তীজন বাঈ পাণ্ডবানী

বিধিনিষেধ কুসংস্কারে মন বেঁধে ফেললে যতই বই পড়ুক মনের মুক্তি আসে না। নিয়মের শৃঙ্খলভাঙা প্রথম মহিলা পাণ্ডবানী তীজন বাঈ৷ লিখেছেন বিতস্তা ঘোষাল

Must read

বিধিনিষেধ কুসংস্কারে মন বেঁধে ফেললে যতই বই পড়ুক মনের মুক্তি আসে না। নিয়মের শৃঙ্খলভাঙা প্রথম মহিলা পাণ্ডবানী তীজন বাঈ৷ লিখেছেন বিতস্তা ঘোষাল

মেয়ে মহাভারতের গান গাইতে চায় শুনে মারতে-মারতে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন মা। শিশু বয়স থেকে মা-বাবার অত্যাচারের কারণ কী সেটাই বুঝে উঠতে পারত না ছোট্ট মেয়েটি। কেনই বা তাকে গান গাইতে দেওয়া হবে না, গাইলে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়, সেসব প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না সেই শিশুটির কাছে। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিল সেদিনই সে এমন কিছু করতে চাইছে যা শুধু পরিবার নয়, জাতপাতে ঘেরা সমাজের কাছেও তা গ্রহণযোগ্য নয়।
শুধু ছিল অদম্য জেদ। সেই জেদেই কালের স্রোতে হয়ে উঠলেন পাণ্ডবানী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একচেটিয়া অধিকার ভেঙে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন সেই একরত্তি মেয়েটি। কারণ তিনি জানতেন তাঁকে পাণ্ডবানী গাইতেই হবে। লোকের সামনে নাচগান করার জন্য কুলটা, চরিত্রহীন এসব অপবাদ সহ্য করেও মেয়েটির কণ্ঠ তাই বন্ধ হলো না।

আরও পড়ুন-পুতুল-গ্রাম

মেয়েটির নাম তীজন বাঈ পাণ্ডবানী। জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৪ এপ্রিল, ভিলাইয়ের কাছে গানিয়ারি গ্রামে এক পারধি উপজাতি পরিবারে। যেখানে মেয়েদের পড়াশোনা তো দূরের কথা, বাল্যবিবাহই একমাত্র মেয়েদের ভবিষ্যৎ। ঘরের কাজ, সন্তান প্রতিপালন, খেতে সাহায্য করা, আর বিনিময়ে স্বামীর হাতে মার- এটাই সেখানকার মেয়েদের জন্ম থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
তীজনেরও বিয়ে হয়ে গেছিল বারো বছর বয়সেই। প্রতিদিনের কাজের মাঝে চেষ্টা করে মন ভাল রাখার জন্য কিছু করতে সে। কিন্তু কী করবে! সামান্য গান গাইলেও জোটে চরম মার। তবু ক’দিন ধরে গুনগুন করছে কতগুলো সুর। এ সুর সে শুনেছে তাঁর মায়ের কাকা ব্রিজলাল দাদুর কাছে। তিনি তখন তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। আধা-সন্ন্যাসী গোছের মানুষ। স্ব-পাকে খান, আর বিকেল হলেই একা ঘরে সুর করে কী সব যেন গল্প গুনগুন করেন! সেই সুর আর বলিষ্ঠ স্বরক্ষেপ— সর্বাঙ্গে কী যেন ঘটে যায় মনে। এটা গল্প নাকি গান? আগে কখনও তো সে কোথাও এই রকম শোনেনি! দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, কীচকবধ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, ভীষ্মের শরশয্যা শুনতে-শুনতে নেশার মতো হয়। পা আটকে যায় দাদুর ঘরের বাইরে। কাজ ভুলে প্রত্যেক দিন বিকেলে লুকিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শোনে। গ্রামে তাদের জাতের মেয়েদের গানাবাজানা করা কোন ছার, শোনাও পাপ। মা জানলে মেরে ফেলবে, তা-ও সে নড়তে পারে না।

আরও পড়ুন-শাশুড়ি জামাই সংবাদ

তবু ধরা পড়ে যায় দাদুর হাতে। ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে আসেন। প্রশ্ন করেন, যা শুনেছিস সব মনে আছে? শোনাতে পারবি?
শাস্তি-মকুবের ক্ষীণ আশা নিয়ে ঢোঁক গিলে গান শুরু করে মেয়েটা। একটার পর একটা পর্ব, একটা শব্দও না-ভুলে, একটুও না-থেমে, নিখুঁত-জোরালো গলায়। কিছু ক্ষণ শোনার পর দাদু কেঁদে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমার ঘরেই এই রত্ন, অথচ আমি এত দিন চিনতে পারিনি? ভগবান!’ সেই তাঁর শুরু হল পাণ্ডবানী-জীবন।
পাণ্ডবানী বা তীজন পাণ্ডবানী সম্পর্কে আরও বিস্তৃত বলার আগে সংক্ষেপে পাণ্ডবানী নিয়ে একটু বলা দরকার। তখনও ভিলাই মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত। সেখানে পাণ্ডবানীর জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উৎসব দরকার নেই। মণিপুরে যেমন যেকোনও উৎসব উপলক্ষে নৃত্য ঘরে ঘরে, ঠিক তেমনি এখানেও যেকোনও সময়ই হতে পারে পাণ্ডবানী। দরকার তম্বুরা, করতাল, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর, ও শ্রোতা। কোনও প্রথাগত মঞ্চ নয়, মাটিতেই শুরু হয় তা। কিন্তু এতে কোনও মেয়ে অংশ নিতে পারতেন না। পুরুষরাই কেবল অংশ নিতেন, এবং তা স্থানীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। তীজনের মতে, এই নাট্যধারা সম্ভবত মহাভারতের মতোই প্রাচীন। গ্রামেরই এক পাণ্ডবানী নারায়ণ দাস সেই চৌহদ্দি থেকে তাকে বের করে সাধারণ মঞ্চে নিয়ে এলেন। পরবর্তী কালে তাঁর উত্তরসূরি ঝড়ুরাম দেওয়াঙ্গন এর রূপ দেন ছত্তিশগঢ়ি হিন্দিতে। পাণ্ডবানী আগে গাওয়া হত বেদমতি অথবা কাপালিক শৈলীতে। ঝড়ুরাম তাকে দোহা-চৌপদি রূপ দিলেন।

আরও পড়ুন-আলবিদা…

আবার ফিরে আসি তীজনের প্রসঙ্গে। দাদুর উৎসাহে তিনি গান তো শুরু করলেন, কিন্তু একে মেয়ে, তা-ও বিবাহিত, তাঁর এত আস্পর্ধা! বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সব জায়গা থেকেই তাড়িয়ে দিল তাঁকে। কিন্তু এ মেয়েও একবগ্গা। আর বাড়ি ফিরলেন না। গ্রামের এক পাশে নিজের হাতে কাঠকুটো দিয়ে ঝোপড়া বানিয়ে কোনও মতে মাথা গুঁজলেন। পাড়া প্রতিবেশীরা লুকিয়ে কখনো রুটি-চাটনি দিয়ে গিয়েছে। কোনও দিন তাও জোটেনি, তাতে অবশ্য ‘পাণ্ডবানী’ গাওয়ায় ছেদ পড়েনি।

আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর

এক শীতের সকালে কয়েকটি বানজারা পরিবার শালপাতা কুড়োনোর জন্য গরুর গাড়ি চেপে কয়েক ক্রোশ দূরে দ্রুগের চন্দখুড়ি গ্রামে যাচ্ছে। বাড়িছাড়া তীজন তাঁদের সঙ্গ নিল। চন্দখুড়িতে তখন মেলা হচ্ছে। বাঁশের স্টেজে লণ্ঠনের আলোয় টানা দু’দিন পাণ্ডবানী গাইলেন কিশোরী তীজন। বিশ গাওঁয়ের লোকের সামনে। ‘কাপালিক’ শৈলীর পাণ্ডবানী পুরুষ শিল্পীদের একচেটিয়া সস্পত্তি। মেয়েদের গাওয়ার অধিকার নেই। তীজনই প্রথম নারী, যিনি অনুশাসনের তোয়াক্কা না-করে সর্বসমক্ষে তা পরিবেশন করলেন। নিয়মের স্রোত ভেঙে এক ইতিহাসের জন্ম দিলেন। তেজি গলায় গানের সঙ্গে এক হাতে তম্বুরা, অন্য হাতে করতাল, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে থাই চাপড়ে কখনও ভীম হয়ে, কখনও অট্টহাস্যে দুর্যোধন রূপে আবার কখনও হাতের তানপুরাটাকে গাণ্ডীব করে বুক ফুলিয়ে বীরদর্পে অর্জুন সেজে তোলপাড় করে ফেললেন। পারিশ্রমিকও পেলেন বিনিময়ে। দশ টাকা। পাশের গ্রামেও ডাক পড়ল। এ বার টানা ১৮ দিনের পালা। গরুর গাড়ি ভর্তি হয়ে শাড়ি, খাবার, বাসন-এর ‘চরহৌতরি’ আসতে লাগল। দ্রৌপদীর চীরহরণ, দুঃশাসন বধ, ভীষ্ম ও অর্জুনের যুদ্ধ পালার মধ্যে দেশজ আঞ্চলিক গল্প মিশিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করে রাখতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

আরও পড়ুন-রৌনকে উজ্জ্বল

বিখ্যাত নাট্যকার হাবিব তনভির একদিন দেখলেন তাঁর অনুষ্ঠান। তিনিই প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাঁর অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। এর পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক প্রভৃতি একাধিক দেশে অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সংগীত নাটক আকাদেমি-সহ ভিলাই ইস্পাত কারখানায় চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট, জাপানের ফুকুওকা পুরস্কারে ভূষিত হলেন।
কিন্তু কেমন লাগে তাঁর নিজের এই ইচ্ছেপূরণের গল্পের কাহিনি? কীভাবেই বা মূল্যায়ন করেন নিজেকে? স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার রূপকথা কতটা স্পর্শ করে তাঁকে? এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি— কীসের স্বাধীনতা? কার মুক্তি? চল্লিশ বছরে আর একটা পারধি মেয়েও তো পাণ্ডবানী গাওয়ার সাহস দেখাল না? গানিয়ারি গ্রামের কোনও মেয়ে এই চল্লিশ বছরে এসে বলল না যে, সমাজের পরোয়া না করে সে পাণ্ডবানী গাইতে চায়। পিছিয়ে থাকা মেয়েদের এগিয়ে আসার তাগিদ তৈরি করা না গেলে সবটাই ফাঁকি। আসলে পরিবার থেকেই শিক্ষা পায় সন্তান। সেখানে প্রথম থেকেই বিধিনিষেধ কুসংস্কারে মন বেঁধে ফেললে যতই বই পড়ুক মনের মুক্তি আসে না।

আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে ছাত্রেরা

কাঁটা বিছানো ছিল তাঁর উত্থানের পথে। এক আদিবাসী মেয়ে, তা-ও আবার তিন তিনবার বিয়ে করেছেন, শান্তির আশায়, তাঁকে সহজে কি জায়গা দেয় ব্রাহ্মণ্যবাদে আক্রান্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ? তবু দাঁত চেপে লড়াই চালাবার পরে বলেছেন, বিজয়ে যদি কষ্ট, অপমান জড়িয়ে না থাকে তবে সেই বিজয়ে আনন্দ নেই। কিন্তু বলতে-বলতেই চোখ ভরে উঠেছে জলে। গানিয়ারি গ্রামে নিজের পুরনো বাড়ির পাশেই বাড়ি করেছেন। ভেবেছিলেন, কোনও পারধি মেয়ের যখন পাণ্ডবানী গাইতে ইচ্ছা করবে আর তার মা বাড়ি থেকে বার করে দেবে তখন তাকে অন্তত রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না। এই বাড়িতে স্থান হবে তার। কিন্তু সেটা হয়নি। নিজের ছেলে-মেয়েরাও এগিয়ে আসেননি এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য। তবু স্বপ্ন দেখেন পাণ্ডবানীর প্রথম মহিলা-শিল্পী একদিন তাঁর মতো অনেক মেয়ে এগিয়ে আসবেন নিয়মের বেড়া ভেঙে পাণ্ডবানী হতে, তাঁরাও দৃঢ়কণ্ঠে বলবে নারীর ওপর অত্যাচার কোরো না, তাকে অপমানও কোরো না। তাহলে পুরুষ তোমাদের অবস্থাও হবে কৌরবদের মতোই।
আমরাও তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে পথ হাঁটি এক সুন্দর হিংসামুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য।

Latest article