নরেন্দ্র মোদি যতই তদন্ত কমিটির ন্যাকামি করুন, যতই কুযুক্তির আবডাল খুঁজুন, শাক দিয়ে মাছ যেমন ঢাকা যায় না, তেমনই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, শয়ে শয়ে মানুষ যে করমণ্ডল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন, তার জন্য দায়ী মোদি সরকার।
এই সরকার বন্দে ভারতের চমক দিতে পারে, কিন্তু যাত্রীদের সুরক্ষা দিতে পারে না।
এই সরকারের ঔদাসীন্য এতগুলো নিরীহ মানুষকে প্রাণে মেরে রেললাইনে ফেলে রাখল, আর এখন জনগণকে ভাঁওতা দেওয়ার জন্য তদন্তের, দোষীদের রেয়াত না করার বুকনি দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-প্রখর তাপে পর্যটকশূন্য শুনশান অযোধ্যা পাহাড়
এই সরকার অপদার্থ। তাই, শুধু রেলমন্ত্রী নন, এই সরকারের প্রধান, প্রধানমন্ত্রীরও পদত্যাগ চাইছি আমরা।
একটা খবরের কথা মনে করলেই এই দাবির যৌক্তিকতা স্পষ্ট হবে।
রেলমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী, দু’জনেই আমাদের মিথ্যে বলেছেন। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব অ্যান্টি কলিসন ডিভাইস (Anti Collision Device) নিয়ে একাধিক তথ্য মানুষের সমানে তুলে ধরেছেন। বারবার এ নিয়ে প্রচার করা হয়েছে। এমনকী কয়েকমাস আগে রেলমন্ত্রী দুটি ট্রেনের মডেল নিয়ে ডেমো দেখিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও কম যান না। পরবর্তীকালে তিনিই এর নাম দিয়েছিলেন ‘কবচ’। গত বছর মার্চ মাসে অশ্বিনী বৈষ্ণব সাউথ সেন্ট্রাল রেলের সেকেন্দ্রাবাদ ডিভিশনের লিঙ্গামপল্লি-ভিকারাবাদ বিভাগে গুল্লাগুদা-চিটগিড্ডা রেল স্টেশনের মধ্যে ‘কবচ’ পদ্ধতির কাজ নিজে পরিদর্শন করেছেন, এমন খবরও সামনে এসেছিল। বলা হয়েছিল, লুপ লাইনে প্রবেশ করলে ‘কবচ’ পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেল ইঞ্জিনের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে কমিয়ে ৩০ কিলোমিটার করে দেবে। জানা গিয়েছিল, আত্মনির্ভর ভারতের অঙ্গ হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে নিরাপত্তা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ২ হাজার কিলোমিটার রেল নেটওয়ার্ককে এই ‘কবচ’–এর আওতায় নিয়ে আসা হবে।
কবচ থাকলে, অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস থাকলে কখনও প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণ যায়? যেতে পারে?
মনে করা দরকার, এই অ্যান্টি কলিসন ডিভাইসের কথা প্রথম বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যখন তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন।
আরও পড়ুন-জগন্নাথ মহাপ্রভুর স্নানযাত্রা শিল্পনগরী দুর্গাপুরে, রেল দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য পুজােপাঠ
আর এখন?
ক্যাগ রিপোর্টে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় রেলকে ১ লক্ষ কোটি টাকা দিয়েছিল সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। রেললাইন সংস্কার, রেলওয়ে ক্রসিং নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, আন্ডারপাস নির্মাণ, আরও বেশি রোলিং স্টক উৎপাদন অর্থাৎ কোচ, ইঞ্জিন, ওয়াগন তৈরি করা ছিল লক্ষ্য। ২০১৭ সালের বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ নামে একটি তহবিলে ১ লক্ষ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। ওই টাকায় আগামী পাঁচ বছর শুধুই রেলের সুরক্ষা সংক্রান্ত কাজ হবে। অর্থাৎ ২০২২ সালের মধ্যে এই কাজ হওয়ার কথা ছিল।
আরও পড়ুন-হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজে বাড়ছে আসন
ওই রিপোর্ট বলছে, ২০১৭-১৮ তে সুরক্ষা কোষে বরাদ্দ হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। আদতে সে বছর ওই খাতে কোনও অর্থ ব্যয়িত হয়নি। পরের বছর ওই খাতে ফের বরাদ্দ করা হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। সে বছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে ওই খাতে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩,০২৪ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ তে সেই একই বরাদ্দ। ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃত ব্যয় ২০১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ এও ৫ হাজার কোটি বরাদ্দের কথা বলা হল। কিন্তু আসল খরচ হল মোটে ১ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে যেখানে ২০১৭ থেকে ২০২১ এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা, স্রেফ রেল সুরক্ষা খাতে, সেখানে আসল ব্যয় হল মোটে ৪,২২৫ কোটি টাকা। তহবিলের অর্থ রেল সুরক্ষার জন্য সামান্যই ব্যয় করা হচ্ছে। এটাই বাস্তব। আর তার মাশুল গুনতে হল নিরীহ রেলযাত্রীদের।
আরও পড়ুন-বন্দে ভারতের কৃতিত্ব নিলে ট্রেন দুর্ঘটনার দায় নিন প্রধানমন্ত্রী, তোপ অভিষেকের
সংসদে পেশ হওয়া অন্য একটি ক্যাগ রিপোর্টে জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিকালে দেশে যত ট্রেন বেলাইন হয়েছে, তার অধিকাংশই রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ২০১৭ থেকে চার বছরে মোট লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩৯২টি। ১৬৭টি ক্ষেত্রেই প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে উঠে এসেছে ‘মেনটেনেন্স অব ট্র্যাক’। ১৪৪টি ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়েছে ‘ব্যাড ড্রাইভিং/ওভার স্পিডিং’কে। রেলসুরক্ষার অন্যতম প্রধান শর্ত হল, বেশি করে ডবল লাইন পাতা। গত বছরের বাজেটে ডবল লাইন নির্মাণের জন্য ধার্য হয়েছিল ৪২ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। অথচ এই বছর বাজেটে সেই খাতে বরাদ্দ এক ধাক্কায় ১২ হাজার কোটি টাকা কমে গেল।
এখানেই শেষ নয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বুলেট ট্রেন ১ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প। ৩২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েই গিয়েছে। অথচ কবচ লাগানো হয়নি দেশের সিংহভাগ ট্রেনে। গালভরা ঘোষণা হয়, সেমি হাইস্পিড ট্রেন নাকি ১৫০ কিলোমিটার বেগে চলবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রেন গড়ে ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটারের বেশি বেগে যায় না। কারণ, হাইস্পিডের উপযোগী করে তোলার জন্য রেলপথের সংস্কারই করা হয়নি। বন্দে ভারত নাকি চলবে লিকুইড হাইড্রোজেন জ্বালানিতে। ১৮টি বন্দে ভারত চলছে। আগামী দিনে ৪০০ করার প্রতিশ্রুতি। অথচ এই বছর লিক্যুইড হাইড্রোজেনে বন্দে ভারত চালাতে বাজেট বরাদ্দ মাত্র ১০ লক্ষ টাকা।
আর কত মিথ্যে বলবেন মোদিজি? মানুষের মৃত্যু নিয়ে আর কত ছিনিমিনি খেলতে চান আপনি?