবে বিজেপি সরকার?
আরও পড়ুন-রাজ্যে ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডারের হাল ফেরাতে নতুন প্রকল্প, জানুয়ারি মাস থেকেই শুরু সমীক্ষা
দ্বিতীয় প্রশ্নটা উঠবে, পুষ্টি নিয়ে! যে দেশে শিশুদের পুষ্টির হার আফ্রিকার পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সমতুল্য! যেখানে গর্ভবতী মহিলাদের পুষ্টির হার অত্যন্ত কম সেখানে গরিব মানুষের জন্য সস্তায় পুষ্টির জন্য ডিম বা মুরগির মাংসটাই সহায়। সেটাকেও যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়, গরিব মানুষ কোথা থেকে পাবে তাদের ন্যূনতম পুষ্টিকর খাবার, সেটা ভাবার সময় নেই বিজেপি নেতাদের। কারণ প্রধানমন্ত্রীর জন্য তো জুটে যায় দামি মাশরুম। কিন্তু এদেশেরই গরিব মানুষগুলোর শরীরে প্রোটিনের চাহিদা মেটায় ডিম, মুরগির মাংস বা মাছ! এমনকী বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে স্কুলের ‘মিড-ডে’ মিলেও নিরামিষ আহার দেওয়ার নির্দেশ জারি হচ্ছে। আসলে উত্তর ভারতের বিজেপি নেতারা এটা ভেবেই নেয়, যে আমিষ খাচ্ছে মানেই সে ‘সেহি হিন্দু’ না! গোবলীয় হিন্দুত্ববাদীদের মতে, ‘সেহি হিন্দু’ কখনও আমিষ খেতে পারে না। তাকে হতে হবে ‘শুদ্ধ শাকাহারি’! জানতে ইচ্ছে করে, মোহন যাদবদের মতো ‘সেহি হিন্দুরা’ আদৌ কোনওদিন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, বামচরণ চট্টোপাধ্যায় তথা বামাক্ষ্যাপার নাম শুনেছে কিনা! নাকি এই মোহন যাদব, যোগী আদিত্যনাথরা বামদেব বা রামকৃষ্ণদেবের চেয়েও বড় হিন্দু? এই প্রবণতার পিছনে আসলে এই সুগভীর চক্রান্ত আছে। যে চক্রান্তের অংশ হিসেবেই বাংলার বাইরে বিশেষত গোবলয়ে গেলে, বাঙালিকে ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়! গোবলয় বা উত্তর ভারতের একাংশের একটি ধারণা আছে, যে, মুসলমানরাই মূলত আমিষ খায়! বিজেপি এবং তাদের কুখ্যাত আইটি সেল মূলত এই ধরনের অদ্ভুত যুক্তি বাজারে ছড়ায়! এবার একটা তথ্য দেওয়া যাক। একটি বেসরকারি সংস্থার করা সমীক্ষা অনুযায়ী, যে রাজ্য নিয়ে কথা হচ্ছে অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশেই আমিষভোজীর সংখ্যা ৫১%। গোবলয়ের অন্যতম বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও আমিষভোজীর সংখ্যা প্রায় ৫৫%। মহারাষ্ট্রে ৫৯%। এই রাজ্যগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যার হার নিশ্চয়ই এত নয়। বিজেপি বোঝাতে চায় সংখ্যালঘুরা আমিষ খায় তা ভিত্তিহীন।
আরও পড়ুন-টেট মামলায় নতুন মোড়
বস্তুত ভারতবর্ষের মতো একটি বহুমাত্রিক দেশে খাবারের বৈচিত্র এত রকমের যে এখানে বিদেশি খাবারও ভারতবর্ষের মাটিতে এসে নিজের মতো স্বাদে আহ্লাদে হয়ে যায়। নইলে মোগল খানা বিরিয়ানিতে বা চিন দেশের খাবার চাউমিনেও যে আলুর ব্যবহার হতে পারে, তা বোধহয় এই খাবারগুলো আদি স্রষ্টারা কল্পনাতেও আনেননি। কিন্তু এই ভারতবর্ষে এসে এভাবেই পর্তুগিজ থেকে ইটালিয়ান বা মোগলাই খানা ভারতবাসীর জিভের স্বাদ কোরকে আষ্টেপৃষ্টে লেগে গেছে। বিজেপি এই বহুমাত্রিকতাকেই বারবার ধ্বংস করতে চায়! এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে যেমন গুজরাতে সম্প্রতি প্রত্যেকটি বাঙালি দুর্গাপুজো কমিটিকে নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, যেহেতু নবরাত্রি চলবে, তাই কোনওভাবেই দুর্গাপুজোর ভোগে আমিষ না দেওয়া হয়। বাংলার বাইরে বিভিন্ন দুর্গাপুজো কমিটিগুলোকে এমনই নানা রকম নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন সুরাটের একটি বাঙালি দুর্গাপুজো কমিটিকে লিখিত ভাবে জানাতে হয়, পুজো প্রাঙ্গণে আমিষ খাবারের স্টল থাকবে না! তবেই মিলবে পুজোর অনুমতি! অথচ কয়েকশো বছর ধরে বাংলার বহু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোয় পুজোই সম্পন্ন হয় না, যতক্ষণ না মা’কে আমিষ ভোগ দেওয়া হচ্ছে! যদিও আমিষ ভোগ গ্রহণ করা বাংলার মা দুর্গা বা মা কালী হয়তো অমিত শাহ বা যোগী আদিত্যনাথদের কাছে, ‘সেহি হিন্দু দেবী’ বলেও পরিগণিত হবেন না! আসলে, একটা রাজনৈতিক দল যখন স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে গোটা দেশকে শাসন করে, তখন ভুলে যায় সেই দেশের হাজারো লৌকিক সংস্কৃতি৷ মধ্যপ্রদেশে আজ যেভাবে মাছ, মাংস, ডিমের দোকানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, এমনভাবে যদি কখনও নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা বাংলাতেও আমিষ খাবারের দোকানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তা হলে কী হতে পারে, ভেবেই শিউরে উঠতে হয়!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
আসলে ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যের নিজ নিজ খাদ্যাভাস আছে, সেই সব কিছুকে কেড়ে নিয়ে সবার প্লেটে ধোকলা, উপমা সাজিয়ে দিলেই মুশকিল। গান্ধীজি নিরামিষাশী ছিলেন। তাঁকে একবার কেউ একজন প্রশ্ন করেন, ‘আপনি তো নিরামিষাশী কিন্তু বাঙালিরা তো মাছ খায়, এটা নিয়ে কী বলবেন?” উত্তরে গান্ধী বলেছিলেন, ‘খাওয়াটাই তো উচিত। বাংলা নদীমাতৃক রাজ্য। ওখানে মাছ সস্তা। নিজেদের পুষ্টির জন্যই ওরা মাছ খায়। এতে কোনও অন্যায় নেই!” সেই সময়ে দাঁড়িয়ে খাদ্যের সঙ্গে অর্থ, জীবিকা এবং পুষ্টির যে সম্পর্ক সেটা বুঝেছিলেন বলেই তিনি ছিলেন মহাত্মা। আর আজ গডসের ভাবশিষ্যরা মানুষের পাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে স্রেফ নিজেদের পছন্দমতো খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে।