সহজ আশ্রমে মহিলাদের ডোকরা ওয়ার্কশপ

চার-সাড়ে চার হাজার বছরের প্রাচীন বাংলার লোকায়ত শিল্পের অন্যতম হল ডোকরা শিল্প। এই পুরাতনী শিল্পের শিল্পীদের থেকে আজকের নারীদের প্রশিক্ষিত করতে বর্ধমানের আউশগ্রামের সহজাশ্রমে আয়োজিত হল ডোকরা ওয়ার্কশপ। গ্রামীণ প্রকৃতির পাঠশালায় এই ওয়ার্কশপে বিভিন্ন রাজ্য থেকেও এসেছিলেন বহু আগ্রহী নারী এবং গুণী শিল্পীরা। বাংলার লোকায়ত এই শিল্পের ধারা বেঁচে থাকুক, চাইছেন উদ্যোক্তা আশ্রমিকেরা। লিখছেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

ডোকরা হল ‘বিশেষ ঢালাই’ পদ্ধতিতে তৈরি একটি শিল্পকর্ম। এই শিল্পের ইতিহাসটি প্রায় ৪০০০ হাজার বছরের প্রাচীন। সিন্ধুসভ্যতার শহর মহেঞ্জোদড়োতে প্রাপ্ত ‘ড্যান্সিং গার্ল’ বা নৃত্যরত নারী মূর্তিটি হল ডোকরা শিল্পের আদি নিদর্শন। ভারত ছাড়াও চিন, মালয়েশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে এই ডোকরা শিল্পকর্ম পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন-বিলকিস মামলার আরেক অপরাধীকে দশদিনের প্যারোল দিল গুজরাত হাইকোর্ট

কিছুদিন আগেই শীতের শুরুতে বাঁকুড়ার বিকনা শিল্পডাঙায় এবং আউশগ্রামের দেরিয়াপুরের ঘটকপুকুরের পাড়ে হয়ে গেল ডোকরা মেলা। এবার পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের গোপালপুরের সহজ আশ্রমে আয়োজন করা হল ডোকরা শিল্পের ওয়ার্কশপ। গতকাল এবং আজ অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি দু’দিনের ওয়ার্কশপ। নির্মাণ শিল্পের এই ওয়ার্কশপে ট্রেনি হিসেবে, প্রশিক্ষণ দিলেন দেরিয়াপুরের বিশিষ্ট ডোকরা শিল্পী শুভ কর্মকার। গোটা রাজ্যের থেকে মোট ৪৩ জন মহিলা শিল্পী এই ডোকরা শিল্পের ওয়ার্কশপ, কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। প্রতি শিক্ষার্থী পিছু থাকা-খাওয়া নিয়ে জনপ্রতি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার টাকা করে। সেই সঙ্গে কর্মশালায় বাঁকুড়ার বিকনা, দেরিয়াপুরের বিভিন্ন ডোকরা শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। আশ্রমে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ডোকরা শিল্পীর কাজও।

আরও পড়ুন-১ জুলাই থেকেই দেশে কার্যকর হবে ৩ সংহিতা আইন

দেশ বিদেশে ডোকরা শিল্পীদের শিল্পের খ্যাতির জেরে বাঁকুড়ার এই শিল্পডাঙা তথা ডোকরা গ্রামের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে বর্তমানে। এছাড়াও ইউনেস্কো, রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প দফতরের উদ্যোগে দু’দিনের ডোকরা কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল বিকনা শিল্পডাঙায়, এ-বছরও। শিল্পডাঙার প্রতিটি ঘরে ঘরে হয়ে ছিল শিল্পকর্মের স্টল। যেখানে দেখা মিলেছিল বহু রকমের ডোকরা শিল্পসম্ভারের। শুধু তাই নয়, ডোকরাদের গ্রাম সংলগ্ন মাঠে আয়োজন করা হয়েছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ। সেখানে কয়েকজন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্তশিল্পীরা এসেছিলেন এবং বাঁকুড়ার গৌরব যুদ্ধ কর্মকারের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল এই মঞ্চ। দেরিয়াপুরেও হয় প্রতি বছর ডিসেম্বরের শুরুতে ডোকরা শিল্পমেলা। তবে গ্রামগঞ্জে শিল্পের এই ধারাকে আরও উজ্জ্বল করতে সহজ আশ্রমে নেওয়া হয় ডোকরা প্রশিক্ষণ শিবিরের মতো নানান কর্মকাণ্ড।
বাংলার ডোকরা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে নানা পদক্ষেপ করছে সরকার। তেমনই এক কর্মসূচি নিয়েছে আউশগ্রাম গ্রামের সহজ আশ্রমের রাখি ঘোষরা। দু’দিনের এই কর্মশালায় সেখানে ডোকরা শিল্প বানানোর পাশাপাশি বিপণনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ডোকরা শিল্পকে আধুনিক করতেও বিভিন্ন চিন্তাভাবনা চলছে সহজ আশ্রমে। তরুণ শিল্পীদের পাশাপাশি মহিলারা এই প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। শিল্পীদের বাইরের জগতের লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হয় এখানে এসে। এতে বাইরের বাজার ধরার সুযোগ তৈরি হবে। বাঁকুড়ার বিকনা শিল্পডাঙার প্রায় ৬০টি পরিবারকে নতুন কোনও দিশা দিতে পারে, দেরিয়াপুরের ৪৩টি ডোকরা পরিবারও আলোকিত হয় এই ধরনের কর্মকাণ্ডে, বলছেন অনেকে।

আরও পড়ুন-সন্দেশখালি একনজরে, রাজ্য সরকার ও দলের পদক্ষেপ

ডোকরা লোকশিল্প হলেও বর্তমানে তা হস্তশিল্প হিসেবে চিহ্নিত। এই শিল্পে আগে শুধুমাত্র ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদে নানা ধরনের উপাদান তৈরি হত। এখন তা গৃহসজ্জার ক্ষেত্রেও বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সূত্রে ডোকরা শিল্প আন্তর্জাতিক স্তরে বাজার তৈরি করতে পেরেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিল্পীদের পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে অনেক অংশে।
এই শিল্পের শিল্পীদের খ্যাতির কারণে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। যেমন, ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন শম্ভু কর্মকার, ১৯৮৬ সালে দরিয়াপুরের হারাধন কর্মকার, ১৯৮৮ সালে মটর কর্মকার, ওই বছরেই বিকনার বুদ্ধ কর্মকার প্রভৃতি পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। এঁরা কেউ গিয়েছেন ইংল্যান্ড, জাপান, প্রভৃতি দেশেও। হারাধন কর্মকার ভারত সরকারের সাহায্য নিয়ে ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৬ এবং ১৯৯০ সালে লন্ডন, শিকাগো, জাপান ঘুরে এসেছেন।
এত প্রচার ও প্রসারে থেকেও ডোকরা শিল্পে সমস্যাও প্রচুর। ক্রমশ কয়লার দাম বেড়েছে। যে কয়লার দাম একবছর আগে ৩৯০ টাকা ছিল, সেটা এখন এক হাজার টাকা হয়েছে। পুরনো পিতলের দাম বেড়েছে। পুরনো পিতল গত চার বছরে ৮৫ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা হয়েছে। কলকাতার বা রাজ্যের অন্য যেসব জায়গায় তৈরি জিনিস বিক্রির জন্য শিল্পীরা পাঠান, সেগুলি বিক্রির পর টাকা পান না। এদিকে, লাভের টাকাটা কিন্তু মাঝে যেসব দোকানিরা থাকেন, তাঁরা মেরে দেন। অথচ বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত গরিব ডোকরা শিল্পীদের টাকাটা আটকে থাকে। তাই কাজের জন্য যে মুলধন লাগে তার অভাব থাকে। ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে চায় না। অনেক সময় ব্যাঙ্ক জায়গা-জমি বা ঘর-বাড়ি মর্টগেজ রাখতে চায় ঋণের জন্য। তবে সেই ক্ষমতা তো সবার থাকে না।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

গ্রামীণ ‘সহজ আশ্রমে’র নানা কর্মকাণ্ডে কিছু কিছু লোকশিল্প বর্তমানে নতুনভাবে বাঁচার রসদ পাচ্ছে। যেমন, পটশিল্প, মুখোশ শিল্প, মৃৎশিল্প, পটুয়ারা আগের তুলনায় এখন খানিকটা ভাল থাকার চেষ্টা করছেন সহজের কর্মশালায় আসার পর। সহজ আশ্রমে পটশিল্প নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। পটশিল্প প্রসারে নানাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তেমনই ডোকরা শিল্পীদের জন্যও বিভিন্নরকম কর্মসূচি শুরু করেছেন তাঁরা। ডোকরা শিল্পীদের সমবায় হলে তাঁরা যেমন শিল্পদ্রব্য বিক্রির সুযোগ পাবেন, তেমনই হঠাৎ প্রয়োজনে স্বল্প সুদে ঋণ পেতেও পারেন— বলছেন কর্মশালার আয়োজন করা সহজ আশ্রমের সদস্যা, শিল্পী রাখি ঘোষ।

Latest article