রাজ্যে এতদিন ধরে ভোট চলবে! কেন? কার স্বার্থে? তাতেও ঝুলি ভরবে তো?

সাতকাণ্ড রামায়ণের মতো সপ্তপর্বে নির্বাচন। এবং সেটা শুধু এই বাংলায়। তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী? উত্তর দিচ্ছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

নির্বাচন কমিশন স্বশাসিত সংস্থা। এমনটাই আমাদের জানা ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে এখন যেটা বুঝতে পাচ্ছি, তার কিছুটা ফারাক রয়েছে।
কমিশনার নিয়োগে যদি কেন্দ্রের পূর্ণ ক্ষমতা থাকে, তাহলে দিনক্ষণ ঠিক করার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা কি তারা দাবি করবে না? কোন রাজ্যে কত দফায় ভোট হবে, তামিলনাড়ুর কতদিন পর গুজরাতে ভোট (Lok Sabha election 2024) হবে, কোথায় কত কেন্দ্রীয় বাহিনী যাবে… এই সব প্রশ্নের উত্তর কেন্দ্রের সরকারের আস্তিনে লুকনো থাকে। চিরাচরিতভাবে। এবারও আছে। এক-এক দফার মধ্যে যদি দিন সাতেকের ব্যবধান থাকে, তাহলে নরেন্দ্র মোদিকে হুড়োহুড়ি না করলেও চলবে। বুঝতে পারছি, তাঁরও তো বয়স হয়েছে! সরকারিভাবে ৭২। দশ বছর আগে প্রতিদিন যেভাবে তিনি দেশের কোণায় কোণায় ছুটে বেড়িয়েছিলেন, এখন তা সম্ভব নয়। এখনও তিনি হয়তো দিনে তিনটি সভা করবেন, তেলেঙ্গানা থেকে বিহার হয়ে মধ্যপ্রদেশ ছুটবেন। কিন্তু মাঝে একটু বিশ্রাম তো চাই! তাই ভোট ঘোষণার পর থেকে শেষ দফা পর্যন্ত আড়াই মাস তো পর্যাপ্ত সময়। ঘুঁটি সাজানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। সময় নরেন্দ্র মোদির জন্য, অমিত শাহের জন্যও। ঘুঁটিগুলো সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গুছিয়ে নেওয়ার সময়টা চেয়েছিলেন শাহজি, মোদিজি। পেয়েও গেলেন। এটা বোঝার জন্য রকেট বিজ্ঞান জানার দরকার পড়ে না।

অমিত শাহ প্ল্যান করবেন, আর মোদি ডেলিভার। তৃতীয় ইনিংসের জন্য কোনওরকম ফাঁক রাখা যাবে না। ৪০০ আসন না হোক, বিজেপির কোষাগারে ৩৫০’এর বেশি আসন চাইই চাই। সামনে যে অনেক কাজ! দেশ জুড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করাটা বিজেপি-আরএসএসের চিরকালীন অ্যাজেন্ডা। সঙ্গে রয়েছে সিএএ, বাছাই করা কয়েকটি রাজ্যে এনআরসি এবং অবশ্যই ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ কার্যকর করা। তার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে অন্তত কোনওরকম বাধার মুখোমুখি হতে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ চাইবেন না। সেটা সম্ভব, যদি লোকসভা এবং রাজ্যসভা—দুই কক্ষেই তাঁরা গরিষ্ঠতা পেয়ে যান। লোকসভা নির্বাচনে ৪০০’র কাছাকাছি আসন তারই প্রথম এবং প্রধান ধাপ। দুই-তৃতীয়াংশ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তার জন্য প্রত্যেকটা রাজ্য, প্রত্যেকটা কেন্দ্র ধরে ধরে প্ল্যান সাজাতে হবে।
যে কেন্দ্রে মতুয়া ভোটার বেশি, সেখানকার জন্য নাগরিকত্ব। যেখানে মুসলিম সংখ্যাধিক্য, সেই কেন্দ্রের জন্য তিন তালাক। মারাঠাদের জন্য সংরক্ষণ, গো বলয়ের হিন্দুদের জন্য রামমন্দির। ঘুঁটিগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গুছিয়ে নেওয়ার সময়টা চেয়েছিলেন শাহজি মোদিজি। পেয়েও গেলেন।

এইজন্যই পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটা কেন্দ্র ধরে ধরে প্ল্যান সাজাতে হবে। যে কেন্দ্রে মতুয়া ভোটার বেশি, সেখানকার জন্য নাগরিকত্ব। যেখানে মুসলিম সংখ্যাধিক্য, সেই কেন্দ্রের জন্য তিন তালাক। মারাঠাদের জন্য সংরক্ষণ, গো-বলয়ের হিন্দুদের জন্য রামমন্দির। এই নির্ঘণ্টে বাকি দলগুলোর সুবিধা বা অসুবিধা কী হল? পশ্চিমবঙ্গের আসনসংখ্যা ৪২। পাহাড় থেকে সমুদ্র—একটি কেন্দ্রের চরিত্র অন্যটির থেকে আলাদা। মাটি, আবহাওয়া, মানুষ… আলিপুরদুয়ারের সঙ্গে কলকাতা দক্ষিণের ফারাক আকাশ-পাতাল। কিন্তু মিল একটাই— গোটা বাংলা বাঁধা এক সুরে। এখানকার মানুষ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসে, চায়ের দোকানে রাজনৈতিক চর্চায় ধোঁয়া ওঠে, আর ভোটের দিন সকালে সেই সব ভুলে লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। বুথের দরজা খোলার আগেই। বাংলার মানুষ জানে, ভোটদানটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এটা প্রয়োগ করতে হয়। এই রাজ্যে অন্তত কমিশনকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখানোর কাজটা না করলেও চলে। কোনও বুথের সামনে সকাল ১০টায় হয়তো বোমা পড়ে। শুনশান হয়ে যায় চত্বর। কিন্তু দুপুরে আবার আমরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাই। এক দলের সমর্থক জিজ্ঞেস করেন পড়শি অন্য এক দলের কর্মীকে, ‘ভাই গোলমাল আর নেই তো? তা হলে ভোটটা দিয়ে আসি।’ দেশের কোনও রাজ্যে এই আবহ দেখা যায় না। যাবেও না।

আরও পড়ুন- বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতি, গ্রেফতার কেজরি, ক্ষুব্ধ তৃণমূল

তাহলে এই বাংলার জন্য সাত দফায় ভোট (Lok Sabha election 2024) কেন? তামিলনাড়ুতেও তো ৩৯টি আসন। সেখানে কেন এক দফা? উত্তর লুকিয়ে আছে নির্ঘণ্টেই। বাংলায় প্রথম দু’টি দফার ভোট উত্তরবঙ্গে। অর্থাৎ বিজেপির তথাকথিত শক্ত জমি। এবং প্রত্যেক জেলার ক্ষেত্রে বিভাজনের অঙ্ক কষে রাখা আছে। পৃথক গোর্খাল্যান্ড, পৃথক উত্তরবঙ্গ, বা সীমাঞ্চল। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের টোপ, আলাদা মুখ্যমন্ত্রী, পৃথক ফান্ড। ঠিক একইভাবে গৌড়বঙ্গের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ, তারপর জঙ্গলমহল, বনগাঁ ও বারাকপুরে ভোটগ্রহণের দিন উত্তর ২৪ পরগনার বাকি কেন্দ্র থেকে আলাদা করে দেওয়া, আর সবশেষে কলকাতা। কেন্দ্রগুলো খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এলাকার চরিত্র এবং গেরুয়া শিবিরের শক্তি নিপুণভাবে মাথায় রেখে দিনক্ষণ সাজানো হয়েছে। প্রচারে সুবিধা হবে, পাশাপাশি জোর দেওয়া যাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারেও। গত লোকসভা ভোটে বাংলায় এসেছিল ৭১০ কোম্পানি আধাসেনা। এবার সংখ্যাটা হতে চলেছে ৯২০ কোম্পানি। প্রথম দফার ভোট— অর্থাৎ জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার কেন্দ্র শুরু হবে ২২৫ কোম্পানি দিয়ে। মনে রাখতে হবে, ওইদিন দেশের ২২টি রাজ্যে নির্বাচন রয়েছে। তারপর চাপ সর্বত্রই কমে যাবে। আর সব রাজ্য থেকে সিআরপি জওয়ানদের ধীরে ধীরে নিয়ে আসা হবে বাংলায়। আমাদের রাজ্যে প্রথম দফায় কিন্তু দার্জিলিং নেই। দ্বিতীয় দফায় আছে। সঙ্গে রায়গঞ্জ, বালুরঘাট। অর্থাৎ প্রথম দফার ভোট হয়ে গেলে পাশের জেলা থেকে আধাসেনার একাংশ চলে যাবে দার্জিলিংয়ে, আর বাকিটা রওনা দেবে দিনাজপুর। পারফেক্ট প্ল্যান। তাহলে প্রথম দিকে এক-একটি কেন্দ্রে কত কোম্পানি বাহিনী থাকছে? প্রায় ৭০ কোম্পানি। অর্থাৎ এক-একটি বিধানসভা এলাকায় অন্তত ১০ কোম্পানি আধাসেনা। মানে ১ হাজার জওয়ান। দফা যত গড়াবে, সংখ্যাটা বাড়বে পাল্লা দিয়ে।
সরাসরি জানতে চাইছি, কার স্বার্থে এই বন্দোবস্ত?
জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে, যাদের গদিতে তোলার জন্য এই ষড়যন্ত্র, তাঁদের লাভের লাভ কিছু হবে তো!

Latest article