একটা ব্যাপার সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে গত কয়েকবছর বজ্রপাত খুব বেশি বেড়ে গেছে । আকাশে মেঘ জমলেই সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি পড়ুক বা না পড়ুক শুরু হয়ে যায় বজ্রপাত। এই ব্যাপারে গত কয়েক বছরে মারা গেছে বহু মানুষ এবং আগুন লেগে ধ্বংস হয়েছে জঙ্গল, গাছপালা ও ঘরবাড়ি। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ মনে করেন বৈজ্ঞানিকরা আবহাওয়ার পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ। দেখা গেছে উত্তর মেরুর তাপমাত্রা গত কয়েক দশকে বেড়ে গেছে। আগে এই জায়গায় এত বেশি ঠান্ডা ছিল যে বজ্রপাত তৈরি হবার সম্ভাবনা খুব কম ছিল কিন্তু গত দশ বছরে এই তাপমাত্রা বিশেষ করে গরমের মাসগুলিতে ০.৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ০.৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট হয়ে যাওয়ায় বজ্রপাতও বেড়ে গেছে। এর ফলে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে সমানতালে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় গণতন্ত্র নেই, অপশাসনের রাজত্ব, বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ কুণালের জনসংযোগে তৃণমূল
বৈজ্ঞানিকরা ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল অব্দি বজ্রপাতের সংখ্যা নির্ণয় করে দেখেছেন যে ২০১০ সালে যে সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার তা তিন গুণ বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৪০ হাজার। এই পর্যবেক্ষণ করেছে ওয়ার্ল্ডওয়াইড লাইটনিং লোকেশন নেটওয়ার্ক। এরা সারা পৃথিবীর চারধারে সেন্সরের সাহায্যে বজ্রপাত থেকে নির্গত রেডিও ওয়েভের উপর ভিত্তি তৈরি করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স মার্চ ২৭, ২০২১ সালের অনলাইন মার্চ সংখ্যায়।
আরও পড়ুন-অভিষেক আসার আগেই উত্তপ্ত ত্রিপুরা, আক্রান্ত তৃণমূল কংগ্রেস, নীরব দর্শক পুলিশ
বজ্রপাত থেকে পরিবেশ দূষণ হবার সম্ভাবনা দেখিয়েছেন বৈজ্ঞানিকরা। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে বজ্রপাত হলে প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO) তৈরি হয় বাতাসে যা পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য দায়ী। এই তথ্য প্রমাণ করেছে ক্যালিফোর্নিয়া লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির কিছু গবেষক এবং তা প্রকাশ করেছেন নিউ সাইন্টিস্ট বিজ্ঞান পত্রিকায়। তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন পৃথিবীর চারধারে প্রতি সেকেন্ডে ৭০ থেকে ১০০টা বজ্রপাত হয় । এর ফলে প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন টন নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি হয় বাতাসে। আসলে বজ্রপাতের দরুন বাতাসে গ্যাসগুলি হঠাৎ করে গরম হয়ে গিয়ে ঠান্ডা হলেই নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি হতে থাকে যা অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (NO2) হয়ে যায়। নাইট্রোজেন অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড মিশে গেলে তাকে বলা হয় নাইট্রোজেন অক্সাইডস (NOx)। এই নাইট্রোজেন অক্সাইডস বজ্রপাতের সময় ওজনে (ozone) পরিণত হয় এবং তা পৃথিবীর উষ্ণায়নের পিছনে এক বড় ভূমিকা নেয়।
আরও পড়ুন-হাওড়ার পান পাড়ি দিচ্ছে এবার বিদেশে
বজ্রপাত যেমন পরিবেশ দূষণ করে তেমনি আবার পরিবেশ দূষণ কমায়। বৈজ্ঞানিকরা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করে দেখেছেন যেসব জায়গায় বাতাস খুব বেশি রকম দূষিত সেই সব জায়গায় বজ্রপাতের সংখ্যা অনেক বেশি সাধারণের তুলনায়। এই তথ্য প্রকাশ হয়েছে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যায়। আশ্চর্যের বিষয় এ-ও দেখা গেছে যে কোভিডের সময় লকডাউন হয়েছে যে সকল শহরগুলি সেগুলিতে বজ্রপাতের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এর থেকে পরিষ্কার প্রমাণ হয়ে গেছে যে বজ্রপাত বেশি রকম হয় সে-সকল জায়গায় যেগুলি খুব বেশি রকম দূষিত। সুতরাং দূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের একটা বড় রকম সম্পর্ক পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-নূপুরকে তলব করল নারকেলডাঙা থানা
বজ্রপাত ও দূষণ সম্বন্ধে এত রকম গবেষণা প্রকাশ হবার পরও বৈজ্ঞানিকরা সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে পারেনি বজ্রপাত কীভাবে বাতাস দূষণ করে। আগেই বলা হয়েছে যে বজ্রপাত নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করে যার থেকে প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোক্সিল র্যাডিক্যালস সৃষ্টি হয়। কিন্তু চোখের সামনে এদের তৈরি হওয়া কেউ কখনও দেখেনি। ২০১২ সালে মে ও জুন মাসে ঝড়-জলের সময় বজ্রপাতের ভিতরে নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, NASA) জেট প্লেন চালিয়ে একদল বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য করেছেন যে বজ্রপাত থেকে বিদ্যুৎতরঙ্গ প্রচুর অক্সিডাইজিং এলিমেন্টস তৈরি করে, বিশেষ করে হাইড্রোক্সিল (OH) ও হাইড্রো পারক্সিল রেডিক্যাল (HO2)ধরনের অক্সাইডস যা গ্রিন হাউস গ্যাসগুলিকে ভেঙে দিতে সাহায্য করে। ওই বৈজ্ঞানিকেরা নাসা জেট প্লেনের ভিতর কলোরাডো, অক্লাহমা এবং টেক্সাসের উপর উড়ে বজ্রপাতের সময় হাইড্রোক্সিল র্যাডিক্যাল মাপতে থাকেন। তাঁরা লক্ষ্য করেন যে আরও আরেক ধরনের অক্সাইড র্যাডিক্যাল তৈরি হয়েছে বজ্রপাতের সময়। এইগুলির সংখ্যা প্রায় ১৫০০ ট্রিলিয়ন যা বাতাসকে দূষণমুক্ত করতে অনেক সাহায্য করে। দেখা গেছে মিথেন, যা একটি প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস ও বিশ্ব উন্নয়নের উষ্ণায়নের জন্য দায়ী, তার সঙ্গে বজ্রপাত থেকে নির্গত অক্সিডেন্টগুলি প্রতিক্রিয়া করে এমন ধরনের পদার্থ তৈরি করতে পারে যা সহজে বৃষ্টির জলে গুলে গিয়ে মাটিতে পড়তে পারে বা মাটির সঙ্গে আটকে যেতে পারে। এই তথ্য প্রকাশ পায় সায়েন্স নামের বিজ্ঞান পত্রিকার ২৯ এপ্রিল ২০২১ সালে।
আরও পড়ুন-জোগাড়েপুত্রের ছেলে ত্রয়োদশ
এই নতুন আবিষ্কৃত তথ্য আগের সব রকম ধারণা ওলট-পালট করে দিয়েছে। এতদিন যাঁরা মনে ধারণা করে রেখেছিলেন যে বজ্রপাত দূষণ বাড়াতে পারে তা সম্পূর্ণ উল্টে অন্য তথ্য পাওয়া গেল। এই পরীক্ষাতে এখন আরও প্রমাণ হয়ে গেল যে বজ্রপাত দূষণ বাড়ায় না, দূষণ কমাতে সাহায্য করে। যে দূষণ ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য বজ্রপাত বেড়ে চলেছে গত কয়েক বছর ধরে তার অপকারিতা অনেক বেশি থাকলেও এখন দেখা যাচ্ছে যে তার কিছু উপকারিতাও আছে। সুতরাং, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বজ্রপাতের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। তবে এই তথ্যকে সঠিক প্রমাণ জন্য অবশ্যই আরও অনেক বেশি গবেষণার দরকার হবে নিকট-ভবিষ্যতে।