মোদিজিকে কোন রাজা ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন ?

সেঙ্গল, স্বর্ণদণ্ড, পুজোপাঠের পর স্থাপিত নতুন সংসদ ভবনে। যারা রোজ ইতিহাসের নাম করে পছন্দমতো গালগল্প গেলাচ্ছে আমাদের, তাদেরই উদ্যােগে এই সেঙ্গল প্রতিষ্ঠা। দেশটা কি তবে প্রজাতন্ত্রের পথ ছেড়ে রাজতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে? প্রশ্ন তুললেন সাংসদ ও ‘জাগোবাংলা’র সম্পাদক সুখেন্দুশেখর রায়

Must read

অমিত শাহ বলেছিলেন সেঙ্গল হল সেই স্বর্ণদণ্ড যেটি ভারতের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রতীক হিসেবে জওহরলাল নেহরুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
২৮ মে, ২০২৩, রবিবার নতুন সংসদ ভবনে সেই সেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করলেন নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)।
অমিত শাহ যা বলেছেন তার সপক্ষে কোনও প্রামাণ্য ঐতিহাসিক নথি নেই।
কিংবদন্তি অনুসারে স্বর্ণনির্মিত দণ্ড বা সেঙ্গল কোনও এক দেবতা কিংবা দেবী তামিলভূমির রাজার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যাতে রাজা ঈশ্বরের নামে শাসনকার্য পরিচালনার সময় প্রজাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারেন, ১৯৪৭-এর অগাস্ট মাসে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় মাউন্টব্যাটেন নেহরুকে জিজ্ঞেস করেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় কোনও পুজোপাঠ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রীতি রেওয়াজ ভারতে আছে কি না। নেহরু সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর দিকে তাকান। রাজাজি তখন নাকি ওই দেবদত্ত সেঙ্গলের কথা মাউন্টব্যাটেনকে বলেন। তিনিই নাকি তামিলনাড়ু থেকে সেঙ্গল দিল্লিতে আনানোর ব্যবস্থা করেন। এবং মাউন্টব্যাটেন ব্রিটেনের হাত থেকে ভারতের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীকস্বরূপ সেঙ্গলটিকে নেহরুর হাতে তুলে দেন।
কোনও প্রামাণ্য ঐতিহাসিক নথি ছাড়াই এই হল অমিত শাহর গল্প। প্রকৃত সত্যের সঙ্গে এই গল্পের পার্থক্য আকাশ-পাতাল।
যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় তখন সেটি হয় গণপরিষদে গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে। গণপরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং গণপরিষদ সেটি গ্রহণ করে। ভারত স্বাধীনতা বিল, ১৯৪৭ অনুসারে এই প্রস্তাবটি উত্থাপিত ও গৃহীত হয়। ১৮ জুলাই ১৯৪৭-এ ব্রিটেনের রানি তাতে সম্মতি প্রদান করেন। ফলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। ঠিক তার পরেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং নেহরু মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করেন। তখনই মাউন্টব্যাটেনকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা হয়।
গণ পরিষদের কার্যাবলির নথি বলছে, এভাবেই ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরপর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের এই বিবরণ ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এর ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়। সেখানে সেঙ্গলের কোনও উল্লেখ নেই।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি ঘোষিত হওয়ার পর নেহরুর বিশ্রামকক্ষে একটি ছোটখাটো পুজোপাঠের আয়োজন করা হয়। সেটার পর জনৈক পুরোহিত নেহরুকে ‘উদ্দেশ্য সফল হোক’ বলে আশীর্বাদ করেন।
রাজাগোপালাচারীর নাতি ও নেহরুর জীবনীকার রাজমোহন গান্ধী থেকে শুরু করে নেহরুর রচনা সংগ্রহের সংকলক মাধবন পিল্লাই, সকলেই শাহর গল্প তাঁর স্বকপোলপ্রসূত এবং ঐতিহাসিকভাবে অসত্য বলে দাবি করেছেন।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন হল, তাহলে সেঙ্গল নামক স্বর্ণদণ্ডটিকে নয়া সংসদ ভবনে প্রতিষ্ঠা করার যৌক্তিকতা কোথায়?
সেঙ্গল সার্বভৌমত্ব-সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদের সঙ্গে যুক্ত। গণতান্ত্রিক ভারতে ওই ঐশ্বরিক তত্ত্ব বহুকাল ধরে বর্জ্য। মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দিরের তৈলচিত্র, রামনাথপুরমের সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত রামলিঙ্গ বিলাসম প্রাসাদের দেওয়াল চিত্র— এ-সবই রাজার ক্ষমতা প্রাপ্তিতে দৈবী সংযোগের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে কোনও দেবদেবীর হাত থেকে মাদুরাইয়ের রাজা কিংবা রামনাথপুরমের রাজা সেতুপতি রাজকীয় ক্ষমতা পাননি। ব্রহ্মণ পুরোহিত সার্বভৌম শক্তির প্রতীকস্বরূপ সেঙ্গল তাঁদের হাতে তুলে দিতেন, রাজ্যাভিষেকের সময়।
সুতরাং সেঙ্গল ব্রহ্মণ্য সংস্কার, রাজতন্ত্র ও রাজা ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা ভোগ করেন এই বিশ্বাসের প্রতীক, গণতন্ত্রের সঙ্গে তার লেশমাত্র যোগাযোগ নেই। সাম্যের ধারণা, সমানাধিকারের ধারণা, এবং জনগণই সর্বভৌম ক্ষমতার উৎস, এই বিশ্বাসের বিপ্রতীপে সেঙ্গলের অবস্থান, আর কী আশ্চর্য! সেই সেঙ্গল প্রতিষ্ঠিত হল গণতন্ত্রের মন্দির সংসদ ভবনে!
কোন যুক্তিতে?
এই প্রসঙ্গে আর একটা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা না বললেই নয়।
১৯৪৬-এ ত্রিবাঙ্কুর দেশীয় রাজ্য হিসাবে ভারতে যোগ দিতে অস্বীকার করে। ত্রিবাঙ্কুরের রাজার তরফে যুক্তি ছিল, তারা সর্বার্থে হিন্দু এবং যদি তারা ভারতের অংশে পরিণত হয় তবে সেটা হিন্দু দেবতা পদ্মনাভস্বামীর পক্ষে সম্মানহানিকর বিষয় হবে। কারণ তাদের রাজক্ষমতা দেবদত্ত, অর্থাৎ তারাও ঐশ্বরিক তত্ত্বকে ঢাল করে ভারতে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল। ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান স্যার সি পি রামস্বামী আইয়ার যখন পদ্মনাভস্বামীর অসম্মান ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় কথা বলছিলেন, তখন তার বিরোধিতা করে স্বয়ং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল জানতে চান, ‘‘তাই যদি হয় তবে আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন, কীভাবে ত্রিবাঙ্কুরের শাসকরা ভগবান পদ্মনাভস্বামীকে ব্রিটিশদের অধীনে রাখতে রাজি হয়েছিলেন?’’ ১৪ অগাস্ট, ১৯৯৮-তে সংসদে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের লগ্নে এই ঐতিহাসিক কাহিনির উল্লেখ করেছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন।
ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও রাজতন্ত্রের প্রতীক, রাজার সার্বভৌম শক্তি ভগবানের দেওয়া এই মতবাদের প্রকাশ যে সেঙ্গলে, সেটি কখনও গণতন্ত্রের মন্দির, সংসদীয় ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র সংসদ ভবনে জায়গা পেতে পারে না। এটা সংসদীয় ব্যবস্থার মৌলিক শর্তের বিরোধী।
আর এই সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরোধী প্রতীককে জায়গা করে দিতে কতই না আজগুবি গল্প ফাঁদলেন মোদি-শাহরা (Narendra Modi)।
ভাবলেও লজ্জা হয়।
আর, জানতে ইচ্ছা করে দুটো প্রশ্নের উত্তর।
(১) মোদি-শাহরা কী চাইছেন? রাজতন্ত্র না সাধারণতন্ত্র?
(২) মোদিবাবুকে (Narendra Modi) কোন দেবতা বা রাজা ক্ষমতা হস্তান্তর করল?
অবান্তর, অর্বাচীন, গোমূর্খদের গল্প অনেক শুনেছি। এবার সরাসরি এই দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছি।

আরও পড়ুন- সম্রাট নিরোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে তুলনা করে তোপ দাগলেন অভিষেক, বিরোধীহীন উদ্বোধনে ধিকৃত কেন্দ্র

Latest article