আজ বিশ্ব বেতার দিবস। সারা পৃথিবীর পাশাপাশি ভারতেও পালিত হচ্ছে বিশেষ দিনটি। কলকাতা বেতারের ইতিহাস বহু পুরনো। বিভিন্ন সময় বহু বিশিষ্ট মানুষ যুক্ত থেকেছেন এই শ্রাব্য মাধ্যমটির সঙ্গে। উপহার দিয়েছেন রুচিশীল অনুষ্ঠান। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী
ইউনেস্কো
২০১০ সাল। স্পেন রেডিও সংস্থা ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপন করার প্রস্তাব দেয়। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি ইউনেস্কো প্রথমবার বিশ্ব বেতার দিবস হিসাবে পালন করে। তার পর থেকে সারা বিশ্বে পালিত হতে শুরু করে বিশ্ব বেতার দিবস। দিনটি মূলত উদযাপিত হয় ব্যক্তি মতামতের স্বাধীনতা, শিক্ষার প্রসারে রেডিওর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে। পৃথিবীতে বেতারের ইতিহাস বহু পুরনো। একটা সময় বেতার বা রেডিও ছিল দেশ-বিদেশের খবর পরিবেশনের একমাত্র মাধ্যম। এই ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি আসলে জাতিসংঘ রেডিওর বার্ষিকীও। ১৯৪৬ সালে একই দিনে শুরু হয়েছিল পথ চলা। ইউনেস্কো প্রতি বছর বেতার দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পাশাপাশি এই দিনে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে বেতারের গুরুত্ব আলোচনা করা হয়। জানানো হয়, শুধুমাত্র বিনোদন নয়, দুর্যোগের সময় যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমগুলি বিচ্ছিন্ন হলে বেতার মাধ্যমের সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে খবর। ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বেতার দিবস।
আরও পড়ুন-মেসি-এমবাপের যুগলবন্দিতে জয়
ভারতে প্রথম বেতার
১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত বোম্বাই (বর্তমানের মুম্বই) শহরে শুরু হয় প্রথমবার ভারতের বেতার সম্প্রচার। সেটা বাস্তবায়িত হয়েছিল বোম্বাই প্রেসিডেন্সি রেডিও ক্লাব এবং অন্যান্য কয়েকটি রেডিও ক্লাবের উদ্যোগে। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড আরউইন। তারপর বেতার সম্প্রচার শুরু হয় কলকাতায়। পরে দিল্লিতে। পরে সারা দেশে জন্ম নেয় আরও অনেক কেন্দ্র। ১৯৩৬ সাল থেকে ভারত সরকার কর্তৃক অল ইন্ডিয়া রেডিওর সম্প্রচার শুরু হয়।
আরও পড়ুন-ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে : সৌম্যদীপ
কলকাতা বেতার
১৯২৭ সালের ২৬ অগাস্ট জন্ম হয় কলকাতা বেতারের। উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল স্ট্যানলি জ্যাকসন। এই বেতার কেন্দ্রের অবস্থান ছিল ১ নং গার্সটিন প্লেসে। সেটা ছিল অত্যন্ত সাদামাটা তিনতলা একটি বাড়ি। ডালহৌসি স্কোয়্যারের পশ্চিমে, নির্জন পরিবেশে। পুরনো বাড়িটির দোতলা ও তিনতলা পাঁচ বছরের লিজে মাসিক আটশো টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আদি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কার্যালয়। কাশীপুরের টালা পার্কের কাছে দেড় কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার চালু করা হয়েছিল। সেখান থেকেই চলত সম্প্রচার। গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন এই কেন্দ্রটির দ্বারোদঘাটন করেছিলেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছিলেন সুলতান চিনয়। স্টেশন ডিরেক্টর নিযুক্ত হন সি সি ওয়ালিক। ভারতীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পান বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। ঘোষণা ও সংবাদপাঠের জন্য নিযুক্ত হন মোহনবাগানের ফুটবলার রাজেন্দ্রনাথ সেন। তিনি ১৯১১-র আইএফএ শিল্ড বিজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। প্রথমদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সংগীতশিল্পী আঙুরবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে, প্রফুল্ল বালা সিতাংশুজ্যোতি মজুমদার, তবলাবাদক রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখ।
আরও পড়ুন-পিছিয়ে পড়েও দারুণ জয় সবুজ-মেরুনের
ইডেন গার্ডেনস
১৯৫৮ সালে অগাস্ট মাসে গার্সটিন প্লেস থেকে বেতার কেন্দ্র চলে আসে ১ নং ইডেন গার্ডেনস-এ আকাশবাণীর নতুন ভবনে। যেখান থেকে এখন সম্প্রচারিত হচ্ছে। আকাশবাণী কলকাতার নতুন ভবন থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে। নানা রঙের অনুষ্ঠান। কলকাতা বেতারের প্রথম কেন্দ্র অধিকর্তা ছিলেন সি সি ওয়ালিক। তিনি ছিলেন ইংরেজ, একজন দক্ষ পরিচালক ও প্রশাসক।
বেতার নাটুকে দল
১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে গঠিত হয়েছিল ‘বেতার নাটুকে দল’। পরের বছর, ১৯২৮-এর ১৭ জানুয়ারি ওই দলের সর্বপ্রথম নাটক ‘জমাখরচ’ সম্প্রচারিত হয়েছিল। নাটকটি রচিত হয়েছিল অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে। নাট্যরূপ দেওয়ার পাশাপাশি প্রধান চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। নাটকটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বেতার নাটুকে দলের। পরবর্তী সময়ে বেতার নাটক প্রায় নিয়মিত প্রচারিত হত। এইসব নাটকে অভিনয় করতেন অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সরযূবালা, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে, বিকাশ রায়, পরবর্তীকালে জগন্নাথ বসু, শাঁওলি মিত্র, গৌতম চক্রবর্তীর মতো দিকপাল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। একটা সময় শুক্রবারের সন্ধেবেলার নাটক খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
আরও পড়ুন-শহরে এলেন ক্রিকেটাররা
বেতারে রবীন্দ্রনাথ
বেতারের ‘আকাশবাণী’ নামকরণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের একটি আশীর্বাণী ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় ছাপতে চেয়েছিলেন নলিনীকান্ত সরকার। সেই আশায় তিনি সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে নিয়ে যান শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ সেইসময় গুরুতর অসুস্থ। কিছুই লিখে দিতে পারেননি। তবে কিছুদিন পরে বেতারের জন্য একটি কবিতা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন। সেই কবিতায় ‘আকাশবাণী’-র উল্লেখ ছিল। বেতার আসলে এমন একটি মাধ্যম, যেখানে শিল্পীদের দেখা যায় না, শোনা যায়। কণ্ঠস্বর শুনে শ্রোতারা ভেসে যেতে পারেন কল্পনার জগতে। রবীন্দ্রনাথ অংশ নিয়েছেন বেতার অনুষ্ঠানে। ১৯৩৮-এর ৮ মে, ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কালিম্পংয়ের গৌরীপুর লজ থেকে তিনি সরাসরি আবৃত্তি করে শোনান তাঁর লেখা ‘জন্মদিন’ কবিতাটি। এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচারিত হয়েছিল কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, লখনউ, লাহোর, পেশোয়ার কেন্দ্র থেকে। ১৯৪১ সালের অগাস্ট মাসের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৬ অগাস্ট থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা ঘোষণা করা হয়। ৭ অগাস্ট ১৯৪১, ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হন। সেইদিন রাজপথে রবীন্দ্রনাথের শবযাত্রার এবং নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে দাহকার্যের ধারাবিবরণী দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বেতারে কাজী নজরুল ইসলাম আবৃত্তি করেন সদ্যরচিত ‘রবিহারা’ কবিতাটি। পাশাপাশি গেয়ে শোনান ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ গানটি। নজরুল ছিলেন একজন রবীন্দ্রভক্ত।
আরও পড়ুন-সেনেগালে মানের নামে স্টেডিয়াম
বেতারে নজরুল
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ। কলকাতা বেতারের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য বছর।
ওই বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি অজস্র গান রচনা করেছেন। নিজে লেখার পাশাপাশি সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন। তাঁর গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সেই সময়ের বিশিষ্ট শিল্পীরা। বৈচিত্র ছিল নজরুলের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি কবিতা আবৃত্তিও করতেন। বেতারের গান রচয়িতা হিসেবে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। পাশাপাশি বেতারের জনপ্রিয়তার পিছনেও তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। ১৯৩০ সালের দিকে নজরুলের গান বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিল। সেই সময়ে যে-সমস্ত গান রচিত হত, সেইগুলোর পরিচয় ছিল আধুনিক গান হিসেবে। নজরুলের বহু গানও একটা সময় পর্যন্ত আধুনিক গান হিসেবেই পরিচিত ছিল। পরে তাঁর গান নজরুল ইসলামের গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আরও পড়ুন-বিরাটের ফর্ম নিয়ে ভাবছি না : রোহিত
এলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
কাজী নজরুল ইসলামের কিছু পরেই বেতারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯২৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে কণ্ঠ পরীক্ষা দেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে তাঁকে মনোনীত করা হয়নি। পরে তাঁকে বেতারের নাট্যদলে যুক্ত করে নেওয়া হয়। বিশেষ ধরনের কণ্ঠস্বর তাঁকে এই সুযোগ করে দেয়। সেই সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ রেলওয়েতে চাকরি করতেন। বেতারে কাজের জন্য তিনি রেলওয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দায়িত্ব পান নাটক পরিচালনার। সেই বছর ২১ অগাস্ট তাঁর পরিচালনায় প্রচারিত হয় পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ। নাটকটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই সাফল্যের জন্য পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। পরবর্তীকালে তিনি বেতারে বহু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন।
আরও পড়ুন-নিলাম চলাকালীন সংজ্ঞাহীন সঞ্চালক
এই প্রসঙ্গে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। প্রথমে ১৯৩১ সালে দুর্গাপুজো উপলক্ষে বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানে চণ্ডীর শ্লোক আবৃত্তি করেন বাণীকুমার। অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর ভোরে কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে দুর্গাপুজো উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে ‘মহিষীসুরমর্দিনী’ নামের একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। গ্রন্থনা করেন বাণীকুমার, সংগীত পরিচালনায় পঙ্কজকুমার মল্লিক। ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অনুষ্ঠানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিবর্তে মহানায়ক উত্তমকুমারকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছিল। নাম ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’। সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানগুলো গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে প্রমুখ। কিন্তু অনুষ্ঠানটি একেবারেই সফল হয়নি। পরে সেই অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি মহালয়ার ভোরে বেতারে সম্প্রচারিত হতে থাকে।
আরও পড়ুন-নিলাম চলাকালীন সংজ্ঞাহীন সঞ্চালক
বেতার জগৎ
১৯২৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। আত্মপ্রকাশ করে কলকাতা বেতার প্রকাশিত পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’। প্রথম সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন তাঁর সহযোগী। ১৯৩০ সালে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পত্রিকার সম্পাদক পদ ছেড়ে দিয়ে বীরেন্দ্র সরকার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত নিউ থিয়েটার্স চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। জানা যায়, বেহালার জমিদার বীরেন রায় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন। দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এই পত্রিকা।
ছোটদের অনুষ্ঠান
‘গল্পদাদুর আসর’ কলকাতা বেতারের খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। একটা সময় পরিচালনা করতেন পার্থ ঘোষ। তার আগেও বেশকিছু ছোটদের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে। ১৯২৯ সালের জুন মাস থেকে ‘ছোটদের বৈঠক’ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। পরিচালনায় ‘গল্পদাদা’ ছদ্মনামের আড়ালে যোগেশচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট। ছোটরা মুখিয়ে থাকত এই অনুষ্ঠানটির জন্য। ১৯৪৩ সালের ১৫ অগাস্ট কলকাতা বেতারে যোগ দেন ইন্দিরা দেবী। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঘোষিকা। ১৯৪৫ সালের অগাস্ট মাসে তিনি শুরু করেন ‘শিশুমহল’ অনুষ্ঠান। টানা ৩৭ বছর অনুষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন-প্রথম ম্যাচেই হার মিতালিদের
বেতারে গুরুত্ব দেওয়া হত খেলাকেও। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হয়েছিল ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী। পরে শুরু হয় ক্রিকেটের ধারাবিবরণী।
সংবাদ
১৯৩৩ সালে কলকাতা বেতারে বাংলা সংবাদ পরিবেশন শুরু হয়। সেই সময়ে স্থানীয় সংবাদের দায়িত্বে ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ সেন। কিছুদিন পরে সংবাদ বিভাগে যোগদান করেন বিজন বসু, বিভূতি দাস প্রমুখ। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পরিবেশিত হত সংবাদ। পরবর্তীকালে দিল্লি কেন্দ্রের সংবাদও শোনানো শুরু হয়। ১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল, কলকাতায় চালু হয় ‘রিজিওনাল নিউজ ইউনিট’ বা ‘আঞ্চলিক সংবাদ বিভাগ’। সেই বছর থেকেই বিভিন্ন বেতারকেন্দ্রে প্রযোজক নেবার ব্যবস্থা হয় চুক্তির ভিত্তিতে। এরফলে বেতারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হয় অনেকের।
স্বাধীনতা দিবস
আরও পড়ুন-হস্তশিল্পীদের সহায়তা দিতে শুরু খাদিমেলা
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীন হয়েছিল ভারতবর্ষ। স্বাধীনতা দিবসের আগে ১৪ অগাস্ট রাত এগারোটায় কলকাতা বেতারের বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস, প্রবোধ কুমার সান্যাল, অমল হোম, নিরঞ্জন মজুমদার প্রমুখ। মধ্যরাতে ভারতের সব ক’টি বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারিত হয় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি থেকে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদাত্ত কণ্ঠের ভাষণ। সেই ভাষণ শুনেছিলেন অগণিত শ্রোতা।
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কলকাতা বেতার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পরিবেশিত হত খবর। প্রণবেশ সেনের লেখা ‘সংবাদ পরিক্রমা’ দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জলদগম্ভীর কণ্ঠে শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন দুই বাংলার মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই পরিবেশনা প্রেরণার কাজ করত। সেইসময় ‘সংবাদ পরিক্রমা’ প্রযোজনা করতেন উপেন তরফদার।
আরও পড়ুন-ঈশান-চাহারই সব থেকে দামি
এখন বেতার
হাতের মুঠোয় পৃথিবী। টেলিভিশন, প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা। এসেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি রেডিও চ্যানেল। তারমধ্যেও উৎকৃষ্টমানের অনুষ্ঠান পরিবেশন করে চলেছে সরকারি বেতার মাধ্যম আকাশবাণী কলকাতা। গীতাঞ্জলি, সঞ্চয়িতা, মৈত্রী, বিবিধ ভারতীর পাশাপাশি এফএম রেনবো এবং এফএম গোল্ড আনন্দ দিয়ে চলেছে শ্রোতাদের। একটা সময় কিছু মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে আবার শ্রোতারা রেডিওমুখী হয়েছেন। রেডিও সেট ছাড়াও এখন টেলিভিশন সেট ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও শোনা যাচ্ছে বেতার অনুষ্ঠান। নিছক মনোরঞ্জনের জন্য নয়, গুণগত মান বজায় রাখাই ছিল বেতারের প্রধান উদ্দেশ্য। সেই ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। প্রাত্যহিকী, মহিলা মহল, কথিকা, শ্রবণী, বাংলার মুখ, শহর কলকাতা, সমীক্ষা, গানের ভেলা, বিদ্যার্থীদের জন্য, আজকের চাষবাস, জানা অজানা, উত্তরণ, আপনার স্বাস্থ্য এই সময়ের কলকাতা বেতারের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বিভিন্ন সময় বহু বিখ্যাত মানুষ যুক্ত থেকেছেন বেতারের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বেতার ঘোষক ও সংবাদপাঠক। ১৯৫৭ সাল থেকে প্রায় দুই বছর তিনি সুনামের সঙ্গে করেছিলেন এই কাজ। এছাড়াও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় নীলিমা সান্যাল, গৌরী ঘোষ, মিহিরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ চক্রবর্তী, বরুণ মজুমদার, ছন্দা সেন প্রমুখের নাম। প্রত্যেকেই কণ্ঠ দিয়ে মায়াজাল বিস্তার করেছেন। এঁদের বাইরে আছেন আরও অনেকেই। কেউ স্থায়ী বা অস্থায়ী কর্মী, কেউ শিল্পী। বেতারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন প্রত্যেকেই।
আরও পড়ুন-ঘর গুছিয়েও প্রশ্ন সেই নাইটদের নিয়ে
কথা হল বেতার-ব্যক্তিত্ব দেবাশিস বসু-র সঙ্গে। তিনি জানালেন, আকাশবাণীর আর্কাইভ এককথায় রত্নভাণ্ডার। আছে রেকর্ড করা বহু মূল্যবান অনুষ্ঠান। এমনটি সম্ভবত আর কোথাও নেই। লাইভ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে রেডিওতেই। কত গুণী শিল্পীর পায়ের ধুলো পড়েছে আকাশবাণী ভবনে। আমরা তাঁদের সান্নিধ্য পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছি। আকাশবাণী আমাদের কাছে নাম করার জায়গা ছিল না, এটা আমাদের কাছে ছিল মন্দিরের মতো। শেষে দুই লাইনে বলি : আরজে ডিজের দারুণ চল, টিআরপি টানাটানি/ এরই মাঝে স্মৃতি সফল আজও আকাশবাণী।
আর কয়েক বছর পর শতবর্ষে পা রাখবে ভারতের বেতার সম্প্রচার। নিত্যনতুন রুচিশীল অনুষ্ঠান নিয়ে আরও বেশি শ্রবণশিল্পীদের কাছে পৌঁছে যাক ঐতিহ্যবাহী এই শ্রাব্য মাধ্যমটি। আমরা কান পেতে রই…