ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং, সংক্ষেপে এনসিইআরটি। দেশের বিদ্যালয় শিক্ষার পাঠ্যক্রম প্রস্তুতি ও সেই পাঠ্যক্রম অণুসরণ করানোর ক্ষেত্রে এই সংস্থার গুরুত্ব সর্বজনবিদিত। কেন্দ্রীয় স্তরে পরিচালিত সব ক’টি বিদ্যালয়ে এনসিইআরটি প্রবর্তিত সিলেবাস অনুসৃত ও এনসিইআরটি কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হবে।
সেই এনসিইআরটি-কে এবার শিক্ষায় গৈরিকীরণের কাজে সরাসরি লাগাচ্ছে মোদি সরকার।
আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা
বিষয়টি বুঝিয়ে বলার জন্য চুম্বকে কয়েকটি তথ্য। তাতেই স্পষ্ট হবে ঠিক কী করতে চাইছে ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির সরকার।
এনসিইআরটি-র পাঠ্যপুস্তক থেকে যেসব বিষয় বাদ পড়েছে সেগুলো হল : ১. গুজরাত দাঙ্গা। ২. জরুরি অবস্থা জারির ফলাফল। ৩. নর্মদা বাঁচাও, ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন, দলিতপন্থীদের আন্দোলন ইত্যাদি সামাজিক বিষয়ে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ-কর্মসূচি প্রভৃতি।
২০১৪ সালে মোদি জমানার শুরু। ২০১৭-তে এনসিইআরটির বইগুলোতে ১,৩৩৪টি পরিবর্তন। ১৮২টি পাঠ্যপুস্তকে এই বদলগুলো কার্যকর করা হয়।
এর পর ২০১৯। তদনীন্তন শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর সিলেবাসের বোঝা কমানোর অছিলায় ফের কোপ বসান পাঠ্যপুস্তক সমূহে। আঘাত মূলত নেমে এসেছে ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা-সহ সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বইয়ে।
আরও পড়ুন-উর্দি ছেড়ে কোচিং শিক্ষক পুলিশ
বুঝতে অসুবিধা হয় না, সমাজবিজ্ঞান কেন এদের সফট টার্গেট। ইতিহাস চাপা দিতে পারলে, প্রতিবাদী ঐতিহ্য ধামাচাপা দিতে পারলে, শিড়দাঁড়াগুলো নোয়ানো সহজ হয়। যুক্তিবুদ্ধি পরম্পরার জল-হাওয়া না পেলে শিকড় বিস্তার করতে পারে না। এখনই তো স্বাধীন চিন্তার উৎপাটন সহজ হয়ে যায়। সেজন্যই এই আয়োজন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০০১-’০২ এর রিপোর্টে গুজরাত দাঙ্গার বিষয়ে যেসব কথা বলা হয়েছিলে তার সংক্ষিপ্তসার ছিল এখানে। আর ছিল এসময়কার সংবাদপত্রের প্রতিবেদনসমূহের কোলাজ।
দ্বাদশ শ্রেণির সমাজবিদ্যা বা সোশ্যাল সায়েন্সের বই। সেখানেও ‘ভারতীয় সমাজ’ শীর্ষক অধ্যায়ে গুজরাত দাঙ্গার প্রসঙ্গ ছিল। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছিল কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে মানুষ ধর্ষক, লুঠেরা, খুনি হয়ে ওঠে, সেই প্রসঙ্গ, সেসব বাদ।
বাদ দিলেই তো আগামী প্রজন্মকে এসব বিষয়ে অন্ধকারে রাখতে সুবিধা।
দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে বাদ পড়েছে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত আলোচনা। তখন কীভাবে রাষ্ট্রশক্তি তাদের ক্ষমতা দিয়ে দমিয়ে রেখেছিল গণমাধ্যমকে, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে, কীভাবে বিচারাধীন বন্দিকে মেরে ফেলা হত চুপিচুপি, জবরদস্তির নির্বীজকরণের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল সমাজজীবনে, গরিব জনতার পরিযায়ী হয়ে যাওয়া, সেসব তথ্য।
আরও পড়ুন-তুমি অনেকেরই প্রেরণা, কার্তিককে হার্দিক
কিন্তু এসব জানলে, শিখলে, বুঝলে তো মুশকিল হয়ে যাবে। আজকের প্রজন্ম ইন্দিরা আমলের ঘোষিত জরুরি অবস্থার সঙ্গে মোদি জমানার অঘোষিত জরুরি অবস্থার তুল্যমূল্য আলোচনা করতে শুরু করবে। তাহলেই তো মুশকিল। অতএব ওসব বাদ, একেবারে বাদ।
ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একাধিক পাঠ্যপুস্তকে গণ-আন্দোলনগুলি আলোচিত হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের মদবিরোধী আন্দোলন, সর্দার সরোবর প্রকল্পের বিরুদ্ধে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, তথ্যের অধিকার পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন ইত্যাদি।
মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা, অরণ্যে যাওয়া মৎস্য সংঘ কীভাবে বনবাসীদের উচ্ছেদের প্রতিবাদে আন্দোলনের কথাও বাদ সপ্তম শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে।
আরও পড়ুন-পেট্রাপোল সীমান্তের পার্কিং লটে তিন পণ্যবোঝাই গাড়িতে আগুন
১৯৮৭-তে কর্নাটকে অহিংস কিট্টিকো-হাচ্চিকো পরিবেশ আন্দোলনের ওপরেও কোপ পড়েছে। কাঁসিরামের ‘ব্যাকওয়ার্ড অ্যান্ড মাইনোরিটি-কমিউনিটিজ এমপ্লয়িজ ফেডারেশন’ তৈরির অতিবৃত্তেও কোপ।
পরিবেশ হোক বা দলিতের দাবিদাওয়া, যে-কোনও বিষয়ে গণ-আন্দোলনই তো এই শাসকপক্ষের না-পসন্দ।
জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ভাকরা নাঙ্গালের মতো বৃহৎ প্রকল্পই আধুনিক ভারতের মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার। সেকথা জানাজানি হলে রামমন্দির-জ্ঞানবাপী-মথুরা কৃষ্ণ জন্মভূমি নিয়ে আন্দোলন মাঠে মারা যাবে। তাই দ্বাদশ শ্রেণির সমাজবিদ্যার বই থেকে জওহরলালের ওই উদ্ধৃতি উধাও। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে বাদ সম্রাট অশোকের শান্তি ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের প্রতি নেহরুর শ্রদ্ধাজ্ঞাপক উক্তি।
আসল ইতিহাস ঐতিহ্য পরম্পরা, সব ভুলিয়ে গুলিয়ে নিজেদের পছন্দমতো ইতিহাসের উপস্থাপনাই এই পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য।
সহিষ্ণু ভারতের সনাতন অবস্থান নষ্ট করাটাই তো এদের একমাত্র কাজ।