সারদামণি স্বরূপত কী? তিনি কি ‘ফেমিনিস্ট’ বা নারীবাদী ছিলেন? নাহ! কোনওদিন গলার শির উঁচিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, এমন কোনও দৃষ্টান্ত ইতিহাস লিখে রাখেনি।
তাই বলে তিনি কদাচ প্রতিবাদ করেননি, এমনটাও নয়।
মহাভারতে আছে, “মৃদুনা দারুণং হন্তি মৃদুনা হন্ত্যদারুণম্। নাসেব্যং মৃদুনা কিঞ্চিৎ তস্মাৎ তীক্ষ্ণতরং মৃদুঃ।।” অর্থাৎ, মৃদুতার দ্বারা কঠোরকে জয় করা যায়, মৃদুতার দ্বারা অকঠোরও জিত হয়, মৃদুতা দ্বারা অভিভূত হয় না, এমন কিছুই নেই। সুতরাং মৃদুতা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ অস্ত্র।
আরও পড়ুন-বড়দিনের বাঙালি গিন্নিরা
সারদামণির জন্মশতবার্ষিকীতে কোয়েম্বাটোর রামকৃষ্ণ মিশনে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন ভারতের তদানীন্তন উপরাষ্ট্রপতি (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। তিনি তাঁর ভাষণে মহাভারতের এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছিলেন। সারদাদেবীর স্বরূপ বোঝাবার জন্য।
নিঃসন্দেহে সারদামণি প্রকৃত অর্থে উল্লিখিত শ্লোকটির মূর্ত রূপ। মৃদুতাকেই হাতিয়ার করে নীরবে লড়াই করেছেন। এবং বিজয়িনী হয়েছেন। কিন্তু তার পরেও ঔদ্ধত্যকে কাছে ঘেঁষতে দেননি। মৃদুতাকেই আঁকড়ে থেকেছেন। মূক ছিলেন না, আবার কর্কশভাবে মুখরও ছিলেন না কোনওদিন।
আরও পড়ুন-নামী আইটি সংস্থায় ৮ তলা থেকে ছিড়ে পড়ল লিফট, আহত ৯
সারদামণির লেখাপড়ায় ঝোঁক ছিল। নিজের বাপের বাড়িতে কখনও বাধা পাননি। ভাই প্রসন্ন, তুতোভাই রামনাথ পাঠশালায় যেত। ওদের সঙ্গেই কখনওসখনও পাঠশালায় যাওয়ার সুযোগ হত। নিজেই বলেছেন, ‘তাতেই একটু শিখেছিলুম’। কিন্তু বিয়ের পর ছবিটা বদলাল। জয়রামবাটির মেয়ে কামারপুকুরে এলেন বউ হয়ে। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মেজ দাদা রামেশ্বরের মেয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে একটু একটু ‘বর্ণপরিচয়’ পড়তেন। শ্বশুরবাড়ির মেয়ে লক্ষ্মীর যে স্বাধীনতা ছিল, বালিকাবধূর যে তা ছিল না, সেটা টের পেলেন হৃদয়ের আচরণে। হৃদয় শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগনে। তিনি সারদার হাত থেকে ‘বর্ণপরিচয়’ কেড়ে নিলেন। বললেন, “মেয়েমানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই। শেষে কি নাটক-নভেল পড়বে?”
আরও পড়ুন-প্রজাতন্ত্র দিবসে কন্যাশ্রীর ট্যাবলো, এবারের অতিথি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট
সেই নিগ্রহের অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে নিজের মুখে শুনিয়েছেন সারদা। চড়া গলায় বলা কথা না-হলেও, সেই স্মৃতিতে যে বেদনা ভেজা জল ছিল, প্রতিবাদের আঁচ ছিল, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সারদামণি বলছেন, “লক্ষ্মী তার বই ছাড়লে না। ঝিয়ারি মানুষ কিনা, জোর করে রাখলে।” অর্থাৎ, বাড়ির মেয়ে লক্ষ্মী হৃদয়ের কথায় কান দেয়নি। সে বাড়ির বউ নয়, ‘ঝিয়ারি মানুষ’। তাই তার সরব প্রতিবাদ, দৃশ্যত হৃদয়কে অমান্য করার সুযোগ ছিল। কিন্তু পরিবারের বধূ হিসেবে সে স্বাধীনতা রামকৃষ্ণজায়া সারদার ছিল না।
ভাগনে হৃদয় মামিমার ‘বর্ণপরিচয়’ পড়া জোর করে ধমকে বন্ধ করে দিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির কেউ তার কথায় আপত্তি জানাননি। সারদামণিও হৃদয়ের সঙ্গে বাক্-বিতণ্ডায় অবতীর্ণ হননি। অথচ, তার কথা মেনেও নেননি।
আরও পড়ুন-প্রজাতন্ত্র দিবসে কন্যাশ্রীর ট্যাবলো, এবারের অতিথি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট
তিনি কী করলেন?
সারদা জানাচ্ছেন, “আমি আবার গোপনে আর একখানি (বর্ণপরিচয়) এক আনা দিয়ে কিনে আনলুম। লক্ষ্মী গিয়ে পাঠশালায় পড়ে আসত। সে এসে আবার আমায় পড়াত।”
পরে দক্ষিণেশ্বরে আর একটু ভালভাবে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিংবা বলা ভাল, করে নিয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ তখন চিকিৎসার জন্য কলকাতার শ্যামপুকুরে। দক্ষিণেশ্বরে সারদামণি একাটি আছেন। ভব মুখুয্যেদের বাড়ির একটি মেয়ে গঙ্গায় নাইতে আসত। সে মাঝে মাঝে সারদামণির নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য অনেকটা সময় তাঁর সঙ্গে কাটাত। সারদা বলছেন, সেই অবকাশেই চলত পাঠ প্রদান ও শিক্ষালাভ। মুখুয্যে বাড়ির মেয়েকে নিজের সংসারের শাকপাতা গুরুদক্ষিণা হিসেবে দিয়ে লেখাপড়া শিখতেন সারদা। মেয়ে হলেই বিয়ে দিতে হবে, গৌরীদানে কৌলীন্য রক্ষা হবে, এমন কথা কোনওদিন ভাবেননি। যাতে কেউ এমনটা না ভাবে, সে-বিষয়ে সদা সতর্ক থেকেছেন। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না বলে কেউ উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত হয়ে তাঁকে কিছু বললেই সারদা বলতেন, “বিয়ে দিতে না পার তো ভাবনার কী আছে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দাও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে”।
আরও পড়ুন-বিজেপি সরকারের পুরস্কার ফেরালেন র্যাট হোল মাইনার্সরা, নামমাত্র টাকায় কী হবে, ক্ষোভ
শুধু সিস্টার নিবেদিতার স্কুল নয়, গৌরী মা-র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিও তাঁর সুপ্রসন্ন দৃষ্টি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, সেলাই প্রভৃতি কাজ শিখছে, এতে তাঁর আনন্দ। যখন কোনও অভিভাবক মেয়েদের সেরকম সুযোগ না দিয়ে ‘আট বছর হতে না হতেই’ বলতে শুরু করতেন, “পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও”, তখন সারদা তাঁদের দেখে এই ‘পোড়া দেশের’ জন্য আক্ষেপ করেছেন। এইভাবে প্রাচীন আদর্শের শেষ প্রতিনিধি হয়ে সারদামণি পুরুষতান্ত্রিকতার যাবতীয় কুশ্রীতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি বটে, তবে নবীন আদর্শের অগ্রদূত হিসেবে নারী স্বাধীনতার সহায়ক কার্যাবলিতে নিজের আস্থা প্রকাশে কোনও দ্বিধা করেননি।
এই যে বলা হচ্ছে, ‘সারদামণি নবীন আদর্শের অগ্রদূত ছিলেন’, সেটা নেহাতই একটা কথার কথা, এমনটা নয়।
তিনি সংঘজননী ছিলেন, এটা যতটা সত্যি, ঠিক ততটাই সত্যি, তিনি অন্ধগুরুবাদকে কখনও প্রশ্রয় দেননি।
যেমন সেবারের জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়কার কথা। পুজো শেষ। মণ্ডপ থেকে ভোগ নামানো হচ্ছে। সারদা একজন সাধুকে সুজির পায়েস আনতে বললেন। সাধুটি তাই করলেন। পুজোয় যিনি তন্ত্রধারক ছিলেন, তিনি বলে দিলেন, ওই পায়েস তিনি খাবেন না। কারণ, যে সাধু পায়েস নামিয়ে এনেছেন তিনি ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। সন্ন্যাস নেওয়ার পর পৈতা ত্যাগ করেছেন। উপবীত ত্যাগকারীর হাতের ছোঁয়া উপবীতধারী ব্রাহ্মণ খাবেন না। কথাটা শুনে সারদা বললেন, “ওদের হাতে খাবে কেন? ওদের হাতে খেলে যে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার হবে”। ওই তন্ত্রধারক সারদামণির বাপের বাড়ির বংশের গুরুদেব ছিলেন। সারদার কথায় তাঁর অসম্মান হলে ঘোর বিপদ, এমনই আশঙ্কার বশে সারদার ভাই কালীকুমার দিদিকে সত্বর থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “দিদি চুপ কর, গুরুদেব!” কিন্তু সারদা থামতে নারাজ। স্পষ্ট বললেন, “হলেনই বা গুরুদেব”। আর একবার ওলি বুলকে স্পষ্ট বলেছিলেন, কাউকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করলে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তাঁর সবকথা শুনতে বা মানতে হবে। কিন্তু বৈষয়িক বিষয়ে তেমনটা করার কোনও দায় শিষ্যের নেই। সেক্ষেত্রে নিজের সদ্ বুদ্ধি যেমনটা প্রণোদিত করবে, তেমন চলাটা শ্রেয়। “ঐহিক বিষয়ে নিজের সদ্ বুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে কাজ করলে, সেই কাজ যদি কোনও কোনও ক্ষেত্রে গুরুর অননুমোদিত হয় তবুও, গুরুকে শ্রেষ্ঠ সেবা করা হবে”।
আরও পড়ুন-৭০ কোটি টাকার ব্যবসা, নতুন নজির ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের
রামকৃষ্ণের বাণী হোক কিংবা শাস্ত্রবাক্য, কোনওটাই তাঁর কাছে অলঙ্ঘনীয় নয়, যদি সেই লঙ্ঘনে সদিচ্ছার মঙ্গলতিলক আঁকা থাকে। শাস্ত্রবিধির বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট অভিমত, “শাস্ত্রে অনেক বাজে কথাও ভরেছে। শাস্ত্রবিধি অত আর পারা যায় না”।
এ কালের মাপকাঠিতে ‘ফেমিনিস্ট’ ছিলেন না মোটেই। তৎ সত্ত্বেও একেবারে একশো শতাংশ ‘রামকৃষ্ণগতপ্রাণা’ ছিলেন, এমনটাও বলা চলে না। জেদ ছিল, রাগ ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে বিরক্তি এসে মৃদুতাকে ক্ষুণ্ণ করেনি কখনও।
১৮৮১ সালের মার্চ মাস। সারদা এলেন দক্ষিণেশ্বরে, স্বামী সকাশে। সঙ্গে তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী আর মেজ ভাসুরের মেয়ে লক্ষ্মী। ভাগনে হৃদয় ওঁদের দেখেই চটে লাল। যা তা বলতে শুরু করল। কেন এসেছ? কী জন্য এসেছ? এখানে কী? কথাগুলো আর সেগুলো বলার ধরনে আহত হলেন সারদাজননী শ্যামাসুন্দরী। হৃদয়ের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মেয়েকে বললেন, “চল, ফিরে দেশে যাই। এখানে কার কাছে মেয়ে রেখে যাব?” কথাগুলো বললেন শ্রীরামকৃষ্ণের সামনেই। কিন্তু জামাই রামকৃষ্ণ হৃদয়কে কিচ্ছু বললেন না। শ্যামাসুন্দরী বা তাঁর মেয়েকে দক্ষিণেশ্বরে থেকে যাওয়ার কথাও বললেন না। গভীর অভিমানে সারদা সেদিন মনে মনে বলেছিলেন, “মা কোনও দিন আনাও তো আসব”। অর্থাৎ কেবল মা কালীর আহ্বানে সাড়া দিতেই ফের দক্ষিণেশ্বরে আসতে পারেন সারদা, নচেৎ নয়। কিছুতেই নয়।
মা কালী বোধ করি সেকথা শুনেছিলেন।
সারদাকে অপমান করার ফল ভুগতে হয়েছিল হৃদয়কে। ওই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যে হৃদয় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।
স্ত্রী অপমানে স্বামীর মৌন থাকার মাশুল গুনতে হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণকেও। হৃদয় দক্ষিণেশ্বর থেকে বিতাড়িত হলে পূজারির দায়িত্ব পেল রামেশ্বরের বড় ছেলে রামলাল। মা কালীর পূজারি হয়ে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করল। শ্রীরামকৃষ্ণর দেখভাল একেবারেই করত না। সারদা সে সময়কার কথা বলতে দিয়ে বলেছেন, “উনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) ভাব-টাব হয়ে হয়তো পড়ে থাকতেন। এদিকে মা কালীর প্রসাদ শুকনো হয়ে থাকত। ঠাকুরের খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হতে লাগল। তখন অন্য কেউ নেই। ঠাকুর পুনঃ পুনঃ আমাকে আসার জন্য খবর দিতে লাগলেন।” শেষে কামারপুকুরের লক্ষ্মণ পাইনকে দিয়ে বলে পাঠালেন, “এখানে আমার কষ্ট হচ্ছে, রামলাল মা-কালীর পূজারি হয়ে বামুনের দলে মিশেছে। এখন আমাকে আর অত খোঁজ করেন না। তুমি অবশ্য আসবে, ডুলি করে হোক, পালকি করে হোক, দশ টাকা লাগুক, বিশ টাকা লাগুক, আমি দেব”।
এই আকুতিতে অভিমানের বরফ গলল। প্রায় এক বছর পর সারদা ফিরে এলেন দক্ষিণেশ্বরে, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। মুখর প্রতিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, মূকভাবের আশ্রয়ে অভিমান প্রকাশে আস্থা রাখতেন। পাশাপাশি শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কামশূন্য দাম্পত্যে প্রেমপূর্ণতার অভাব ছিল না। তাই অভিমানিনীর নীরবে চলে যাওয়ার এক বছর পর, মানভঞ্জন এবং তাঁর নীরবে প্রত্যাবর্তন।
আরও পড়ুন-করোনা নিয়ে বিশেষ নির্দেশ স্বাস্থ্য দফতরের
সিলেটের ক্ষীরোদবালা রায়। ১০ বছরে বিয়ে হয়। ১৫ বছর বয়সে বিধবা হন। সারদার চরণাশ্রিত ভক্ত। সারদা বলতেন, “শুধু হাতে ঠাকুর দেবতা দর্শন করতে নেই।” সেই কথা মেনে রোজ কিছু না কিছু সঙ্গে নিয়ে ক্ষীরোদবালা সারদার কাছে যেতেন। একদিন সারদাদেবী তাঁকে বললেন, “তোমার পয়সাকড়ি নেই, তুমি রোজই এসব নিয়ে আস কেন, মা? একটা হরীতকী হাতে করে নিয়ে এসো— এতেই হবে।” কেন এই বন্দোবস্ত? এ কি সহানুভূতির বশে করুণা? করুণায় আত্মসম্মান আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সারদাদেবী এমন কথার পেছনে একটা অদ্ভুত কিন্তু অনস্বীকার্য যুক্তি দিলেন। বললেন, “আমি তোমাদের মুখ দিয়ে যে খাই, মা! তোমরা খেলেই আমার খাওয়া হয়।” অধ্যাত্মরসের ছোঁয়া দিয়ে স্নেহরস সিঞ্চন। অভাবের কুশ্রীতাকে বেআব্রু না করে ভাবকে আশ্রয় করা। কোনও জ্ঞানোদ্দীপ্ত স্বৈরকণ্ঠে কৃপাবর্ষণের আবহাওয়া সৃজন নয়। এ একেবারে বাস্তবসম্মতভাবে সমস্যার সমাধান। সারদামণি কি মিথ্যাচারী ছিলেন? এমন কথা বলতে কিংবা মানতে ভক্তকুল তো বটেই, যাঁরা ভক্ত নন, তাঁরাও বোধ করি শিউরে উঠবেন।
অথচ, ঘটনাপ্রবাহ অন্য সাক্ষ্য দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-দিঘায় এবার দেখা মিলবে ডাইনোসরের!
পেটের অসুখে প্রায়ই ভুগতেন। তাই বেশি খাবার দেখলেই ভয় হত। এহেন শ্রীরামকৃষ্ণকে দুটো বেশি ভাত খাওয়ানোর জন্য সারদামণি ভাত টিপে টিপে দিতেন, যাতে চোখে দেখে ভাতের পরিমাণ বোঝা না যায়। অসুখের সময় কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেন বললেন, শ্রীরামকৃষ্ণের জল খাওয়া চলবে না। জলের বিকল্প কী হতে পারে? অনেক ভেবেচিন্তে সারদামণির মনে হয়েছিল, দুধ। হ্যাঁ, দুধই একমাত্র বিকল্প হতে পারে জলের। এই ভাবনায় কোনও বৈজ্ঞানিক অনুমোদন ছিল না। কিন্তু একেবারে আদি অকৃত্রিম পল্লিবাংলার স্নেহাচ্ছন্ন দৃষ্টিসম্পন্ন গৃহবধূর তেমনটাই মনে হয়েছিল। এই সেই গৃহকর্ত্রী প্রিয়জনকে খাইয়েই যাঁর তৃপ্তি এবং সে-বিষয়ে আধুনিকা গৃহকর্ত্রীদের মতো ডায়েটেশিয়ান হওয়ার তাগিদ যিনি অনুভব করেননি।
সেবার অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি যত আসতে লাগল, সব খাওয়াতে লাগলেন সারদা। দুধের পরিমাণও বাড়াতে বাড়াতে দিনে পাঁচ-ছয় সেরে নিয়ে গেলেন। খুব করে ওই দুধ জ্বাল দিতেন যাতে ঘন হয়ে থাকা দুধের আসল পরিমাণ চোখে দেখে ধরা না যায়।
আরও পড়ুন-নিয়োগ সমস্যা মেটাতে মান্থা প্রশংসা করলেন আলোচনার
শ্রীরামকৃষ্ণর সন্দেহ হত। চোখে দেখে নয়, চেখে দেখে। জিজ্ঞেস করতেন, “কত দুধ?” সারদা অবলীলায় জবাব দিতেন, “কত আর! এক সের, পাঁচ পো মতন হবে।” আসল কথাটা ফাঁস করে বসলেন গোলাপ-মা। ধরা পড়ে গেলেন সারদা। তা-ও ব্যাপারটা মানতে নারাজ তিনি। বললেন, “গোলাপ-মা এখানকার দুধের মাপ জানে না। তাছাড়া অত সের, ছটাকের হিসাব কে রাখে! কে-ই বা জানে! দুধই তো খাবে, তা অত হিসাব রাখার দরকার কী?”
শ্রীরামকৃষ্ণ ব্যাপারটা ধরে ফেললেন। বললেন, “এত কি হজম হয়? তাই তো পেটের অসুখ। তোমাদের এমন সেবা চাই না।”
শ্রীরামকৃষ্ণের মনোভাব জেনে বুঝে গোলাপ-মা তো ভয়ে কাঁটা। সারদাকে বললেন, “মা, বলে দিতে হয়। আমি কি জানি?” অর্থাৎ, আগে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখলে তিনি সারদাদেবীর কারসাজির কথাটা ঠাকুরের কাছে ফাঁস করতেন না। কিন্তু এসবে সারদার কোনও হেলদোল নেই। যা করেছেন, বেশ করেছেন, সে-বিষয়ে নিঃসংশয়ী সারদা। গোলাপ-মাকে বললেন, “খাওয়ার জন্য মিথ্যে বললে দোষ নেই।” সাফাই দিলেন, “আমি এইরকম ভুলিয়েটুলিয়ে খাওয়াই। (সেজন্যই তো) এই এতখানি শরীর হয়েছিল। বেশ সেরে গিয়েছিলেন।”
এখানেই সারদামণি নবীন আদর্শের অগ্রদূত হয়েও একালের মা-বউদের মতো বিচক্ষণা, পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যবিষয়ে বৈজ্ঞানিক ভাবে সচেতন গৃহকর্ত্রী নন। একেবারে পুরোনো আমলের প্রতিনিধিস্বরূপা তিনি।
আরও পড়ুন-কৃষি অধিকর্তার তৈরি যন্ত্র গতি আনছে চাষে
সব মিলিয়ে তাহলে কী দাঁড়াল?
সারদামণি অজপাড়া গাঁয়ের একজন সামান্য ব্রাহ্মণী ছিলেন, যিনি তাঁর বাস্তববোধ দিয়ে অনর্থক দেশাচার, যুক্তিহীন জাতপাতের বিশ্বাস, অন্ধসংস্কার আর রোমান্টিক ধর্মের অলৌকিকতা মানতে চাননি। তাই বলে বিজ্ঞানমনস্ক বাস্তববাদী কিংবা তত্ত্বগতভাবে নারীবাদী তিনি ছিলেন না। তিনি আসলে যা ছিলেন তা কোনও বিশিষ্ট-বাদের গণ্ডিতে আটক মানবী কিংবা মহীয়সী নন। তিনি আসলে স্নেহময়ী মাতৃরূপিণী একজন নারী ছিলেন। চাপিয়ে দেওয়া তাত্ত্বিকতা কিংবা অশুদ্ধ গোঁড়ামির জেদাজেদি, কোনওটাই তাঁর মধ্যে ছিল না।
১৩১৪ বঙ্গাব্দ। অগ্রহায়ণ মাস। ইংরেজিতে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ। এরকম একটা ডিসেম্বর মাস। জয়রামবাটিতে সারদাদেবী তখন তাঁর ভাই প্রসন্নর বাড়িতে থাকতেন। কলকাতা থেকে তাঁকে দেখার জন্য গিয়েছেন নলিনীকান্ত বসু। বাড়ির কাছে পৌঁছতে একজন মহিলা আরও কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে আসছ?” নলিনী উত্তর দিলেন, “কলকাতা থেকে। আমাদের মা এখানে থাকেন, তাঁকে দর্শন করতে এসেছি।” সারদা বললেন, “আমিই তো তোমাদের মা, বাবা।” সঙ্গে সঙ্গে নলিনীকান্ত প্রণাম করলেন।
এটাই আসল কথা। যদি জানা না থাকে, যদি না তিনি পূর্ব পরিচিতা হন, তবে এটাই তাঁর আসল এবং একমাত্র পরিচয়।তিনিই তো আমাদের মা।