অনুষ্ঠানের মাঝপথে ছোট্ট বিরতি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মঞ্চে ফিরবেন। আবার শুরু করবেন লাইভ পারফরম্যান্স।…
এখনও যেন এমনটাই মনে করছেন কে. কে-র ভক্তরা। তিনি নেই, সুরের ঘোরে আচ্ছন্ন রেখে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে, বিশ্বাস করতে চাইছেন না কেউই। সত্যিই কি মেনে নেওয়া যায়? কয়েক ঘণ্টা আগে যিনি নজরুল মঞ্চের আলো-ঝলমলে কনসার্টে বিস্তার করলেন সুরের মায়াজাল, হঠাৎ তাঁর নিভে যাওয়ার দুঃসংবাদ বিশ্বাস করা এককথায় কঠিন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কে. কে আর নেই! স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ভক্তদের কাঁদিয়ে ৩১ মে রাতে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি চির ছুটি নিয়েছেন। মঞ্চ এবং জীবন থেকে।
আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর
কলকাতা ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় শহর। বহুবার বলেছেন সেইকথা। বন্ধু-তালিকায় ছিলেন বহু কৃতী বাঙালি। বাংলায় অবিশ্বাস্য ফ্যান ফলোয়ার। একপ্রকার তাঁদের সামনেই, প্রিয় শহরেই অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গায়ক ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।
কী ছিল মঞ্চে কেকে-র শেষ গান? ‘হাম রহে ইয়া না রহে কাল, কাল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়েহ পল।’ গানটা তাঁর প্রথম অ্যালবামের। সত্যিই তো, তিনি আজ আর নেই, কিন্তু মুহূর্তগুলো বারবার প্রত্যেকের মনে পড়বে। আলো থেকে অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগে ভক্তদের উদ্দেশ্যে তাঁর উড়ন্ত চুম্বন, হাসিমুখে হাত নাড়া, মনে পড়বে। বারবার।
কেকে-র শেষ অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন সুদীপ্ত মিত্র। জানালেন, ‘‘টিনেজারদের মধ্যে সাংঘাতিক ক্রেজ ছিল কেকে-র। নজরুল মঞ্চে নিজের চোখে দেখলাম। সামান্য কথা হয়েছে। চমৎকার ব্যবহার। ১৯টি গান গাইলেন। কিছুক্ষণ আগে দেখা জলজ্যান্ত মানুষটা হঠাৎ চলে গেলেন, ভাবতেই পারছি না!’’
আরও পড়ুন-রৌনকে উজ্জ্বল
১৯৬৮-র ২৩ অগাস্ট, দিল্লির একটি মালয়ালি পরিবারে জন্ম কৃষ্ণকুমার কুন্নাথের। কেকে নামেই পেয়েছিলেন পরিচিতি। গানের প্রথাগত তালিম ছিল না। তবু নেমেছিলেন সুরেলা সফরে। পেশাদার গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ নয়ের দশকের শেষদিকে। এমন একটা সময়, যখন ধীরে ধীরে বলিউডে প্লেব্যাকের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন এসপি বালাসুহ্মমনিয়ম, কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, অভিজিৎ ভট্টাচার্য, বিনোদ রাঠোর। সেই সময় খ্যাতির শীর্ষে সোনু নিগম। অরিজিৎ সিং তখনও হননি ইনডাস্ট্রির অংশ। ফলে একজন দক্ষ গায়কের সন্ধানে ছিল বলিউড।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পেল কে. কে-র একক অ্যালবাম ‘পল’। নতুন এবং অন্যরকম কণ্ঠের স্বাদ পেলেন শ্রোতারা। ভয়েস অফ ইউথ৷ যদিও তার আগে কে. কে গেয়েছেন কয়েকটি ছবিতে। তারমধ্যে অন্যতম গুলজারের ‘মাচিস’। এই ছবির ‘ছোড় আয়ে হাম’ গানের ছোট্ট অংশে শোনা গিয়েছিল কে. কে-র কণ্ঠস্বর। একক অ্যালবাম এবং টুকটাক প্লেব্যাকের পাশাপাশি সেইসময় তিনি চুটিয়ে গাইছিলেন জিংগল। সংখ্যাটা প্রায় ৩৫০০।
আরও পড়ুন-১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে বাধ্য হল ইসিএল, ধরনায় বসে দাবি আদায়
১৯৯৯ সালে দর্শকদের সামনে এল ‘হাম দিল দে চুকে সনম’। সঞ্জয় লীলা বানশালির ক্লাসিক। নায়ক-নায়িকা সলমন খান-ঐশ্বর্য রাই। ছবিতে ইসমাইল দরবারের সুরে গেয়েছিলেন কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, বিনোদ রাঠোর, হরিহরণ, শঙ্কর মহাদেবন। প্রতিটি গান সুপারহিট। এই ছবিতেই কেরিয়ারে প্রথম বড় ব্রেক পেয়েছিলেন কেকে। বহুশ্রুত কণ্ঠস্বরগুলোর পাশে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল যেন ‘হাওয়া কা ঝোঁকা’। কে. কে-র গাওয়া ‘তড়প তড়প’ গানটি শ্রোতাদের মন ছুঁয়েছিল। পর্দায় সলমনের মনোবেদনা নিজের কণ্ঠস্বরে অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন কেকে। রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন নতুন প্রজন্মের হার্টথ্রব।
আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আসতে শুরু করে একটার পর একটা অফার। এ আর রহমান, অনু মালিক, নাদিম-শ্রাবণ, প্রীতম চক্রবর্তী, বিশাল-শেখর প্রমুখ বিখ্যাত সুরকারদের কাছ থেকে। ‘জন্নত’, ‘তুম মিলে’, ‘ওহ লমহে’, ‘আশিকী টু’, ‘বজরঙ্গী ভাইজান’, ‘ওম শান্তি ওম’, ‘গ্যাংস্টার’, ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’, ‘ভুলভুলাইয়া’, ‘কাইটস’, ‘দেবদাস’, ‘সড়ক টু’ প্রভৃতি ছবিতে গেয়েছেন কেকে। তুমুল প্রেমের গান এবং প্রেম ভাঙার গান। তাঁর প্রতিটি গানের সঙ্গে নিজেদের রিলেট করতে পারছিলেন স্কুল, কলেজ পড়ুয়ারা। হইহই করে বাড়তে থাকে কে. কে-র জনপ্রিয়তা। সিনেমার পাশাপাশি গাইতে থাকেন টেলিভিশনের বিভিন্ন ধারাবাহিকে। জুরি মেম্বার এবং বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন একাধিক রিয়েলিটি শোয়ে। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি গান। কণ্ঠ দিয়েছিলেন কেকে।
কে. কে একটা জেনারেশনের প্রতিনিধি। কণ্ঠস্বর। ইমোশন৷ বলিউড তাঁকে সারা দেশে তো বটেই, বিদেশেও জনপ্রিয় করেছে। হিন্দির পাশাপাশি কেকে গেয়েছেন তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালায়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, আসামি, গুজরাটি এবং বাংলা ভাষায়।
আরও পড়ুন-শুক্রবার প্রকাশিত হবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল
বলিউড এবং টলিউডের জনপ্রিয় সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে হিন্দির পাশাপাশি বাংলা গান গেয়েছেন কেকে। দুজনের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। প্রিয় বন্ধুর অকালমৃত্যুতে শোকস্তব্ধ জিৎ। জানালেন, ‘‘কে. কে-র সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব প্রায় ২৪ বছরের। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা একসঙ্গে প্রচুর কাজ করেছি। খুব বড় মাপের শিল্পী ছিল। ছিল বড় মনের মানুষ। কারো সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে শুনিনি। আমার সুরে বাংলায় গেয়েছিল ‘আকাশের নীলে’ গানটি। কে. কে-র মৃত্যুসংবাদ পেয়েই আমি হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ওর হাতটা ধরেছিলাম। তখনও গরম। দেখে মনেই হচ্ছিল না কে. কে চলে গেছে। যেন শুয়ে আছে। একটু রেস্ট নিচ্ছে, আবার স্টেজে গিয়ে গাইবে। কিন্তু তা তো আর হবার নয়! ইদানীং আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, জীবনকে সহজ করে নেওয়া উচিত। এখন আমরা অনেক বেশি দৌড়ই। এটা ঠিক হচ্ছে না। যাই হোক, কেকে গানের মধ্যে দিয়ে সবার মনে থেকে যাবে।’’
আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে ছাত্রেরা
কে. কে-র সঙ্গে কাজ করেছেন বিশিষ্ট সুরকার-শিল্পী অনুপম রায়। গায়কের হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে তিনি জানালেন, ‘‘মর্মান্তিক ঘটনা। দুর্ভাগ্যজনক। এই বয়সে কেকে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেটাও আবার কলকাতা শহরে অনুষ্ঠান করার পরে। ভাবতেই পারছি না। মনটা খুবই ভারাক্রান্ত। অনেক স্মৃতি আমাদের। কয়েক মাস আগে ‘বব বিশ্বাস’ ছবির জন্য মুম্বইয়ের একটি স্টুডিওয় আমি কে. কে-র সঙ্গে একটি গান রেকর্ড করেছি। আজকে সেই মানুষটা নেই। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি হসপিটালে গিয়েছিলাম। খুবই প্রাণবন্ত, সহজ-সরল মানুষ ছিলেন কে. কে।’’
আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে ছাত্রেরা
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র। দুই সপ্তাহ আগেই দুবাইয়ে কেকে-র একটি অনুষ্ঠানের সাক্ষী থেকেছেন। জানালেন, ‘‘কে. কে-র সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি সামান্যই। একটি ফেস্টিভালে দুবাই গিয়েছিলাম। ওপেনিং নাইটে কেকে পারফর্ম করেছিলেন। সামনের সারিতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি। ব্যাকস্টেজে দেখা এবং সামান্য কথা হয়েছে। আমরা ছিলাম এক হোটেলেই। তখনও দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। ওঁর গান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ভাবা যায়নি, হঠাৎ করে এইভাবে চলে যাবেন। এমনকিছু বয়সও হয়নি। শেষ অনুষ্ঠানের ভিডিওগুলো দেখছিলাম। কী প্রাণবন্ত। হঠাৎ কী যে হয়ে গেল! রাজার মতো চলে গেলেন। অসংখ্য হিট গান। গানের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন। নয়ের দশকে যারা বেড়ে উঠেছেন, কে. কে-র গানগুলো ছিল তাঁদের সঙ্গী। কলেজ জীবন, প্রথম প্রেম, ব্রেক আপ, সবকিছুই মনে করিয়ে দেয়। ‘মাচিস’, ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ ছবিতে গাওয়া কে. কে-র গানগুলো আমার খুব প্রিয়। এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছেন। আমাদের ছোটবেলাগুলোও এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার পরিচালিত ছবিতে কেকে গান করেননি। হয়তো ভবিষ্যতে একসঙ্গে কাজ করতাম। সেটা আর হল না।’’
আরও পড়ুন-রাহুলের হাজিরা
হল না অনেক কিছুই। দুম করে চলে গেলেন কেকে। ভক্তদের আনন্দ দিয়ে। কষ্ট বুকে চেপে। একটি অকালমৃত্যু বহু স্বপ্ন তছনছ করে দিল। স্বরহীন হয়ে গেল অসংখ্য গান। অগণিত ভক্তের কাছে কেকে ছিলেন গানের রাজা। সত্যি, রাজার মতোই মাথা উঁচু করে মঞ্চ থেকে চিরবিদায় নিলেন। ইতি টানলেন বর্ণময় এক সুরেলা সফরের। আলবিদা কে. কে! আলবিদা, আলবিদা…