হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা

নিউ থিয়েটার্সের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যে নায়িকা শুরুতেই আলোড়ন তোলেন, পরবর্তী কালে তিনি হয়ে উঠলেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী। সেই ভারতী দেবীর পরিচয় তুলে ধরেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

কথামুখ
৮৭ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটের ডিসট্রিবিউশন অফিসে ভর্তি বাড়িটিতে একসময় লোকে গমগম করত। সেখানে অফিস বিখ্যাত প্রযোজক দীপচাঁদ কাংকারিয়ার। একটি ছবি হবে তার স্ক্রিপ্ট রিডিং ঐ ঘরে হবে। যে গল্প নিয়ে ছবিটি তা প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘সাগর সঙ্গমে’। সেই গল্পের চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক দেবকীকুমার বসু। লেখক-পরিচালক-প্রযোজক-সহ অনেকে উপস্থিত হয়েছেন। শুনলেন স্ক্রিপ্ট। এবার শিল্পী নির্বাচনের পালা। সেখানে লাগল বিরোধ। পরিচালক দেবকী বসু যখন মূল চরিত্র দাক্ষায়ণীর জন্য এক অভিনেত্রীর নাম বললেন, লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র তীব্র প্রতিবাদ করলেন। অভিনেত্রী সম্বন্ধে লেখকের মন্তব্য— চরিত্রটি ঐ শিল্পীর জন্য নয়। এমনকী সেই অভিনেত্রীকে নিলে তিনি গল্পের চিত্রস্বত্ব দেবেন না প্রযোজককে— এমনটিও জানালেন। পরিচালক অনেক বোঝালেন। জানালেন সেই শিল্পীকে ভেবেই তিনি স্ক্রিপ্ট লিখেছেন এবং তাঁর বিশ্বাস শিল্পী ভালভাবেই চরিত্রটি উতরে দেবেন। পরিচালকের কথাই সত্যি হল। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর দেখা গেল সেই শিল্পীর অভিনয়ে মুগ্ধ হলেন সবাই। যে নায়িকাকে নিয়ে বিরোধ তিনি হলেন ভারতী দেবী। ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিল ১৯৫৮সালে। নায়িকাও পুরস্কৃত হলেন। এক ধর্মপ্রাণ হিন্দু ঘরের বিধবা রমণী হিসেবে তিনি যেখানে তাঁর সমস্ত সংস্কার ত্যাগ করে নষ্টচরিত্রের দলের বালিকা বাতাসীর মৃত্যুতে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিচ্ছেন, সে অভিনয় দর্শকেরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। চোখের জল বাঁধ মানে না।
জীবনকথা

আরও পড়ুন-তীজন বাঈ পাণ্ডবানী

ভারতী দেবীর জন্ম ১৯২২ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায়। ভারতী দেবীর বাবা হরেন্দ্রকৃষ্ণ দাসের দু’পক্ষের দুটি করে পুত্র, একটি করে কন্যাসন্তান। ভারতী দেবী দ্বিতীয় পক্ষের কন্যা। ভারতী দেবীর পরিবার ছিল রক্ষণশীল। তাই শুরুতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের লং সাহেবের মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ঠাকুরমা বললেন, ‘মেয়েমানুষের অত ইংরেজি পড়ে কী হবে? ভর্তি করে দাও ভারতী বিদ্যালয়ে।’ ভারতীর ছোটবেলায় অনেক নাম। ডাকনাম বাবলি। বাড়ির নাম মহামায়া। ভাল নাম সুশ্বেতা। মহামায়ার যখন বয়স মাত্র ১৩, তখন তার বিয়ে দেয়া হল মণি রায়ের সঙ্গে। স্বামী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় শরীরবিদ্যার শিক্ষক। শ্বশুরবাড়ি বেনারাস। রাগী স্বামীর সন্দেহবাতিক মেনে নিতে পারছিলেন না মহামায়া। বাবা সবকিছু জেনে মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। ডিভোর্স নেওয়া যাবে না নাবালিকা বলে। ব্যারিস্টার এস এন ব্যানার্জির কথামতো ধর্মান্তরিত করা হল মহামায়াকে স্বামীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য। ভারতী পরে আবার ইসলাম ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ফিরলেন। যাঁর সহযোগিতায় নিউ থিয়েটার্সে আর্টিস্ট হতে পেরেছিলেন সেই নট-নির্দেশক অমর মালিকের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন ভারতী দেবী।

আরও পড়ুন-পুতুল-গ্রাম

অভিনয় জীবনের ব্যাপ্তি
গান শিখতে শুরু করেছিল রাইচাঁদ বড়ালের কাছে, আমির খান ও আমজাদ হোসেনের কাছে। রাইচাঁদবাবুর সুপারিশে তাঁকে নায়িকা করলেন ফণী মজুমদার ‘ডাক্তার’ ছবিতে ১৯৪০ সালে। মহামায়া নাম বদলাতে হল। তাঁর নতুন নামকরণ হল ভারতী। প্রথম ছবিতেই অভূতপূর্ব অভিনয়ের পরিচয় রাখলেন ভারতী। পরের ছবি ‘প্রতিশ্রুতি’ করলেন। ‘কাশীনাথ’ করলেন। ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে দলনি বেগমের চরিত্রে অভিনয় করলেন। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে তিনি করলেন আয়েষা। এ-ছাড়া তিনি অভিনয় করলেন নতুন খবর, প্রতিবাদ, ইন্দ্রজাল, আনন্দমঠ, নার্স সিসি ছবিগুলিতে। এসব ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল। সুপারহিট। অসিতবরণ ও ভারতী দেবী জুটি একসময় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উত্তমকুমার তখন নায়ক হিসেবে সবেমাত্র প্রতিষ্ঠার পথে এবং ভারতী তখন নায়িকা চরিত্রে থেকে সরে চরিত্রাভিনয়ের দিকে ঝুঁকছেন, এরই মধ্যে উত্তমকুমারের বিপরীতে ভারতী দেবীকে পেলাম অগ্রদূত পরিচালিত ‘সহযাত্রী’ এবং সুশীল মজুমদারের ‘মনের ময়ূর’ ছবিতে। বলাবাহুল্য এই ছবিদুটি ব্যবসায়িক সাফল্যের মুখ দেখেনি।

আরও পড়ুন-শাশুড়ি জামাই সংবাদ

চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতি
বিকাশ রায় পরিচালিত ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছবিতে তিনি চরিত্রাভিনয়ে এলেন। পরে ধারাবাহিকভাবে তাঁকে আমরা পেলাম চিরকুমার-সভা, ভোলা মাস্টার, সূর্যমুখী, পথে হল দেরি, চাওয়া-পাওয়া, নেকলেস, অভিসারিকা, পলাতক, ত্রিধারা, শ্রেয়সী, গুলমোহর, সুশান্ত শা, বিবাহবিভ্রাট, প্রথম বসন্ত, আলো আমার আলো, দেবী চৌধুরানী, বাবা তারকনাথ, শেষরক্ষা, খেলার পুতুল, সংসারের ইতিকথা, জোড়াদিঘির চৌধুরী পরিবার, কালস্রোত প্রভৃতি ছবিতে। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে মনোরমার চরিত্রে তিনি আমাদের মুগ্ধ করেছেন। তপন সিংহ পরিচালিত ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে ৪ বিধবার এক বিধবা তিনিও। তাঁরা অর্থাৎ ছায়াদেবী, ভারতী দেবী, রেণুকা রায়, রুমা গুহঠাকুরতা সম্মিলিতভাবে পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান। ভারতের তৃতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৬৩ সালে। তপন সিংহ ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে নিয়েছেন। অপর্ণা সেনের ছবি ‘পরমা’তেও তিনি দৃষ্টিপথে পড়েছেন।

আরও পড়ুন-আলবিদা…

শেষ সময়ে কিছু স্মরণীয় অভিনয়
আগাগোড়াই কাজের মধ্যে থাকতে ভালবাসতেন। শেষের দিকে তিনটি স্মরণীয় ছবিতে এবং একটি টেলিফিল্মে তিনি কাজ করেছেন। ছবিগুলি হলো ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’, তরুণ মজুমদারের ‘আলো’ এবং গৌতম ঘোষ পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘যাত্রা’ এবং টেলিফিল্মটি হল ‘চিঠি পাওয়ার পর’।
অন্যান্য স্মরণীয় ঘটনা
মহিলা শিল্পীদের জন্য কানন দেবী মহিলা শিল্পী মহল প্রতিষ্ঠার সময় যে পঞ্চকন্যা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতমা। মহাশ্বেতা ছদ্মনামে গল্প লিখেছেন বাতায়ন পত্রিকার বেশ কয়েকটি সংখ্যায়। নানা ভাষায় ছবি করেছিলেন বলে হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি ভাষা শিখেছিলেন। যে ছবিগুলো ডাবল ভার্সানে নির্মিত, সেখানে হিন্দি ভাষার ছবিগুলিতে তিনি নিজের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত হিন্দি ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে বাগদাদ, বন্দিনী, সৌগন্ধ প্রভৃতি ছবি। কলকাতা দূরদর্শনের ‘কথায় কথায়’ অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদককে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে অবাক হতে হয়েছিল শিল্পীর স্মৃতিশক্তির জোর দেখে। শেষের দিকে বেশ কিছু টেলি সিরিয়ালেও তিনি কাজ করেছিলেন।

আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর

না-ফেরার দেশে গমন
২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর বহু ছবি ডাউনলোড করে এখনও দেখা যায়। এই প্রজন্মের দর্শকেরা তাঁর অসাধারণ অভিনয় দেখে এখনও মুগ্ধ হন। শিল্পী-জীবনের চরম প্রাপ্তি সেখানেই।

Latest article