কল্যাণ মৈত্র: রামায়ণের রাম এবং মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ যেমন চিরকালই মানবজীবনে চেনা-অচেনা আর জানা-অজানার রহস্যের জন্যই বারবার কৌতূহল তৈরি করেন, তেমনই শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের জীবন—যত গভীরে যাওয়া হোক না কেন সেই গভীরতার কোনও তল, কূল পাওয়া যায় না। জানার তৃষ্ণা বেড়েই যায়। এমনই কিন্তু বিবেকানন্দের জীবনও। এমনই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনও। শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণকে যেমন জানার শেষ হয় না, শ্রীরামকৃষ্ণকেও জানার তেমন শেষ নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নিজের অসীমের মধ্যে অসীম। তাঁকে যত পড়া যায় তত তৃষ্ণা বেড়ে যায়। শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত-র পাঁচ খণ্ডের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত এবং স্বামী সারদানন্দ রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ (পাঁচ খণ্ডের) দশকের পর দশকের ধরে ভক্ত মানুষের এই তৃষ্ণা মিটিয়েছে। এই দুটি বই শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবধারার দুটি বাইবেল। শ্রীম কথামৃত লিখে আমাদের রামকৃষ্ণ জ্ঞানপিপাসাকে যেমন চিরায়ত করেছেন তেমনই স্বামী সারদানন্দের লেখা রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের একটু নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য পাঠ। আমরা শ্রীম-র কথামৃত পাঠে তৃপ্ত হই, শান্ত হই, পথ খুঁজে পাই, এমনই একটি পথ যা শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মা ও বিবেকানন্দ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভালবাসতেন সাদা ফুল, আর শ্রীমা হলুদ। দু’জনেই আলাপচারিতা পছন্দ করতেন। দু’জনেই পেটরোগা ছিলেন। দু’জনেই সত্য কথায় বিশ্বাসী ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের পাঁচ টাকা মাইনের পুরোহিত শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর সহধর্মিণী সারদামণি-র জীবনদর্শন চিরকালের একটি আকর্ষণীয় বিষয়। তাঁদের নিয়ে জানা ফুরোয় না।
আরও পড়ুন-বিদ্যুতের চরম সংকট! পাকিস্তানে বিয়ের অনুষ্ঠানেও কড়া নির্দেশ
শ্রীম তো কথামৃত লিখলেন। কিন্তু মা সারদার দুঃখ কী ছিল? এ দুঃখ সে দুঃখ নয়, বরং বলা যায় আফশোস, লেখাপড়া না-জানার আক্ষেপ । শ্রীরামকৃষ্ণ কত ভাল ভাল কথা বলতেন যেগুলো শুনেও তাঁর সহধর্মিণী টুকে রাখতে পারতেন না—‘আহা যদি লেখাপড়া জানতুম, তাহলে টুকে টুকে রাখতুম’। কত কথাই শ্রীমা-কে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তার অনেকটাই শ্রীমা নানা সময়ে বলেছেন স্মৃতিনির্ভর করে, নানা জনকে গল্পের ছলে। আহা, যদি টুকে টুকে রাখতেন তাহলে আমরা আরও একটি কথামৃত পেতাম। শ্রীমার কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সদানন্দ পুরুষ। আবার ওই তাঁর আক্ষেপ—‘কী মানুষই এসেছিলেন! কত লোক জ্ঞান পেয়ে গেল…তাঁকে কখনো নিরানন্দ দেখিনি’। শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাইতেন, কেমন গান? মা বলছেন—‘আহা! গান গাইতেন তিনি, যেন মধু ভরা, গানের উপর যেন ভাসতেন’। পরবর্তীকালে আমরা দেখি শ্রীরামকৃষ্ণ হাসি কথা গান কীর্তন নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই মেতে থাকতেন। নরেনকে তাঁর ভাললাগা ও ভালবাসার অন্যতম কারণ ছিল নরেনের গান। শ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণের গানের খুব ভক্ত ছিলেন। সারদার এমন স্বামী নিয়ে সারদা জননীর দুঃখ ছিল। দুঃখ ছিল এই যে পাগল জামাইয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন যে ঘর-সংসারও করল না, ছেলেপিলেও হল না, মা বলাও শুনল না। এসব শুনে ঠাকুর একদিন তাঁর শাশুড়িকে বললেন, দুঃখ না করতে, কেন না একদিন তাঁর মেয়ের এত ছেলেমেয়ে হবে যে শেষে দেখতে পাবেন মা ডাকের জ্বালায় সারদামণি অস্থির হয়ে উঠবেন।
আরও পড়ুন-দেশ জুড়ে বাড়ছে সংক্রমণ, করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়াল
আমরা বলছিলাম, আহা মা যদি টুকে টুকে রাখতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ষোড়শী পূজা নিয়ে শ্রীমা কী বলছেন? ‘তিনি আমার পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন, কাপড় ছাড়িয়ে কাপড় পরিয়ে দিলেন, সিঁদুর দিলেন, পান-মিষ্টি খাওয়ালেন। …আমি মনে মনে প্রণাম করলাম, পরে চলে এলুম’। শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভাবে দেবীরূপে মায়ের পূজা করেছিলেন। ঠাকুরের যেসব ছবি আমরা দেখি তাতে তাঁর বৃদ্ধ-রূপ। বাহান্নতেই তিনি রোগে ভুগে বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রশ্ন জাগে কেমন দেখতে ছিলেন ঠাকুর? মা সারদা জানিয়েছেন, ঠাকুরের গায়ের রং হরিতালের মতো। সোনার ইষ্ট কবচের সঙ্গে গায়ের রং মিশে যেত। ছিলেন গৌরবর্ণ। স্বামী গরবিনী শ্রীমা বলেছেন, ‘যখনই কালীবাড়িতে বার হতেন সব লোক দাঁড়িয়ে দেখত, বলত ঐ তিনি যাচ্ছেন। বেশ মোটাসোটা ছিলেন। মথুর বাবু একখানা বড় পিঁড়ে দিয়েছিলেন, বেশ বড় পিঁড়ে। যখন খেতে বসতেন তাতেও বসতে কুলাত না। ছোট তেলধুতিটি পরে যখন হন হন করে গঙ্গায় নাইতে যেতেন, লোকে অবাক হয়ে দেখত’। শ্রীমার কথা থেকে জানা যায়, কামারপুরে ঠাকুর যখন যেতেন বাইরে বেরোলেই মেয়ে-মদ্দ হাঁ করে চেয়ে থাকত। শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন দক্ষিণেশ্বরে একাকী খাটে বসে আছেন হঠাৎ শ্রীমা জিগ্গেস করলেন ‘আমি তোমার কে?’ ঠাকুর উত্তর দিলেন, ‘তুমি আমার আনন্দময়ী মা’। ওই যে আমরা বলছিলাম, শ্রীমা যদি টুকে টুকে রাখতেন। ভাগনে হৃদয় মামিকে বলল, তিনি কেন তার মামাকে বাবা বলে ডাকেন না। শ্রীমা উত্তর দিলেন : ‘বাবা কী বলছ হৃদু, পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন—সবই উনি’।
আরও পড়ুন-ক্রশভোটিং, বরখাস্ত কুলদীপ
স্মৃতিকথায় শ্রীমা বলেছেন এই মাস টানা আট মাস ঠাকুরের সঙ্গে নহবতে বসবাস করেছেন—‘আমার বয়স তখন আঠেরো-উনিশ বছর হবে, ওঁর সঙ্গে শুতুম। একদিন বললেন “তুমি কে?” বললুম “আমি তোমার সেবা করতে আছি”, “কী?” “তোমার সেবা করতে আছি”, “তুমি আমার বৈ আর কাকেও জানো না?” “ না”। “ আর কাকেও জানো না?”, “না”। শ্রীমা আরেক জায়গায় বলেছেন, ঠাকুর তাঁকে শিখিয়েছিলেন শরীরকে সামশীতলে রাখতে। কেবল গরম জিনিস না খেয়ে মিছরির পানা, ডাবের জল খাওয়া ভাল।
শ্রীম-র কথামৃতে অন্তত সাঁইত্রিশবার টাকার উল্লেখ পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের ধারণা, ঠাকুর টাকাকে ঘৃণা করতেন। টাকা স্পর্শ করলেই তাঁর হাত বেঁকে যেত, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত, গঙ্গার জলে টাকা ফেলে দিয়েই একবার তিনি সেই জগদ্বিখ্যাত কথাটি বলেছিলেন ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’। ঠাকুর কি সত্যিই টাকাকে ঘৃণা করতেন? তাহলে তাঁর চলত কী করে? তাঁর তো স্ত্রী ছিল। দক্ষিণেশ্বরে তিনি মাইনে করা পুরোহিত। তাঁর এই বক্তব্যে কি স্ববিরোধিতা ছিল? আমাদের বাংলা সাহিত্যের সমারসেট মম—মণিশংকর মুখোপাধ্যায় যিনি শংকর নামে বাঙালি পাঠক সাধারণের হৃদয়ে তাঁর জায়গাটি পাকা করে নিয়েছেন সেই শংকর তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘বোধিবৃক্ষ শ্রীরামকৃষ্ণ যথাসম্ভব’-এ রামকৃষ্ণ জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনার সময় এমন বহু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। টাকা মাটি, মাটি টাকা প্রসঙ্গে শংকর বলছেন, বিশ্ব সংসারে সব টাকা গঙ্গার জলে ফেলে দেওয়ার কথা ঠাকুর কখনও বলেননি। শংকরের এই বইটি আগামী দিনে রামকৃষ্ণ গবেষকদের কাছে প্রামাণ্য গ্রন্থ হয়ে উঠবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এইদিকে ঔপন্যাসিক শংকর একজন সফল রামকৃষ্ণ গবেষক। সাধারণ পাঠকদেরও তিনি অসাধারণ কৌতূহলী পাঠের দিকে নিয়ে যান। লেখক শংকর ভক্তিজীবী, বুদ্ধিজীবী মানুষের কাছে এই বই উপহার দিয়ে প্রচুর প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
আরও পড়ুন-অস্ত্র ও ত্রাণসামগ্রী পাঠান বিশ্বের কাছে আর্তি জেলেনস্কির
যে মানুষ টাকাকে মাটি বলেন আর মাটিকে টাকা বলেন তিনি কি সত্যিই টাকাকে ঘৃণা করতেন? তবে তিনি কেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকে বলতে পারেন—‘সংসারী লোকের টাকার দরকার আছে। কেননা, মাগ-ছেলে আছে। তাদের সঞ্চয় করা দরকার, মাগ ছেলেদের খাওয়াতে হবে। আমরা দেখছি, পরবর্তীকালে ঠাকুর নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে শ্রীমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছেন। সঞ্চয় করছেন যাতে তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে শ্রীমাকে কারওর উপর নির্ভর না করতে হয়। মায়ের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য তিনি দুশো টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই টাকা শ্রীমা মশলার হাঁড়িতে রাখলে ঠাকুর সাবধান করছেন ‘টাকা অমন করে রাখতে আছে?’ ঠাকুর চাইতেন তাঁর মৃত্যুর পর শ্রীমা কামারপুকুরে থাকবেন, শাক বুনবেন, শাক ভাত খাবেন আর হরিনাম করবেন। পরভাতী ভাল, পরঘরী ভাল নয়। ঠাকুর চাইতেন শ্রীমা যেন একটি পয়সার জন্য হাত না পাতেন।
আরও পড়ুন-কিপিং গ্লাভস! শাস্তি বাবরের
ওই যে আমরা বলছিলাম, আহা যদি শ্রীমা টুকে টুকে রাখতেন। একদিন ঠাকুর জানতে চাইলেন কত টাকা হলে শ্রীমার চলে। শ্রীমার উত্তর—পাঁচ-ছ’ টাকা। পঞ্চবটিতে সীতাকে দেখেছিলেন হাতে ডায়মন্ড-কাটা বালা। অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমাকে সেই বালা গড়িয়ে দিলেন। ঠাকুরের দেহাবসানের পর শ্রীমার উইডো পেনশনের ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে ঠাকুরের মৃত্যুর পর দক্ষিণেশ্বরের মন্দির থেকে দেয় মায়ের সাতটাকা মাসোহারা বন্ধ করে দেওয়া হল। বিবেকানন্দ বললেও কাজ হয়নি। সত্যিই কি টাকাকে ঠাকুর ঘৃণা করতেন? দক্ষিণেশ্বর থেকে ঠাকুর কম টাকা মাইনে পেলেন। শ্রীমা খাজাঞ্চিকে বলায় তিনি বললেন— ‘ছিঃ হিসাব করব?’ শ্রীমা বলছেন, ত্যাগই ছিল ঠাকুরের ঐশ্বর্য। আবার ঠাকুর বলছেন, ‘ঐশ্বর্যভোগের জন্য টাকা নয়, দেহের সুখের জন্য টাকা নয়, লোকমান্যের জন্য টাকা নয়…শরীর টাকা এসব অনিত্য…টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না…’। ঠাকুর বলেছেন, ‘অর্থ যার দাস সেই মানুষ…’। আবার শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘সাধু সঞ্চয় করতে পারে না…আমার পঞ্চবটীর কাছে টাকা গঙ্গার জলে ফেলে দিলুম। তখন একটু ভয় হল, ভাবলুম আমি কি লক্ষ্মীছাড়া হলুম? মা লক্ষ্মী যদি খ্যাঁট বন্ধ করে দেন তাহলে কী হবে? তখন হাজরার মতো পাটোয়ারী করলুম। বললাম মাকে, তুমি যেন হৃদয়ে থেকো’।
বোধিবৃক্ষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ যথাসম্ভব
শংকর | দীপ প্রকাশন
মূল্য ৩০০ টাকা