আর ঠাঁইনাড়া নয়। থিতু হল বইমেলা। সুনির্দিষ্ট ঠিকানা পেল কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণে সাহিত্যিক আবুল বাশার
আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব শান্তভাবে অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, শুনলে মনে হবে, সিদ্ধান্তটি যেন বা স্বতঃস্ফূর্ত— এটি কি তাঁর কাজ করার নিজস্ব স্টাইল? এবারের বইমেলা, আমাদের এই বার্তা দিয়েছে যে, যতবার বইমেলা হয়েছে, তার মধ্যে বর্তমান বইমেলাটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ এবং মনে রাখার মতো বইমেলা। ধন্যবাদ জানাতে হয় পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সভাপতি সুধাংশুশেখর দে— এই দুই কর্ণধারকে। তাঁদের সুবিবেচনাপ্রসূত এই মেলার থিম কিন্তু বাংলাদেশ। অন্য কোনও বাইরের দেশ নয়। কারণ এই বছর তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে একসূত্রে বেঁধেছে আর তা হল, এ বছরই ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হল। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স হল ৫০ বছর আর এ বছরই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। এই তিনটি কালবিন্দুকে স্মরণীয় রূপে এই বইমেলায় মিলিয়ে দেওয়ার কাজটি গিল্ডেরই ঐতিহাসিক খাতায় জমা হল— যা উভয় বাংলায় বাঙালি মনে রাখবে এগিয়ে চলার প্রেরণা হিসেবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ফসয়ের এই মিলন-বিন্দুটিকে আলাদা তাৎপর্যে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে।
আরও পড়ুন-ছ’বছর বাদে ঘাসের কোর্টে ভারত, ডেভিস কাপে সামনে ডেনমার্ক
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, সেন্ট্রাল পার্ক যেন বইমেলার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক এই বইমেলা এতকাল যেন বা যাযাবরের মতো কখনও ময়দানে, কখনও মিলনমেলায়, কখনও যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অস্থায়ী খেপ ফেলে ঘুরে মরেছে। ত্রিদিবের আবেদনে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ বইমেলা জয়যুক্ত হল এই বলে যে, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিলেন, জায়গাটাও বড়, সুতরাং সেন্ট্রাল পার্কই হোক ‘বইমেলা প্রাঙ্গণ’— সেন্ট্রাল পার্কের তাই গৌরবজনক নতুন নাম হল ‘বইমেলা প্রাঙ্গণ’। কখন মুখ্যমন্ত্রী এই কথা ঘোষণা করছেন, কোন কালবেলায়? যখন রাশিয়া একটি দুর্বল দেশ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সারা বিশ্বে বিশ্বশান্তি অসম্ভব বিপন্ন। তা হলে কি মহামারী শেষ হয়নি। মহাযুদ্ধ শুরু হল? করোনার দাপট কতক শান্ত হয়েছে, স্কুল-কলেজ সবেমাত্র সাহস করে খুলেছে, বইমেলা গত বছর হতে পারেনি— প্রথম দিনেই বইমেলা মুক্তবুদ্ধি-মুক্তপ্রাণ পাঠকের ভিড়ে উচ্ছল। কিন্তু কোথাও যুদ্ধের বিভীষিকা তার ডানা মেলছে। এই অবস্থায় বিশ্বশান্তির জন্য আবেদন ধ্বনিত হল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। কেন না ওয়ার ক্রাইম শুরু করেছে রাশিয়া। ভারতই শান্তি আনুক—এটাই মমতার প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে।
আরও পড়ুন-বাড়িতে পেলে
যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থান কী হবে? পৃথিবীর মহৎ গ্রন্থগুলি চিরকাল শান্তির কথা বলেছে। শান্তিকল্যাণ চেয়েছেন নিসর্গের ছায়াঘন বিপুল বিস্তারে কবি জীবনানন্দ দাশ, এই পৃথিবী এক মহাকায় জীব বিশেষ—যুদ্ধাস্ত্রে একে আঘাত করলে এ পৃথিবী নিদারুণ কষ্ট পায়— আগামী দিনে পৃথিবীকে রক্ষার দায়িত্ব নিক বই।
এই অবস্থার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুটি অভিমুখ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল মুখ্যমন্ত্রীর কথায়।
বাংলাদেশ আর বাংলা। এবং বিশ্ব।
সুভাষদা (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়) লিখেছিলেন— ‘ওপারের যে বাংলাদেশ, এপারেও সেই বাংলা।’
ঠিক সেই কথাটাই, মমতা বললেন, তাঁর সহজ-শান্ত বয়ানে, ‘‘বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু আমরা একে আলাদা করতে পারি না। দুই বাংলার সম্পর্কের সীমানা দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া যায় না।’’ এই সমবেত ঐতিহ্যই মমতার বাংলার অভিমুখ। দ্বিতীয় অভিমুখ শান্তিকল্যাণ। বিশ্বশান্তি।
আরও পড়ুন-মোহালিতে বিরাটের সেঞ্চুরি চাই : সানি
মর্মান্তিক সত্য এই যে, যখন আমরা প্রায় কোভিড-মুক্ত জীবন-পরিবেশ খুঁজে নিচ্ছিলাম, তখনই যুদ্ধের নান্দীরোল শোনা গেল।
তারই মধ্যে রসসাহিত্যের রাজা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে সম্মাননা জানাল গিল্ড। ‘আর পি গোয়েঙ্কা সৃষ্টি সম্মান’ জ্ঞাপনের মাধ্যমে। মুখ্যমন্ত্রী সঞ্জীবদাকে যেভাবে বরণ করলেন তা বাংলার দিদিরই যোগ্য। আমরা দেখলাম দুটি সঞ্জীবিত মনের মাধুর্য। আমারই সৌভাগ্য, সাক্ষ্য রইলাম, যুদ্ধের ভয়, অসহায় মানুষের আর্তনাদ, তবু বাংলার মনের মাধুর্য আর শান্তিই মিশে রইল বইমেলায় এবারের মুখ্যমন্ত্রী কথিত বইবেলার সন্ধ্যায়, সমস্ত বাতাসে ও প্রাঙ্গণে।
আমারই চােখের সামনে।