মোদি সরকারের ব্যর্থতার খতিয়ান পেশ করল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। গত ৮ এপ্রিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে অর্থনৈতিক কমিটির রিপোর্ট গভর্নর শক্তিকান্ত দাস প্রকাশ্যে আনলেন তাতে দেখা গেল মুদ্রাস্ফীতির হার সাড়ে চার শতাংশ অনুমানকে অনেকটা ছাড়িয়ে যাবে। ১২০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে সেটা হতে পারে ৫.৭ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ছয় শতাংশ ঊর্ধ্বসীমা ছাড়িয়ে গেলে বিপদসীমা অতিক্রান্ত হয়েছে বলে ধরা হয়। মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
আরও পড়ুন-মৃত্যুকে বাজি রেখে অপারেশন
আন্তর্জাতিক বাজারে ন্যূনতম বিনিময় হারের ভিত্তিতে টাকার সাপেক্ষে রান্নার গ্যাসের দাম ভারতেই সবথেকে বেশি। পেট্রোলের দামে তৃতীয় ব্যয়বহুল দেশ, ডিজেলে অষ্টম। প্রতিদিন কাঁচা আনাজ থেকে পরিবহণ খরচ ঊর্ধ্বমুখী। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন যে উন্নয়নের থেকেও আমরা জোর দিচ্ছি দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে। বিষয়টা গুরুতর প্রধানত দুটো কারণে। এই ৫.৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ২০২২-২৩-এর গড় বৃদ্ধির হিসাব। এবং এই হিসাব কষা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১০০ মার্কিন ডলারের থেকে বাড়বে না এটা ধরে নিয়ে। ইউক্রেন সঙ্কট কী হবে, তার ওপরে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর অনেকটা নির্ভর করবে। ফলে মূল্যবৃদ্ধি যে গড় ৫.৭ শতাংশের থেকেও বেশি হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। এই গড় অঙ্ক কষতে গিয়ে দেখা গিয়েছে প্রথম ত্রৈমাসিকে মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৩ শতাংশ। অর্থাৎ জুন মাস পর্যন্ত আরও বেশ কয়েকবার রান্নার গ্যাস, পেট্রোল-ডিজেল থেকে শুরু করে খুচরো বাজার ও পাইকারি বাজারে দাম বাড়তে চলেছে। এখনই মধ্যবিত্ত মানুষ ধুঁকছেন, আগামী দু’মাসে শোচনীয় অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক শুনিয়ে রাখল।
আরও পড়ুন-এক হাজার কোটির বেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানও
এই মুদ্রাস্ফীতির মতো কঠিন অসুখের কারণ নির্ণয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, যে ভারতের টাকার বাজারে সাড়ে আট লক্ষ কোটি অতিরিক্ত টাকা ব্যবসায়ী বা সচ্ছল মানুষের হাতে নগদ হিসাবে রয়েছে। করোনার সময়ে নাকি পাঁচ লক্ষ কোটি নগদ বাজারে ঢালার কথা হয়েছিল এবং পরে তা বাতিল করা হয়েছিল বলেই মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পায়নি। অর্থনীতির সূত্র অনুসারে, মুদ্রাস্ফীতিতে লাগাম টানতে গেলে সুদের হার বাড়াতেই হবে। সুদের হার বাড়লে ব্যাঙ্ক জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, মানুষ বাড়ি বানাতে বা গাড়ি কিনতে বা ধার করে খরচ করতে চায় না, ফলে চাহিদা কমে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পৃথিবীর সব দেশেই এই নিয়ম মেনেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদের আর্থিক নীতি ঠিক করে। সুদের হার বৃদ্ধি পেলে অবশ্য বিনিয়োগ ধাক্কা খায়। মুদ্রাস্ফীতি যেখানে হয়, সেখানে জাতীয় আয়ও বৃদ্ধি পায়, তাই সুদের হার বাড়ানোর কথাই সাধারণত বলা হয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমানে আমরা অন্যরকম ছবিই দেখতে পাচ্ছি। মুদ্রাস্ফীতিও হচ্ছে অতিরিক্ত মাত্রায় আবার মোট উৎপাদন ও জিডিপিরও গ্রোথ রেট আশানুরূপ বাড়ছে না।
আরও পড়ুন-পারলেন না ভোট দিতে
মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হার ৭.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭.২ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। এই উন্নয়নের গণিতটা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ রিপোর্ট অনুযায়ী দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক ৬২%, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ৪.১% এবং শেষ ত্রৈমাসিক ৪% শতাংশ হারে মোট আয় বাড়বে। জিডিপি বছরে ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে যদি প্রথম ত্রৈমাসিকে তা ১৬.২ শতাংশ বাড়ে তবেই। ছয় সদস্যের আর্থিক নীতি কমিটির এই বিশ্লেষণ কি অলীক কল্পনা বলে মনে হচ্ছে না? গত ৪-৫ দশকের বোর্ড ভেঙে বেকারত্ব ঊর্ধ্বমুখী, করোনাতে চাকরি খুইয়ে মানুষ দিশাহারা এবং জিডিপি-র এই নিম্নগামী হার, নীতি নির্ধারক কমিটির তাই সুদের হার পরিবর্তন করা সাহসে কুলায়নি।
আরও পড়ুন-হাইকোর্টের আস্থা রাজ্য পুলিশেই
আর্থিক নীতি বিবেচনার মিটিং শেষে শক্তিকান্ত দাস এক সাংবাদিক বৈঠকে গত ৮ তারিখে নতুন একটি টুল বা নিয়ন্ত্রকের কথা বলেছেন। ভারতের আর্থিক নীতিতে এটি নবতম সংযোজন — নাম SDF বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফেসিলিটি। তাঁর আশা, এর ফলে ২-৩ বছরের মধ্যে বাজার থেকে অতিরিক্ত ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা নগদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ফেরত আসবে এবং মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেছেন, এই ওষুধ কাজ করবে ২-৩ বছর ধরে। ফলে ওই ২-৩ বছর দেশের মানুষ মুল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকা খাবে এবং সরকার তা চুপ করে দেখবে। SDF হল এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে ব্যাঙ্কগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে টাকা গচ্ছিত রেখে সুদ পায়। বর্তমানে রিভার্স রেপো রেটের মাধ্যমেও ব্যাঙ্কগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের যা সুদ দেয়, SDF-এ তার থেকে ০.২৫% বেশি সুদ দেবে। শুধু তাই নয়, বর্তমান ব্যবস্থায় ব্যাঙ্কগুলোকে নগদের বদলে সরকারি ঋণপত্র বিনিময় করতে হত। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র নগদ রাখলেই চলবে। ফলে বাজার থেকে নগদ কিছুটা উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, এটা দীর্ঘকালীন ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, শুধু সচ্ছল ব্যাঙ্কগুলো এই সুবিধা নিতে পারবে। তৃতীয়ত প্রকৃত (রিয়েল) সুদের হার ঋণাত্মক হওয়ার ফলে, এই ব্যবস্থা কতটা সফল হবে তা বলা মুশকিল। তবে এই প্রবণতা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, আগামী দিনে দেশকে আরও কর্মী ছাঁটাই এবং বেকারত্ব গ্রাস করতে চলেছে।
আরও পড়ুন-বালিগঞ্জে তিনি নেই, তবুও তাঁকে নিয়েই চর্চা
বিজেপি নেতাদের প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, যে রাজ্য সরকার দান খয়রাতি করছে, বিধবা ভাতা, বার্ধক্যভাতা, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মাধ্যমে এবং এই অর্থ আসছে ঋণ করে। কিন্তু রাজ্য সরকারের ঋণ করার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। তাই রাজ্য সরকারের ঋণের পরিমাণ লাগামছাড়া কখনওই হতে পারে না। উল্টোদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের এই ঋণের সীমার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তাই ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ওপেন মার্কেট অপারেশন করে যে ঋণ করেছিল ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে তা ছিল অভূতপূর্ব। ২০১৮-১৯-এ মোদি সরকার ২,৯৯,২৩২ কোটি টাকা বন্ড ছেড়ে টাকা ছাপিয়ে তুলে নিয়েছিল, যা ছিল ২০১৭-১৮-র তুলনায় ৫২ শতাংশেরও বেশি। এর ফলে বাজারে যে অতিরিক্ত লিক্যুইডিটি বা নগদের জোগান বেড়ে গিয়েছিল তারই প্রত্যক্ষ ফলাফল হল বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি। এখন তাই আবার ব্যাঙ্কগুলোকে বেশি সুদের প্রলোভন দেখিয়ে SDF-এর মাধ্যমে নগদের জোগান বাজার থেকে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
আরও পড়ুন-শিক্ষকদের ক্লাসে মোবাইল নিষিদ্ধ
মোদি সরকারের ভুল পলিসির জন্য ওপেন মার্কেট অপারেশনে যে মানি সাপ্লাই বাজারে বেড়ে গিয়েছিল, তাকে সংশোধন করার জন্য যে SDF পদ্ধতি নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা নিতান্তই দুর্বল। ফলে ভুগতে হচ্ছে জনগণকে, চড়া মূল্যবৃদ্ধির মাশুল গুনতে হচ্ছে। যুদ্ধের দোহাই দিয়ে, জোগানের স্বল্পতার যুক্তি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে অতীতের ভ্রান্তনীতিকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে।