‘ঝি’ শব্দটা এখন ডিকশনারিতে ‘অসংস্কৃত’। ‘কাজের মেয়ে’টা সাধারণভাবে চালু! আরও একটু পরিশীলিত ভাবে বলা হয়ে থাকে ‘ডোমেস্টিক হেল্প। কিন্তু ওই যে ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকো’ থিওরি ধরতে গেলে বা ‘নামে কী আসে যায়’ বলতে গেলে, এই ছবিটাও একই থেকে যায়। অর্থাৎ নামে যে বিপ্লবই আসুক মানুষগুলোর জীবন একই আছে, কাজের ক্ষেত্রও। বাহ্যিক আচরণ খানিক বদলালেও মানসিকতার বদল খুব বেশি কিছু হয়েছে কি? হলেও শতাংশের হিসেবে সত্যিই নগণ্য। তাই দু-একটা মানবিক কাহিনি এই ‘ক্লাস’-এর মানুষগুলোর না জীবন বদলাতে পেরেছে না যাপন। উল্টে সাম্প্রতিক সময় আরও বিড়ম্বনা যোগ করেছে তাদের জীবন যুদ্ধে। হ্যাঁ, কোভিড কাল সংগঠিত সেক্টরেই যে হারে আঁচড় কেটেছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের তো কোনও কথাই নেই। এই ক্ষেত্রগুলি আহত, রক্তাক্ত ও বিপর্যস্ত। তাই ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে যে দাবি নিয়ে শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিলেন এবং পুলিশের নির্বিচার গুলিতে তাদের একাধিক জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে পরবর্তীতে নিজেদের জন্য একটি দিন পেলেও, দিন বদলের যে স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন তার বেশিরভাগটাই এখনও স্বপ্নই থেকে গেছে। তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হল এই ‘পরিচারিকা’ গোষ্ঠীর নিরানব্বই শতাংশ জানেই না তারা কোন ক্ষেত্র? সংগঠিত বা অসংগঠিত শব্দগুলির কী মানে। তাতে কী হয়! কী বদলায়? তাই কাকভোরে উঠে তারা সংগঠিতভাবে দৌড়ায় আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অসংগঠিত জীবনের সঙ্গে লড়াই করে।
পিয়ালি থেকে পাঁচটার ট্রেন ধরে সবিতা। তাকে পৌঁছতে হয় বালিগঞ্জ। দাদার অফিস, বউদির কলেজ, ছেলে-মেয়ের স্কুল সব পিঠোপিঠি।
আরও পড়ুন-দুই চ্যানেলে দুই নতুন ধারাবাহিক
চারজনের ব্রেক ফাস্ট, টিফিন গুছিয়ে দিতে হয় মেশিনের গতিতে। আটটার মধ্যে চারজনেই বেরিয়ে যায়। বাড়ির বাকি সব সারতে সবিতা দম ফেলার তর পায় না। দুপুরে ছেলেমেয়েরা ফিরলে তাদের খাইয়ে, সব গুছিয়ে তবে ছুটি। সবিতা ছাড়া বউদি অন্ধ। বড় ঘরের মেয়ে, কোনওদিন হাত নেড়ে কিচ্ছুটি করেনি। সবিতা শুনেছে বউদির মুখেই। তাই জ্বর হোক, জীবনের জ্বালা হোক, এমনকী কোনও পার্টির ধর্মঘট হোক, সবিতা চট করে কামাই করেনি। মাইনে ভাল যে। ওই মাইনেতেই যে তার তিনটে মেয়েদের ভাল থাকা। স্বামী ছেড়ে পালিয়েছে তিন নম্বরটিও মেয়ে হওয়ায়। লড়াইটা সবিতা লড়ে নিচ্ছিল। বাদ সাধল ওই পোড়ামুখ ভাইরাস। লকডাউনের ক’মাস ধারকর্জ করে চালিয়ে ছিল। জানত সব চালু হলেই বউদির থেকে বাকি মাইনে পেয়ে যাবে। ফোনে ব্যালান্স ভরা ছিল বিলাসিতা। তাই যেদিন প্রথম সুযোগ পেল সেদিনই বউদির বাড়ি পৌঁছে বেল বাজিয়েছিল। দরজা খুলেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল বউদি। যেন সবিতার শরীর-ভর্তি ভাইরাস! সঙ্গে সঙ্গে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল মুখের ওপরেই। ভেজানো দরজার ওপার থেকে সবিতা জানল তার কাজটা চলে গেছে। বউদির আর তাকে লাগবে না। এক মাসের মাইনে পেল। লকডাউনে তো সবারই টানাটানি, তাই! তাছাড়া সবিতা তো তিনমাস কাজে আসেনি। পুরো মাইনে কেনই বা পাবে! পাল্টা কিছু বলার কথা জোটাতে পারেনি সবিতা। পেল্লাই কাঠের দরজাটা যে মাঝখানে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখেছিল কলিং বেল স্যানিটাইজার দিয়ে মুছতে ভীষণ ব্যস্ত বউদিকে। ওই শেষ দেখা। বড় কলেজে পড়ানো বউদি তো বাড়ির কাজ কিছু পারতই না। তিনমাসে সব কাজ শিখে গেল?
আরও পড়ুন-বিরাট-রোহিত ঠিক রানে ফিরবে : সৌরভ
সবিতার গল্পটা হুবহু সবার গল্প নয়। কিন্তু অনেকটাই একরকম অনেকের। লকডাউনে পুরো মাইনে পাওয়া, পুরনো কাজে বহাল থেকে যাওয়া সবিতাদের সংখ্যা হাতেগোনা। অনিশ্চিত জীবিকা সে তো জানাই ছিল কিন্তু জীবনও যে এমন অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে সেটা হিসেবে ছিল না। যদিও লকডাউন ‘শাকের আঁটি’, বোঝাটা বরাবরই ছিল। সঙ্গে ছিল আনুষঙ্গিকও। ছুটি বাড়তি হলে মাইনে কাটা, কাজে দেরিতে পৌঁছলে কথা শোনা, সময়ে মাইনে হাতে না পাওয়া, বোনাস পেতে কালঘাম ছুটে যাওয়া ইত্যাদি, প্রভৃতি। উল্টো ছবিও আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু ওই, ব্যতিক্রম। যা নিয়মকেই প্রমাণ করে। আসলে গৃহ-পরিচারিকারা শ্রমিকের মর্যাদাও পায়নি কোনওদিন,যা ন্যূনতম চেতনা এনে দেয়। এ এমন এক বিস্তৃত ক্ষেত্র যেখানে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি। এ এমন পোড়া দেশ যে দেশে মেয়েদেরই মর্যাদা নেই তো তাদের শ্রমের। তাই সবিতা, সোনালি, শ্যামলী, মালতী, কল্পনা, সায়রা, শিখারা মরীয়া দৌড়ায় রোজ। দৌড়েই যায়। শুধু কাজের জন্য নয়, কাজ টিকিয়ে রাখার জন্যও। সয়ে নেয়, সইয়ে নেয়, সহ্য করে নেয়। কিন্তু দৌড়য়। এত করেও কাপড়ের ময়লা, মেঝের দাগ কিংবা বাসনের কালি ঘষে তুলে ফেলে কিন্তু কপাল ফেরাতে পারে না। হ্যাঁ, ওরা কপালের নামেই বাঁচে কারণ বিপ্লব এখনও ওদের বাঁচায়নি।
আরও পড়ুন-দুঃসময়ে চাহাল ছিল : কুলদীপ
পরিসংখ্যান বলছে, পরিচারিকার কাজ এ দেশের জনপ্রিয়তম পেশার প্রথম সারিতে! কারণ কোনও রঙের বিপ্লবই দেশে সার্বিক শিক্ষার চিত্রটা খুব কিছু বদলাতে পারেনি। আর শিক্ষার সঙ্গেই সরাসরি সম্পর্কিত পেশা। পেশার যোগ্যতা। পেশার মান। যেহেতু পরিচারিকার কাজে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন নিমিত্ত মাত্র, প্রশিক্ষণও তেমন প্রয়োজন পড়ে না তাই এই পেশার প্রতি ঝোঁক সমাজের সেই স্তরের মেয়েদের মধ্যে ভীষণ বেশি যে স্তরে শিক্ষার আলো সেভাবে পৌঁছতেই পারেনি। নেই-রাজ্যের ছবি তাই শুরু থেকেই প্রবল। শ্রমের মূল্য অনুযায়ী মাইনে নেই, অভিজ্ঞতার মূল্য স্বরূপ কাজের নিশ্চয়তা নেই, নেই কোনও ধরনেরই রক্ষাকবচ, কিন্তু যেটা আছে, সুযোগ। প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা না লাগার কারণে কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতাও কম। তাই উপার্জনের জন্য সহজলভ্য পেশাগুলির অন্যতম এই পরিচারিকার পেশা। এর সঙ্গে বেশির ভাগেরই বাড়ির চিত্রটা প্রায় সমান। ১৪-১৫ বছর বয়সেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলে। সোনার আংটি আবার বাঁকা-ট্যারা। তাই কার সঙ্গে বিয়ে দিল তার পেশার খোঁজ খুব একটা মানে রাখে না। সবাই তো একই নৌকার যাত্রী। বেশিরভাগ পরিচারিকার স্বামীই বেকার বা ন্যূনতম যে রোজগারটা করে তা চলে যায় জুয়া কিংবা মদের ঠেকে। সংসার চালু রাখার দায় বর্তায় তাই মেয়েদের ওপরেই। কারণ নেশা করে বাড়ি ফিরে মুখের সামনে ভাত না পেলে চালু হয় মারধর, অকথ্য অত্যাচার। নিস্তার পায় না বাচ্চারাও। খালি পেটে যে বাড়ির মানুষগুলোও আছে সে বোঝার ক্ষমতা তখন তার কোথায়। এর সঙ্গে কোভিড-কালের কালো ছায়া বিস্তৃত হয়েছে আরও অনেকদূর। কারণ কর্মচারী, ড্রাইভার, হকার, কন্ডাক্টর এরকম হাজারো পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকা হাজার হাজার মানুষ এ সময়ে কর্মহীন হয়েছে। সংসার চালাতে অগত্যা ভরসা বাড়ির বউ কিংবা মেয়েরাই। কেউ রান্না, কেউ ঠিকে, কেউ আয়ার কাজ পেতে মরীয়া। অবস্থার সুযোগ ছাড়ার মানুষ ক’জনই বা হয়। তাই কাজ অনুযায়ী মূল্য পাচ্ছি কি না ভাবার সুযোগ থাকে না। যে মূল্যটা জুটছে সেটাই যে অমূল্য।
আরও পড়ুন-‘চোট থাকলে অন্য কথা’, কামিন্সকে দলে না দেখে অবাক হয়েছেন যুবরাজ
এমত অবস্থায় তারা ভাববে কী করে তাদের বিমার ব্যবস্থা নেই। যাতায়াতের সুরক্ষা নেই। মাইনের রসিদ নেই। নির্দিষ্ট ছুটির দিন নেই। এছাড়াও একটা বয়সের পর যখন তারা কর্মক্ষমতা হারায় তখন কোথাও কোনও সাহায্যের আশ্বাস নেই, দিন-রাতের ‘খাওয়া-পরা’র কাজের মৌখিক চুক্তির খেলাপ হলে কোনও আইনি সুরক্ষার উপায় নেই, আচমকা ছাঁটাই হলে কোথাও অভিযোগ জানানোর মূল্য নেই, নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায় করার জন্য কোনও আন্দোলনের কথা যে ভাবা যেতে পারে তার কোনও ধারণাও নেই। তাই সবটাই ছাড়া থাকে মালিক পক্ষের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর। যার পরিণতিতে পরিচারিকাদের নানারকম শোষণের পথ খোলা থাকে আর তার শিকার হয় ভাগ্যের দোহাই দিয়ে। এদের ছেলেমেয়েরা কেউ স্কুলে যায় বা কেউ যায় না। কিছুজন চেষ্টা চালালেও বাকিরা অন্ধকার জগতে ক্রমশ হারিয়ে যায়। ছেলেরা ছেলেদের মতো করে মেয়েরা মেয়েদের মতো। সব উদ্যোগ সরকারি স্তরে হয় না হয়তো, এগিয়ে আসতে হয় মননশীল মানুষদেরও। মানবিক হতে হয়। মরমী হতে হয়। দরদি হতে হয়। যে ‘তুচ্ছ’ কাজগুলি এই মানুষগুলোর দ্বারা সংঘটিত হয়, সেগুলি ছাড়া নিজেদের ‘মূল্যবান’ কাজগুলো যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে হতে পারত না সেটা একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় এদের মূল্য কত। বৈষম্য নিয়ে ভাষণ কাচের ঘরে বসে বা সেমিনার মঞ্চে দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেললে এ অবস্থার পরিবর্তন কোনওদিনই ঘটবে না। ঐতিহাসিক মে দিবস প্রতি বছর আসবে, চলেও যাবে। কিন্তু শ্রমের মূল্য অবহেলিতই থেকে যাবে আজীবন।
আরও পড়ুন-শ্রীলঙ্কার পর এবার নেপালও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকছে
ইদানীং কিছু সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। সান্ধ্য শিক্ষাকেন্দ্র, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির, বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাতে-কলমে নানাবিধ কাজ শেখার পাঠ চালু হয়েছে। সরকারি স্তরেও কিছু উদ্যোগের কথা ভাবা হয়েছে। গৃহ-পরিচারিকাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেওয়ার জন্য ভেবেছে রাজ্যের শ্রম দফতরও। প্রশিক্ষণের সময় দৈনিক ভাতা দেওয়ার পাশাপাশি পরে পাওয়া যাবে সার্টিফিকেটও। এই উদ্যোগের কারণ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে কাজে আসা মেয়েরা অনেক সময়ই আধুনিক যন্ত্রপাতিতে কাজ করতে গিয়ে থতমত খায়। তাই ওয়াশিং মেশিন, মিক্সার গ্রাইন্ডার, মাইক্রো ওভেন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদি মেশিন যাতে তারা ব্যবহার করতে শেখে তারই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এই সব শিবিরে। ইদানীং অনেকেই এগুলির ব্যবহার না জানায় কাজ পায় না বা কাজ হারায়।
আরও পড়ুন-বাথটব-ওআরএস-পাখা-শাওয়ার-মিষ্টি জল, বাঘ বাঁচাতে পদক্ষেপ
তবে শুধুমাত্র আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখাই নয়, সামাজিক শিষ্টাচার, আদব-কায়দা, হাসপাতাল বা ব্যাঙ্কের প্রাথমিক কাজকর্ম, এসব বিষয়েও ট্রেনিং দেওয়া হবে। বারুইপুরে ইতিমধ্যেই একটি শিবির হয়েছে পরীক্ষামূলক ভাবে। শতাধিক মেয়ে যোগ দিয়েছিল। বাকি আর কিছু শিবির হবে হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। ধীরে ধীরে রাজ্য জুড়েই করা হবে এই প্রশিক্ষণ শিবির। প্রশিক্ষণ শেষে নাম নথিভুক্ত করা হবে রাজ্য সরকারের তালিকায়। প্রয়োজনে সরকারি ভাবেও কাজে নিয়োগ করা যাবে এই তালিকা থেকে। থাকবে নিরাপত্তা। নিঃসন্দেহে সাধু উদ্যোগ। তবে বাস্তবে এই সুযোগ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য তা বোঝাই যায়। তবু যে কোনও কিছুর শুরু তো হওয়া দরকারই।
সরকারের ওপর সবটা না ছেড়ে নিজেরাও ছোট ছোট উদ্যোগে এই মানুষগুলোর পাশে যদি সকলে থাকি তবেই আমাদের গৃহ-পরিচারিকাদের জীবনটা সামান্য হলেও স্বস্তির হয়। কারণ নিত্যদিনের নানা কাজে এদের মতো কাজের মানুষ, কাছের মানুষ কমই মেলে জীবনে। দয়া নয় সহমর্মিতার হকদার এরা। শ্রমদিবসের প্রাক্কালে এটুকু ভাবনা নিয়েই না হয় উদ্যোগ শুরু হোক এবার।