বাংলার রাজনীতিতে নারীশক্তির অবদান অপরিসীম। বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অজন্তা বিশ্বাস
(২৯ জুলাইয়ের পর)
এবার বলব গীতা মুখোপাধ্যায়ের কথা। বাম জননেত্রী হিসেবে উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি পেয়েছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়। সকলের প্রিয় ‘গীতাদি’ ১৯৪৬ সালে প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গ রাজ্য পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়পর্বে তিনি পাঁশকুড়া পূর্ব বিধানসভা আসনের চার বারের বিধায়ক নির্বাচিত হন এবং পুনরায় ১৯৬৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাত বারের সাংসদ নির্বাচিত হন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা জাতীয় ফেডারেশনের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৮১ থেকে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটিরও সদস্য ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন প্রায় পাঁচ দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজনৈতিক নারী-ব্যক্তিত্ব হিসাবে কর্মমুখর জীবন অতিবাহিত করা এই রমণী রাজনীতির প্রাঙ্গণে নারীদের অবস্থান সুদৃঢ় করার বিষয়েও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের আইনের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গীতা মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিক ও নারী-ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, সমাজসেবার কাজেও ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। ন্যাশনাল কমিশন অন রুরাল লেবার, ন্যাশনাল কমিশন অন ওমেন, ন্যাশন্যাল চিল্ড্রেন্স বোর্ড, ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ওমেন, প্রেস কাউন্সিল— এই সকল সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বার্লিনের ওমেন্স ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশনেরও সদস্য ছিলেন। শিশুপ্রেমী এই রাজনীতিবিদ শিশুসাহিত্য রচনাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ভারত উপকথা, ছোটোদের রবীন্দ্রনাথ, হে অতীত কথা কও— ইত্যাদি পুস্তকমালা তাঁরই অনন্য সাহিত্যকীর্তির পরিচয়।
আভা মাইতি আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম।
আরও পড়ুন-বঙ্গরাজনীতিতে নারীশক্তি
কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতিবিদ আভা মাইতিও ছিলেন রাজনৈতিক নারী-ইতিহাসের অপর এক নক্ষত্র। খেজুরি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ১৯৫১ সালে জয়লাভ করে জন-প্রতিনিধির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। জনদরদি এই রাজনীতিবিদ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেসের মহিলা শাখার সম্পাদিকার দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদিকা ও রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে রাজনৈতিক পদ অলংকৃত করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসের বিভাজন প্রকট হয়ে উঠলে আভাদেবী মোরারজি দেশাই, নিজিলিঙ্গাপ্পা, প্রফুল্ল সেন প্রমুখর সঙ্গে অবস্থান করেন এবং ১৯৭৭ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জনতা পার্টিতে নিযুক্ত হন। ১৯৮৩-তে তিনি রাজ্য জনতা পার্টির সভাপতির দায়িত্ব ও পরে পুনরায় কংগ্রেস দলে যোগদান করে ১৯৮৭ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে খেজুরি বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হওয়ার পরে ১৯৬২-তে ভগবানপুর কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার উদ্বাস্তু পুর্নবাসন, সমাজকল্যাণ এবং স্বরাষ্ট্র বিভাগের নির্বাচন ও সংবিধান-বিষয়ক দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন। প্রফুল্ল সেনের মন্ত্রিসভাতেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯-এও কংগ্রেস দলের কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি জনতা পার্টির প্রার্থী হিসাবে পাঁশকুড়া কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রে প্রথম সরকার নির্বাচিত হলে আভাদেবী শিল্প দপ্তরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। উপেক্ষিত জনগণের সেবায় তিনি সকল সময়ই ব্রতী ছিলেন। তিনি কনজিউমার অ্যাকশান ফোরাম পশ্চিমবঙ্গ শাখার ভাইস চেয়ারপার্সন ছিলেন। শিশুকল্যাণ, নারীকল্যাণ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক ইতিহাসের সৈনিক হয়েই তিনি থাকেননি, ইতিহাসের পাতায় রাজনীতিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ‘সত্যাগ্রহ’ এবং রচিত পুস্তক ‘সমাজ ও নারী’র উল্লেযোগ্যতা তারই প্রমাণ বহন করে।
দীর্ঘদীন রাজনীতির প্রথমসারিতে ছিলেন অপরাজিতা গোপ্পী। উল্লেখযোগ্য বাম রাজনীতিবিদ হিসেবে অপরাজিতা গোপ্পীর নাম সর্বজনবিদিত। অপরাজিতা গোপ্পী কোচবিহার উত্তর আসন থেকে ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন। সেইসময় তিনি ৪০.০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেও ১৯৭৭ সালে একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। ১৯৮২ এবং ১৯৮৭-তেও ওই আসনে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। অপরাজিতা গোপ্পী ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১-এর মধ্যবর্তী সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের আইনসভার সদস্য ছিলেন। অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের মহিলা শাখা অখিল ভারত অগ্রগামী মহিলা সমিতিরও সভাপতি ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি রাজ্যে দলের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন। ২০০৯ পর্যন্ত রাজ্যস্তরে দলের সচিবালয়ের সদস্য ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকেই তিনি উল্লেখযোগ্যতা লাভ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কোচবিহারের সুনীতি একাডেমির ছাত্রী হিসাবে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন পালন করার অধিকার প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের।
পূরবী মুখোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থাকবে। ভারতীয় রাজনীতিবিদ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন পূরবী মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিস্বরূপ তিনি লোকসভার সাংসদ পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন ১৯৭০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসাবেই সমগ্র রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করেছিলেন পূরবীদেবী।
কৃষ্ণা বসু শুধু নেতাজি পরিবারের সদস্যই নন, সক্রিয় রাজনীতিতে পদার্পণের পর নিজেও তাৎপর্যপূর্ণ ছাপ রেখে গিয়েছেন। বাংলা তথা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস কৃষ্ণা বসুর অবদানের আলোচনা ব্যতীত অসম্পূর্ণ। মেধাবী কৃষ্ণাদেবী শরৎ বসু, সুভাষ বসুর পরিবারের বধূ এবং শিশির বসুর পত্নী রূপে পরিচিত হওয়ার আগেই পিতৃকূল থেকেই জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর উন্মেষের নেপথ্যে তাঁর শ্বশুরগৃহের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির মন্ত্রে উদাসীন হতে শিখেছিলেন তাঁর পিতার কাছ থেকেই তিনি আজীবন নেতাজি চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। উজ্জ্বল শিক্ষকতার কর্মজীবন ও সাংসারিক জীবনের দায়িত্ব পালন করে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন কৃষ্ণাদেবী বেশ কিছুটা পরে। তখন তিনি ৬৫ বছর বয়স অতিক্রান্ত করেছেন। প্রথম কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে যাদবপর কেন্দ্র থেকে জিতে লোকসভায় নির্বাচিত হন ১৯৯৬। সেইসময় তাঁর স্বামী, সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের অন্তরঙ্গ সহচর ও সাক্ষী, শিশিরকুমার বসু সরাসরি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এরপর আরও দু’বার ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে একই কেন্দ্র থেকে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন কৃষ্ণাদেবী। ওইসময়ের আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তখনকার কংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস ছেড়ে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করার পর ১৯৯৮ সালে প্রথম থেকেই লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর সময় তাঁর সহযোদ্ধা হিসাবে পেয়েছিলেন কৃষ্ণাদেবীকে। সাংসদ হিসাবেও তাঁর ভূমিকা ছিল বর্ণময়। লোকসভায় বক্তৃতা দেওয়ার তাঁর শব্দচয়ন ও গভীরতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ে লোকসভায় বিদেশমন্ত্রক বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটিতে চেয়ারপার্সন হয়েছিলেন তিনি। সাংসদ জীবনের পরবর্তী সময়কালে তাঁর কাজের সর্বাঙ্গীণ বিষয় হয়ে উঠেছিল নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো। শিশির বসুর মৃত্যুর পর থেকেই তিনি এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সন ছিলেন। লেখালেখি, বক্তৃতা তাঁর জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। তাঁর প্রায় সব লেখাতেই মিশে থাকত ব্যক্তিগত স্বর। তাঁর রচিত বই ‘চরণরেখা তব’, ‘প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র’, ‘এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’, ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর শেষ উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, ‘নেতাজির সহযোদ্ধারা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত থাকার সময়েও কোনও সংবেদনশীল বিষয়েও মতামত ব্যক্ত করতে পিছপা হতেন না কৃষ্ণা বসু। শিক্ষক হিসাবে পুরনো ইতিহাস আর রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ওপর বারংবার গুরুত্বও প্রদান করতেন কৃষ্ণা দেবী। শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, বংশগৌরব, রাজনৈতিক পারদর্শিতা, সবই ছিল তাঁর। তাই তো তিনি কালজয়ী হতে পেরেছিলেন। তাঁর মৃত্যু সত্যিই এক যুগের অবসান ঘটিয়েছিল। নারী হয়েও রাজনৈতিক ইতিহাসে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা কৃষ্ণা বসুর আকস্মিক জীবনাবসান তাই সকলকেই শোকস্তব্ধ করে দিয়েছিল।
রাজনীতির লড়াইয়ে এই সকল নারীর অবদান অপরিসীম। সকলেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্ব-স্ব ভূমিকায় সমুজ্জ্বল। তবে মহিলা নেত্রী হিসাবে রাজনীতির অসম লড়াইয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন যে নেত্রী তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গৃহবন্দি নারী বিংশ শতক থেকেই স্বাধীনতার আস্বাদ পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু তা সহজলভ্য ছিল না, আজও নেই। হয়তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীর সার্বিক পরিস্থিতির তুলনামূলক উন্নতি হলেও সর্বক্ষেত্রেই তা অর্জন করতে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে হয়েছে নারীকে। এমনই কঠিন লড়াইতে বারবার জয়ী হয়েছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘অগ্নিকন্যা’, ‘দিদি’ এবং ‘ঘরের মেয়ে’ অভিধাও তিনি অর্জন করেছেন আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে। কলকাতার হাজরা অঞ্চলের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এক সাধারণ মেয়ে আজ টাইম ম্যাগাজিনের মনোনীত ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে একজন অন্যতম হিসাবে বিবেচিত। বাংলার রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা পূর্বে লক্ষ্য করা গেলেও সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান রাজনৈতিক পরিসরে মহিলাদের অবস্থানের এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিতে যোগদান করেন। অল্প বয়সেই কংগ্রেস(ই) দলে অংশগ্রহণ করেন তিনি। কংগ্রেস নেত্রী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন শিগগিরই। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৮৪-তে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে তিনি প্রথমবার সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ ও ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তিনি কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন। নরসিংহ রাও মন্ত্রিসভায় তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ন, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সাধারণের প্রয়োজনে গর্জে উঠেছিলেন বহুবার। একাধিকবার পদ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেন। সেই সময়কার কংগ্রেস দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন তিনি। কংগ্রেস তাঁকে বহিষ্কার করে। ১৯৯৭-তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণভাবে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস স্থাপন করেন। এক বাঙালি নারী হিসাবে একটি নতুন সর্বভারতীয় দলের প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনি। ১৯৯৯-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল বাংলার উন্নয়নে কিছু কাজ করার স্বার্থে কেন্দ্রের এনডিএ জোটে শামিল হয়েছিলেন। জোট সরকার গঠনের পর তিনি রেলমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত হন। রেলমন্ত্রী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অভূতপূর্ব রেল উন্নয়নের কাজ তিনি করেছিলেন। বেশ কিছু নতুন এক্সপ্রেস ট্রেন চালু এবং নতুন রেলপথ নির্মাণের ওপরও জোর দিয়েছিলেন। ২০০১-এ রাজনৈতিক মতবিরোধের ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনডিএ-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ২০০৪-এ পুনরায় কয়লা ও খনি মন্ত্রকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই বছরই তিনি লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে একমাত্র তৃণমূল সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে টাটার কারখানা স্থাপনের বিষয়ে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। সেই গণবিক্ষোভে নেতৃত্ব দান করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনিচ্ছুক কৃষকদের সংগঠিত করে গণ-আন্দোলনের রূপদান করেন জননেত্রী। এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও নির্বাচনে মানুষের রায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই যায়।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নাম রাখা ‘উৎসশ্রী’ পোর্টালের উদ্বোধন শিক্ষামন্ত্রীর, আবেদন দোসরা অগাস্ট থেকে
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য পায় তাঁর দল। তার আগে ২০০৮ সালেও পঞ্চায়েত নির্বাচনেও সেই অগ্রগতি জারি ছিল। ২০০৯-এ দ্বিতীয়বার রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুনরায় রেল উন্নয়নে শামিল হন তিনি। মহিলা নেত্রী হিসাবে মহিলা সংরক্ষণ বিলকে যেমন সমর্থন করেছিলেন তেমনই মহিলা রেলমন্ত্রী হিসাবে রাজ্য ও দেশের বেশ কিছু শাখায় লেডিজ স্পেশ্যাল ট্রেন চালু করার মতো সময়োপযোগী সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বাঙালি মহিলা মুখ্যমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করেন এবং পুনর্বার ইতিহাস রচনা করেন। সমস্ত বাধা পেরিয়ে সাফল্যের লক্ষ্যে এগিয়েছেন সরকারি কর্মসূচিগুলির ভিন্নধর্মী রূপায়ণের মাধ্যমে।
এই ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়েই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সাফল্য এবং ২০১৬-তে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ বারবার নিজেই ভেঙেছেন নিজের রেকর্ড। এখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে। রাজ্যের সমস্ত নারীদের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবলা, স্বাস্থ্যসাথী প্রভৃতি নারীকেন্দ্রিক প্রকল্পের সূচনা করেছেন। বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সাহসের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হারিয়ে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। কঠিন লড়াইয়ে একক শক্তি হিসাবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে নারীশক্তির জয়ের বন্দনাই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বরে। তিনি বলেন, ‘এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, ইতিহাস মিরাকল! আমি বাংলার নারীশক্তির কাছে মাথা নত করছি।’ একজন রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে নজির গড়েছেন সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে নিজের যোগ্যতায়। রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঙালি নারী হিসাবে নিজেকেই অন্যতম সেরা প্রমাণিত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশস্ত করেছেন নারীদের জয়যাত্রা। তাই এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে কুর্নিশ জানাই, সকল পথপ্রদর্শক বাঙালি সংগ্রামী নেত্রীদের যাঁরা প্রাক্-স্বাধীনতাপর্ব থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতিতে নারীর স্থান সুদৃঢ় করার কাজ করে চলেছেন এবং নারী আন্দোলনকে সুদূরপ্রসারী করে নতুন ইতিহাস রচনা করছেন।
(সমাপ্ত)