পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় || তবলিয়া
খুবই শকিং নিউজ আমার কাছে, কারণ শিব’জিকে আমি দীর্ঘদিন চিনি। খুবই ডিসিপ্লিন্ড লাইফ লিড করতেন। জীবনের সব ক্ষেত্রেই ছিলেন খুবই নিয়ম ও নীতিনিষ্ঠ । একটা নির্দিষ্ট প্রদেশের সাপোর্টিং একটা ইন্সট্রুমেন্টকে সারা বিশ্বে যে এভাবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, সেটা পণ্ডিত শিবকুমার শর্মাই করে দেখিয়েছেন। ওই শান্ত সমাহিত চেহারার আড়ালে একটা অসম্ভব জেদ ও মনের জোর লুকিয়ে ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তীকালে যাঁরাই এই যন্ত্র বাজাতে এসেছেন, সকলে ওঁকেই অনুসরণ করেছেন। তাই চিরজীবন উনিই পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন।
আমি প্রায় চার দশক যাবৎ দেশে ও বিদেশে ওঁকে সঙ্গত করেছি। ওঁর যেটা বিশেষত্ব ছিল, নিজস্ব লয়কারী ও ছন্দ। একটা তালের মধ্যে বিভিন্ন তালের ছন্দকে প্রয়োগ করে যে সাবলীলতায় উনি করে দেখাতেন তা আর কারও পক্ষে সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। ওঁর সঙ্গে সঙ্গত করেছেন এমন প্রত্যেক তবলিয়া প্রচুর শিক্ষা পেয়েছেন ওঁর থেকে। আমি নিজেও পেয়েছি। শুধু তো স্টেজে সঙ্গত করা নয়, একসঙ্গে ট্যুর করার কারণে দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি। জেনেছি ডিসিপ্লিনের সঙ্গে সুর-তালের কী অদ্ভুত মাধুর্যের সম্পর্ক! আরও একটা ব্যাপার গান-বাজনাকে পেশাদারিভাবে দেখলেও কখনও চটুলভাবে দ্যাখেননি উনি। মানুষ হিসেবেও ছিলেন এক্কেবারে সাধুপুরুষ। কখনও কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। উল্টে কেউ সমসয়ায় পড়লে উনি সবার আগে এগিয়ে যেতেন তা সমাধানের জন্য। এ শুধু আমার অভিজ্ঞতা নয়, আমি নিশ্চিত শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে অনেকেরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। ঈশ্বরতুল্য মানুষ ছিলেন তাই হয়তো সাততাড়াতাড়ি তাঁর দেশেই চলে গেলেন। কিন্তু ওঁর বাজনাকে আমাদের কাছে রেখে গেলেন। ওটাই পাওনা।
আরও পড়ুন-সেবার দীপ জ্বেলে যাচ্ছেন যাঁরা
শুদ্ধশীল চট্টোপাধ্যায় || বিশিষ্ট সন্তুরবাদক
পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ছিলেন আমার গুরু। আমি ওঁর শিষ্য। তাই ওঁর এভাবে চলে যাওয়াটা আমার কাছে একেবারে ব্যক্তিগত শোক। সেটা সরিয়ে রেখেই বলি সেই লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা যা কিছু ওঁর মুখ থেকেই শোনা। কাশ্মীরি লোক-সংগীতের একটা সাপোর্টিং বাদ্যযন্ত্রকে উনি বিশ্বের দরবারে শাস্ত্রীয় সংগীতের এক প্রথম সারির বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রথম যখন উনি সন্তুর নিয়ে বম্বে গিয়েছিলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন ওই যন্ত্রে ক্লাসিক্যাল কেমন করে বাজবে! না এতে মিড় আছে, না আছে গমক। কারণ তখন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেব সেতার বাজাচ্ছেন ওরকম বড় বড় মিড় নিয়ে, ওরকম একটা এফেক্ট নিয়ে। গুরুজি একসময় হতাশ হয়ে গিটারের বার দিয়ে মিড় আনার চেষ্টা করেন কিন্তু সেটাও সেভাবে মানুষের কাছে অ্যাক্সেপ্টেড হয়নি। তখন তিনি ঠিক করেছিলেন, ওঁর নিজের কাছে যে ‘সাজ’ আছে সেটাই উনি এক্সপ্লোর করবেন। এবং শেষ অবধি বহু লড়াইয়ের শেষে মিড় এবং গমক ছাড়াও যে ক্লাসিকালি রাগকে এস্টাব্লিশ করা যায় সেটা গুরুজি করে দেখিয়েছিলেন। একজন ‘স্ট্রাগলার’-এর মতো করেই পুরোটা করেছিলেন উনি। এভাবেই ওঁর বাজনা ও যন্ত্রকে শেষ অবধি ক্লাসিকাল ফ্রাটারনিটি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-যুবভারতীতে আই লিগ ফয়সালার ম্যাচ, মার্কাসই আজ বড় ভরসা মহামেডানের
শুধু সেটাই নয় আমাদের ক্লাসিকাল গান-বাজনায় সাতপিঁড়ি-কে একটা ঘরানা হিসেবে ধরা হয়, গুরুজি একটা জন্মেই নিজের ঘরানা এস্টাব্লিশ করে দিয়েছেন। আমরা তো শুধুমাত্র সেটা ফলো করি। তবে হ্যাঁ, কিছু মহারথীদের পাশেও পেয়েছিলেন গুরুজি, যেমন, পণ্ডিত যশরাজ জি, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া জি, পণ্ডিত রবিশঙ্কর জি, ওস্তাদ আলি আকবর খান সাহেব, ওস্তাদ আল্লারাখা খান সাহেব। অনেকে প্রশ্ন তুললেও এঁরা ক্লাসিকাল মিউজিকের নতুন একটা স্ট্রিমকে তুলে ধরতে আগ্রহী ছিলেন। বাকি, একজন ছাত্র হিসেবে প্রথম দিন থেকে যেটা লক্ষ্য করেছিলাম যে, ভীষণ রকম পজিটিভ মানুষ ছিলেন গুরুজি। সব সময় বলতেন, “আচ্ছা হো রহা হ্যায় অউর থোড়া কুছ চিজে শুধর জায়েগা তো অউর আচ্ছা হো জায়েগা।” কখনও বলতেন না, হচ্ছে না। ওঁর শিক্ষা ছিল পারফেকশন আর পিওরিটিই হল মিউজিক। বৈচিত্র্যের প্রয়োজন আছে কিন্তু তার চেয়েও বড় হল ‘অ্যাপিল’ যা শ্রোতার হৃদয় ছোঁবে। আর একটা জিনিস আমি ফিল করতাম, যা কিছু উনি মিউজিক সম্পর্কে বলতেন সেগুলি কোনও না কোনও ভাবে অধ্যাত্মবাদেরও কথা। যেমন, উনি বিশ্বাস করতেন, ‘আত্মসমীক্ষায়’। আর বলতেন, মিউজিক অন্যের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, নিজের আত্মার শুদ্ধি ও সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত। গুরুজির এই আকস্মিক প্রয়াণে ওঁর এইসব কথাগুলোই বেশি মনে পড়ছে, সংগীত শিক্ষা ছাড়াও যা সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন-পরের আইপিএলেও খেলার ইঙ্গিত ধোনির
পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার || সরোদবাদক
শিব’জির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একেবারে গুরু-শিষ্যের মতোই ছিল। কিন্তু তার বাইরেও ওঁর প্রচুর স্নেহ-আশীর্বাদ পেয়েছি। ওঁর বাবার সঙ্গে অনুষ্ঠান করতেও উনি আমায় ডেকেছেন একাধিকবার। যতদিন শাস্ত্রীয় সংগীত বেঁচে থাকবে ততদিনই শিব’জির নাম অমর হয়ে থাকবে। আর সেটা শুধু একজন গুণী শিল্পী হিসেবে নয়, একজন লড়াকু কলাকার হিসেবেও। একটা ‘ফোক ইন্সট্রুমেন্ট’কে বিশ্ব-দরবারে হাজির করেছিলেন উনি অ্যাজ ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্ট। লয়, সুর সব নিয়ে যে ‘বাজ’টা উনি করেছেন তাতে সন্তুর যন্ত্রটার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে শিবকুমার শর্মার নাম আজীবনের জন্য থেকে যাবে। নিজে যেহেতু প্রথম জীবনে খুব ভাল তবলাবাদক ছিলেন তাই সুরের সঙ্গে তালের যে অপূর্ব মেলবন্ধন, সেটা অত অনায়াসে ঘটাতে পারতেন। মানুষ হিসেবেও এত ডাউন টু আর্থ ছিলেন তা বলার নয়। এত সহনশীল, এত ডিগনিফায়েড, কোনও নিন্দা-চর্চা কেউ কোনওদিন শোনেননি ওঁর মুখ থেকে। আমার গুরুর সঙ্গেও দারুণ সম্পর্ক ছিল। অনেকবার বাজাতে এসেছেন আমাদের ফেস্টিভ্যালে। আরও একটা মজার ব্যাপার, যারা খুব কাছ থেকে মিশেছে জানবে, শিব’জি খুব কম কথা বলতেন, মিষ্টি স্বভাবের কিন্তু খুব রসিক মানুষ ছিলেন। আর যা-ই করতেন, সমস্ত বিষয়েই এত নিজস্বতা থাকত যে বলার নয়। মিউজিক তো ছেড়েই দিন, জীবনের কত কিছু যে নীরবে শিখেছি বলার নয়। আস্তে আস্তে সব ছাতা চলে যাচ্ছেন, এটাই দুঃখের।