সুকুমার রুজ : ‘‘একদিন হয়তো কলকাতায় বরফ পড়বে। একদিন হয়তো ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান মিলেমিশে একটা দেশ হবে। একদিন হয়তো চাঁদে মানুষ হানিমুন করতে যাবে। তোমার গবেষণায় তুমি তা বলেছ। কিন্তু এই ‘হয়তো’ দিয়ে তো সমাজ-সংসার চলে না! বাস্তবটাকে উপেক্ষা করা যায় না।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর দিনেশ স্যার কেমন চুপচাপ হয়ে যান। কোনও শব্দ না করে চিনিছাড়া লিকার চায়ে চুমুক দেন। আমি এর উত্তরে কী বলব, ভেবে পাই না। হাতে ধরা চিঠিখানা ভাঁজ করি, আবার খুলি। দিনেশ স্যার চা শেষ করে কাপ নামিয়ে রেখে বলেন— তুমি ‘ব্রহ্মাণ্ড’ কথাটা শুনেছ তো?
আরও পড়ুন-এক শৈল্পিক ছন্দের প্রতীক হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমি কিছুটা অবাক হয়ে মুখ তুলি। দশবছর ধরে আমি দিনেশ স্যারের ছাত্র। ওঁর তত্ত্বাবধানে চাঁদের অপটিমাম টেম্পারেচার নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি পেয়েছি। এখন তো কলেজে আমারই ত্রিশজন ছাত্র। সেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ব্রহ্মাণ্ড’ কথাটা শুনেছি কিনা! আমি কিছু না বলে সরাসরি ওঁর চোখের দিকে তাকাই।
উনি বলেন— ‘ইউনিভার্স’ জানো। আমি ‘ব্রহ্মাণ্ড’ এই বাংলা শব্দটার কথা বলছি। এ কথাটার সমাস করলে দাঁড়ায়, ব্রহ্মের অণ্ড, ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। ‘অণ্ড’ মানে ডিম। তাহলে কী দাঁড়াল, ‘ব্রহ্মের ডিম’। তাহলে ব্রহ্ম নিশ্চয়ই নারী। পুরুষ তো আর ডিম পাড়ে না!
আমি ফিক করে হেসে ফেলি। উনি বলেন — না না, এটা হাসির কথা নয়। তুমি বলো, ব্রহ্ম ডিম পেড়েছে এবং সেই ডিমের ভেতরে এত ছায়াপথ, নক্ষত্রমণ্ডল, গ্রহ-উপগ্রহ। তাহলে সেই ডিম নিষ্ক্রান্ত হওয়ার দ্বার বা ছিদ্রটার মাপ তুমি অনুমান করতে পারছ!
আরও পড়ুন-গুরুনানক দিবস
আমি দিনেশ স্যারের কথার কোনও ধরতাই পাই না। উনি কী বলতে চাইছেন, বুঝতেই পারছি না। বিষয়টা হলো ‘নাসা’ থেকে আসা এই চিঠিখানা। চিঠিতে লেখা আছে, ‘‘আপনার ‘চাঁদের অপ্টিমাম টেম্পারেচার’ বিষয়ক গবেষণাপত্রটা আমরা পুস্তক আকারে প্রকাশ করতে আগ্রহী। আমেরিকা ও ভারতের যে সমস্ত কলেজে ‘চন্দ্রবিজ্ঞান’ পড়ানো হয়, সেই কলেজগুলিতে দশ কপি করে বিনামূল্যে ওই পুস্তকটি বিতরণ করা হবে। আপনার অনুমোদন প্রার্থনা করি। কিন্তু যেহেতু বিনামূল্যে পুস্তকটি বিতরণ করা হবে, সেইহেতু আমরা আপনাকে পুস্তক প্রকাশ বাবদ কোন সম্মানী দিতে অপারগ। তবে কৃতজ্ঞতা ও উপহার স্বরূপ আপনাকে আমাদের ‘স্পেস সিটি’-তে একবার নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি যদি এ প্রস্তাবে রাজি হন, তাহলে তিনমাস সময় হাতে নিয়ে আমাদের গবেষণা কেন্দ্রে চলে আসুন! এখানে ফিজিক্যাল ফিটনেসের টেস্টগুলো করিয়ে নেওয়া হবে। ‘ফিট সার্টিফিকেট’ পাওয়ার এক সপ্তাহ পরেই ‘স্পেস সিটি’-তে রওনা। এতে হয়তো আপনার গবেষণা কাজের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।”
আরও পড়ুন-আধুনিক পরিকাঠামোর মোড়কে সেজে উঠছে পেটুয়াঘাট, গভীরতম মৎস্যবন্দরে গতি আনছে রাজ্য
চিঠিটা হাতে পেয়ে আমি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তাই দিনেশ স্যারের শরণ নিয়েছি। উনি চিঠিখানা আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন — ইটস আ গোল্ডেন অপারচুনিটি। অ্যাকসেপ্ট ইট।
তখন আমি বললাম— স্যার! কলেজ থেকে তিনমাসের ছুটি পাওয়া তো মুশকিল! হয়তো প্রিন্সিপ্যালকে ধরাধরি করে ছুটি পেলাম, কিন্তু মহাকাশে যাওয়ার জন্য যদি ফিজিক্যালি আনফিট হই! তাহলে…!
স্যার তখন ওই কথাটা বললেন। প্রথম কথাটা যদিও বা বুঝলাম, কিন্তু ব্রহ্ম পুরুষ নয় নারী, কিংবা তার জননদ্বারের বিশালতা, এসব কথার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। কিংবা বলা ভাল, বুঝে উঠতে পারছি না।
আরও পড়ুন-আজ ফিরহাদের সভা ঘিরে প্রস্তুত জঙ্গিপুর
স্যার বলে ওঠেন— কিছু বুঝলে না তো? শোনো! ‘হয়তো’, ‘যদি’, ‘নতুবা’ এ শব্দগুলো কনফিউজ করা ছাড়া আর কিছু করে না। আর সায়েন্সে কনফিউশনের কোনও গুরুত্ব নেই। সবটাই পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। তাই ওসব ‘হয়তো’, ‘যদি’-র চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও। এরকম গোল্ডেন অপারচুনিটি সবসময় আসে না। এটাকে গ্ল্যাডলি অ্যাকসেপ্ট করো!
আমি সম্মতিসূচক ঘাড় হেলাই। স্যার বলে চলেন— ভাবো, তুমি আছো তো একটা ডিমের ভেতরে। ডিমের বাইরেটা কেমন, তা কল্পনাতেও আনতে পারো না। ডিমের ভেতরটা অন্তত ভাল করে দেখ! তুমি চাঁদে না গিয়েও চাঁদের তাপমাত্রা সম্পর্কে বহু কিছু গবেষণা করলে। সবই এই পৃথিবীর ল্যাবে বসে আর অঙ্ক কষে। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে একবার পৃথিবীটাকে দেখ! সেটা গোলাকার না ডিম্বাকার, সবুজ না নীল!
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠি— আমি যাব স্যার! আজই আমি কনসেন্ট লেটার মেইল করে দিচ্ছি।
আরও পড়ুন-প্রিয় মাঠ অ্যাডিলেড, পছন্দের খাবার গাজরের হালুয়া, জন্মদিনে সোজাসুজি বিরাট
হ্যাঁ যাবে তো অবশ্যই! জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে বত্রিশ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সির ছবি দেখে আহ্লাদে আটখানা হলে তো চলবে না বাপ! স্পেস সিটিতে গিয়ে একবার জেমস ওয়েবের ঠাকুরদাদা হাবল টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখে এসো মহাকাশটাকে। তাহলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে থাকতে পারবে যে, কলেজে তোমার সহকর্মীটি লেকচারার থেকে হঠাৎ প্রফেসর হয়ে গেল। কিংবা তোমার চেয়ে জুনিয়র লেকচারার সারাবছর ধরে ছাত্র পড়িয়ে, মাত্র তিনদিন কোর্স ওয়ার্ক-এ অ্যাটেন্ড করে, রিসার্চ পেপারের সিক্সটি পারসেন্ট অন্যের নকল করে দু’বছরে পিএইচডি পেয়ে গেল। এসব মাথা থেকে চলে যাবে। সে বিশালতার মাঝে এগুলোকে তখন নিতান্তই তুচ্ছ মনে হবে। তবে একটাই কথা— ব্রহ্ম কিন্তু নারী, এটা ভুললে চলবে না। তাঁর অণ্ড নিয়ে তুমি যত খুশি গবেষণা কর। কিন্তু অণ্ড নিষ্ক্রমণ দ্বারের সন্ধান মোটেও কোরো না! তা করতে গেলে তোমাকে অণ্ডের বাইরে বেরোতেই হবে। যা মাত্র তেরো দশমিক আট বিলিয়ন বয়সি ব্রহ্মাণ্ডের মাত্র আড়াই মিলিয়ন বয়সি মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি এতক্ষণ স্যারের কথাগুলো সম্মোহিতের মতো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, স্যার কি কায়দা করে মহিলাদের থেকে দূরে থাকার কথা বলতে চাইছেন! স্যার আবার মুখ খোলেন— শোনো! অমাবস্যার রাতে বাড়ির ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে খালি আকাশ দেখলে চলবে না! তুমি মুরগির ডিম থেকে ছানা বের হওয়া দেখেছ?
আরও পড়ুন-হাইকোর্টে খারিজ শুভেন্দুর আর্জি
হঠাৎ স্যারের এ প্রশ্নে আমার চটকা ভাঙে। স্যারের এ প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ কী হতে পারে, বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু স্যার সময় না দিয়ে বলে ওঠেন— তুমি-আমি এখনও ডিমের ভেতরে থাকা মুরগির ছানা। আগে ডিমের বাইরে বেরোও, তারপর ডিমের উৎস সন্ধানে যাবে। যদি ডিম-ফোটা দেখে থাক, তাহলে জানবে, যখন ডিমের ভেতর ছানাটি পুষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, তখন সেই ছানাটিই ভেতর থেকে ঠোঁটে টোকা দিয়ে ডিমের খোলা ভেঙে ফেলে। মা-মুরগিকে খোলা ভাঙতে হয় না। তেমনি তুমি নিজেই খোলা ভাঙার চেষ্টা কর দেখ, পার কিনা!
আমি স্যারের কাছ থেকে এবার ওঠার প্ল্যান করছি। স্যার বলে ওঠেন— যাওয়ার আগে তোমার কাকিমার হাতে আর-এক কাপ লিকার খেয়ে যাও, এনার্জি পাবে। স্পেশ্যাল দার্জিলিং টি উইদাউট শুগার অ্যান্ড মিল্ক, হাঃ হাঃ হাঃ! (অঙ্কন : শংকর বসাক)