পৃথিবীর বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ক্যালেন্ডার। calere থেকে calendi কালেন্দি থেকে কালেন্দারিয়াম বা ক্যালেন্ডার। অফিস-কাছারি স্কুল কলেজ থেকে বিবাহাদি সবই ক্যালেন্ডারের তারিখ ধরে চলে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ক্যালেন্ডার ছাড়া আমাদের চলেই না। ক্যালেন্ডারকে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। যে জাতি যত সভ্য তার ক্যালেন্ডারও ততই বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে উন্নত হয়েছে। ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন অতি প্রাচীনকাল থেকে সবদেশই অনুভূত হয়েছে। ক্যালেন্ডারের উপকরণ তিনটি : প্রথমত দিন বা পৃথিবীর আহ্নিক গতি যা ২৪ ঘণ্টায় পূর্ণ হয়। দ্বিতীয়ত চান্দ্রমাস বা পূর্ণিমা-অমাবস্যার আবর্তনকাল বা দিন যা ২৯.৫৩০৬। তৃতীয়ত, পৃথিবীর সৌর বৎসর বা পৃথিবীর একবার সূর্যকে ঘুরে আসবার সময় যার পরিমাপ ৩৬৫.২৪২২ দিনে হয়। সে এক জটিল গাণিতিক বিষয়। পৃথিবীর চান্দ্রমাস বা পূর্ণিমা-অমাবস্যার আবর্তনকাল ২৯.৫৩০৬ দিনে হয়, আবার সূর্যকে পৃথিবী একবার পাক খেয়ে আসতে সময় নেয় ৩৬৫.২.৪২২ দিন। এই পাটিগণিত খুব খটোমটো। হিসাব মেলানো অতি দুরূহ কর্ম। পূর্ণসংখ্যা পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন-একটি দিবাস্বপ্ন
মিশরে চাঁদের হিসেব দিয়ে বছরের হিসেব শুরু হয়েছিল। প্যালেস্তাইনের ইনকারা বছরের হিসেব ধরত তাদের ফসল কাটা দিয়ে। ভারতে শরৎকাল দিয়ে বছরের হিসেব করা হত বলে অনেকে মনে করেন। আবার যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতো গবেষকদের মতে সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের মধ্য দিয়ে বছর গণনার শুরু। আগেই বলা হয়েছে কারও মতে দিন গোনা হত চাঁদের হিসেবে। কৃষ্ণ পক্ষ ও শুক্ল পক্ষ। ঋক্ বেদের সময়ে দিন বা মাস বোঝানো হত নক্ষত্রের নামানুসারে। পরবর্তীকালে ভারতে সম্রাট আকবরের সময়ে প্রবর্তিত হয় হিজরি ক্যালেন্ডার। মুসলিমরা হিজরি ক্যালেন্ডার মেনে তাদের ধর্মীয়-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে। তখনকার ৯৬৩ হিজরি সালকে ধরেই বাংলা বৈশাখ থেকে এই ক্যালেন্ডারের শুরু হল। যদিও এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এখানেই আসে ভারতে আর্য আগমনের কথা। আর্যরা ভারতে এসেছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের আগে।
আরও পড়ুন-বিশ্ব উদ্বাস্তু দিবসের ভাবনা
শক ক্যালেন্ডারেই প্রথম সৌর বছর ও সৌর মাস গণনা শুরু হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছে মেষ রাশি থেকে সূর্যের প্রবেশ মাস। বছরের প্রথম চান্দ্র মাস ছিল চৈত্র। শক ক্যালেন্ডারই ভারতের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ক্যালেন্ডার। শকাব্দের ব্যবহার শুরু করেন বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী বরাহমিহির। বরাহমিহিরের সময় থেকেই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ক্যালেন্ডারের প্রচলন বলা চলে। দেশে শক ক্যালেন্ডারকে বিজ্ঞানসম্মত করেন বিখ্যাত দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ বরাহমিহির। তিনি একজন মস্ত কবিও। শক জাতিভুক্ত এই বরাহমিহিরই বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে ধরে চলার প্রচলন করেন। এই শক ক্যালেন্ডারে প্রথমে গ্রিক নাম লেখা হত, কিন্তু পরে তা পাল্টে ভারতীয় নাম করা হয়।
আরও পড়ুন-আইসক্রিমের রূপকথা
বঙ্গাব্দের শুরু অর্থাৎ ১৫৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল। কারণ ওইদিন সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। যদিও বঙ্গাব্দ শব্দটির ব্যবহার প্রচলন হয় বেশ কিছু পরে। কথিত আছে, সময়ানযুায়ী যথেষ্ট ফলনের উপর বা কৃষিকার্যের উৎপাদন থেকে সঠিক সময়ে সঠিক কর নেওয়া এবং কৃষকদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয় বঙ্গাব্দ। তাই ফসল ওঠার সময়টিকেই বছরের শুরু বলে ধরা হত। এই জন্য নতুন ফসল ওঠাকে সন নামে লোকে বেশি চিনত। সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের তারিখ নিয়ে আবার কোনও কোনও গবেষকের বিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ১৪ এপ্রিল নয়, তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাঁদের মতে সেই সময়ে বঙ্গদেশে সৌর শকাব্দের প্রচলন ছিল ব্যাপক। তার ফলে আকবরের প্রবর্তিত সনের বছর পয়লা দিনটি ওই শকাব্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। শকাব্দ আরম্ভ হয় সূর্য মেষ রাশিতে যখন অবস্থান করে, অর্থাৎ মেষ সংক্রান্তির পর। সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি বা বৈশাখের গোড়ার দিক। সেই থেকেই নাকি বৈশাখের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে ১লা বৈশাখকে বাংলা নতুন বছরের শুরু ধরা হলেও অতীতে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় নববর্ষ পালিত হত।
আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা
গণনা চলছে সঠিকভাবে বলতে গেলে ৪৬৪ বছর ধরে। ভারতের স্বাধীনতার পর যে মানুষটি ক্যালেন্ডার নিয়ে অনেক সময় কাটিয়েছেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিজ্ঞানসম্মত করে তুলেছেন তাঁর নাম মেঘনাদ সাহা। তাঁর উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি। তার আগে ১৯১০-’১৪ ছিল ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমাসের্র ইন্টারন্যাশনাল ক্যালেন্ডার। সেটি ছিল ১৩ মাসের ক্যালেন্ডার। ১৯৩১ সালে ক্যালেন্ডার নিয়ে আন্তর্জাতিক সভাও বসেছিল। বর্তমানে যান্ত্রিক যুগের সঙ্গে-সঙ্গে আবিষ্কার হয়েছে বৈদ্যুতিন ক্যালেন্ডারও। নিজে থেকেই তাতে তারিখ মাস বদল হয়ে যায়। সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। বিশ্বায়নের ফলে প্রায় সবদেশের ক্যালেন্ডারে পড়েছে ভিনজাতীয় প্রভাব। ঢুকছে নতুন-নতুন নিয়ম-রীতি হিসেব। যেমন, নানা সময়ে কোথাও-কোথাও ঢুকেছে ফেংশুই থেকে আরও অনেক নতুন শুভ-অশুভর ভাবনাচিন্তা। যদিও ফেংশুই বা বাস্তু সংস্কার অনেক প্রাচীন বিষয়। পুরনো বাংলা পাঁজিতেও বাংলা মতে গৃহের শুভাশুভের অনেক কথা আছে।
আরও পড়ুন-আগামীর পড়ুয়াদের অতীত, না-চেনাতে এবার বইয়ে বদল
আজ আমরা বাংলা-ইংরেজি দুই ধরনের ক্যালেন্ডারে অভ্যস্ত। কতজন আর বাংলা তারিখ মনে রাখি? বাৎসরিক হিসাব থেকে অফিস কাছারি সব কিছুই হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতে। কিন্তু আমরাই বিয়ে, অন্নপ্রাশন, গৃহপ্রবেশ, জন্মসময়, জমি-বাড়ি কেনা থেকে গৃহপ্রবেশ সবেতেই বাংলা ক্যালেন্ডারের দ্বারস্থ হই। বাংলা ক্যালেন্ডারের কথা বলতে গেলে পাঁজির কথা আসবেই। পাঁজিরও অনেক ইতিহাস। উনিশ শতকে ছাপা বই পঞ্জিকার কথা শোনা গেল। তার আগে স্থানীয় বহু বা এক ধরনের মানুষ বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বার-তিথিতে নানান করণক্রিয়ার কথা শুনিয়ে গৃহস্থকে মঙ্গল-অমঙ্গলের সন্ধান দিতেন। এর বিনিময়ে তাঁরা কিছু সিধে বা পাব্বনি পেতেন। অবশেষে এল পাঁজি।
আরও পড়ুন-তুমি অনেকেরই প্রেরণা, কার্তিককে হার্দিক
শুভাশুভ দিনকে ছাপার অক্ষরে পেল গৃহস্থ বাঙালি। কোন কোন দিনে কী কী খাওয়া নিষেধ, কোন সময় যাত্রা শুভ এবং কোনটা অশুভ এসবই নিদান দিত পাঁজি। মুখে মুখে চালু হল সেদিন ‘অক্লেশে নাই, পঞ্জিকা সকলের ঠাঁই দেখিবে যখন মনে’। ১৮৩৫-এ দীনবন্ধু প্রেস ‘শুভাশুভ দিনক্ষণ নির্দেশক পাঁজি’ মুদ্রিত আকারে বের করল। আর এই পাঁজি বের করার সঙ্গে-সঙ্গে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নাম সুবিখ্যাত হয়ে আছে। সেই পথ ধরে কালে কালে বেশ কিছু পঞ্জিকাওয়ালার জন্ম এই বাংলাদেশে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পাঁজি বিকিয়ে যায় বাংলার ঘরে ঘরে তো বটেই এমনকী বিদেশেও বাঙালি পরিবারে। আর এই পাঁজি আর ক্যালেন্ডারের হিসেবেই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।