ভাস্কর ভট্টাচার্য: তিনিই প্রথম ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ভারতীয় স্নাতক। তিনিই প্রথম অসমে পেট্রোলিয়ম আবিষ্কার করেন। প্রথম ভারতে সাবান কারখানা তৈরি করার পেছনে রয়েছে তাঁর অবদান। ভূতাত্ত্বিক হিসাবে মধ্যপ্রদেশের ধুল্লি ও রাজাহারায় লোহার খনি আবিষ্কার করেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে অসামান্য কৃতিত্ব ছিল ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের গরুমহিষানি পাহাড়ে লোহার আকরিক মজুত আবিষ্কার। তারই ফলে ভিলাই কারখানা স্থাপন সম্ভব হয়েছিল। আজকের টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানির (১৯০৪) গড়ে ওঠার পেছনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। যার জন্য টাটা কোম্পানি আজও এই বাঙালিকে সগর্বে স্মরণ করে। এমন অনেক প্রথম কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই বাঙালির নাম।
তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার উচ্চপদে বসেছিলেন। যদিও রাজনৈতিক কারণে তাঁকে সেখান থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে তার সময়কালে, ডিরেক্টর, উইলিয়াম কিং তাঁর রিপোর্টে চমৎকার এবং অর্থনৈতিক কাজের জন্য প্রশংসা করেছেন। ১৮৮৭ সালের অগাস্ট মাসে তিনি ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হন এবং তিনি ১৮৮8 জুলাই, ১৮৯৫ এর ১৫ মে পর্যন্ত অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২৩ বছর ধরে ভূতাত্ত্বিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বৈষম্যমূলক নীতির কারণে তাঁকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। ভূতাত্ত্বিক-এই বিজ্ঞানীর উৎসাহেই দেশের কারিগরি শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। আর যে প্রতিষ্ঠানটির কথা না বললে তাঁর সম্পর্কে বলা সম্পূর্ণ হয় না তা হল, বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট যা আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম সম্মানসূচক অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
ভূতাত্ত্বিক গবেষণার কারণেই তিনি নিম্ন বার্মায় বেশ কয়েকটি দুর্গম পথ অতিক্রম করেছিলেন যেখানে তাঁর আগে কেউ পা রাখেননি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি নর্মদা অঞ্চল থেকে ট্র্যাকাইটের ঘটনার রিপোর্ট করেছিলেন।
১২ মে ১৮৫৫ প্রমথনাথ বসু পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গোবরডাঙার কাছে গৈপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দেশে- বিদেশে ছড়িয়ে বিভিন্ন কাহিনি তাঁর গোটা জীবন জুড়েই। গোটা জীবনজুড়েই রয়েছে শিক্ষা বিস্তার ও নানা আবিষ্কার কাহিনি। প্রবল অনুসন্ধানী এই মানুষটি রানিগঞ্জ, দার্জিলিং ও অসমে কয়লা, সিকিমে তামা এবং ব্রহ্মদেশেও খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান করেছিলেন। এবং আপামর ভারতবাসীকে সব সময় প্রবল উতসাহ ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কথা স্মরণ করিয়েছিলেন। একজন ভূতাত্ত্বিক হিসেবে সবসময় সন্ধান করে গেছেন। প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে ওঠা বিজ্ঞানী-ভূতত্ত্ববিদ মজা করে বলতেন, ‘‘আমাদের পাঁচজন সেরা চিকিৎসক ছিল—রোদ, জল, ব্যায়াম এবং খাদ্য।’’
আরও পড়ুন-দল ও নেত্রী একটাই, কোনও উপদল নয়: দুই জেলা নেতৃত্বকে কড়া বার্তা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
মাত্র দশ বছর বয়সে প্রমথনাথ ব্রাহ্মসংস্কারক কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে আসেন। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এন্ট্রান্স ও ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এফএ পাশ করেন কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। এই কলেজে পডতে পডতেই গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনে পড়তে যান। এই লন্ডন যাওয়ার পেছনে সব থেকে বড় অবদান ছিল কেশবচন্দ্র সেনের। লন্ডনে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে সেখানেই রয়্যালস স্কল অফ মাইনসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে। পাঁচ বছরের জন্য স্কলারশিপ পান। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮০ তিনি লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, ভূ্গোল এবং যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। মেধাবী প্রমথনাথ লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক করার সময় ভূতত্ত্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। হয়ে ওঠেন একজন জিয়োলজিস্ট।
আরও পড়ুন-আদিবাসীদের সম্মান, অধিকার অব্যাহত থাকবে: বিশ্ব আদিবাসী দিবসে বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
দেশে ফিরে এসে যোগ দেন জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায়। কিন্তু সেখানে তাঁর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের মতান্তর হয়। বিদেশে থাকাকালীন তাঁর ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে উচ্চপদ দিতে অস্বীকার করে। তিনি পদত্যাগ করেন। যদিও এই সময়ের কর্মজীবনেই বাঙালি এই মেধাবী মানুষটি অনেকগুলি কীর্তি স্থাপন করেছিলেন যা আজও ভারতবাসী স্মরণ করে। আগেই বলা হয়েছে তাঁর উৎসাহেই লৌহ ও খনিজ শিল্প গড়ে ওঠে ও ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশে যার অবদান অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন-ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাড়িতে আচমকা তল্লাশি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার
১৮৮০তে জিওলজিক্যাল সার্ভেতে যোগ দেন। কাজের মধ্যেই অুনভব করেন ভারতীয় ছাত্রদের শিক্ষার জন্য বিজ্ঞানমূলক বই দরকার। নিজেই হাত লাগালেন বই লেখায়। লিখে ফেললেন ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’-এর ওপর বই। শিশুদের জন্য লিখলেন ‘শিশুপথ’। ১৮৯১ সালে তাঁর উদ্যোগেই কলকাতায় প্রথম শিল্প সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্য প্রসারের জন্য অনেক চেষ্টা করেন। ভূতাত্ত্বিক গবেষণার কাজের পাশাপাশি ১৮৯৪-১৮৯৬ এই তিন বছরের গবেষণায় লেখেন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘এ হিস্ট্রি অফ হিন্দু সিভিলাইজেশন আন্ডার ব্রিটিশ রুল’। অর্থাৎ, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে হিন্দু সভ্যতার ইতিহাস। তিন খণ্ডে লিখিত এই বই একদিকে তাঁকে যেমন ভারতপ্রেমী হিসেবে তুলে ধরেছিল, অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার তা ভাল চোখে দেখেনি। ক্রমশই তিনি ভারতের মুক্তি সংগ্রামের এক অগ্রপথিক হিসেবে, রাজনৈতিক জীবনে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে, মুক্ত সাধনায় তিনি নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা হয়ে উঠেছিল চোখে পড়ার মতো। সে সময়ে দেশের প্রথম শ্রেণির নেতাদের বুদ্ধি ও পরামর্শ জুগিয়েছেন তিনি। যা ব্রিটিশের চক্ষশূল হয়ে উঠেছিল। এ ছাড়াও নানা সময়ে অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তিনি লিখে গেছেন— ‘সার্ভাইভ্যাল অফ হিন্দু সিভিলাইজেশন’, ‘সাম প্রেজেন্ট ডে সুপারস্টিশন’, ‘স্বরাজ— কালচারাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল’ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-১৫ অগাস্ট খোলা পোস্ট অফিস
১৯৩৪ সালে ৭৯ বছর বয়সে তিনি ইতিহাসের ইতিহাসে চলে গেছেন। স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম দিবসের প্রাক্কালে গোটা ভারত একদিকে যেমন বীর-বিপ্লবীদের স্মরণ করবে তেমন এইসব কর্মোদ্যোগী কৃতী বাঙালিদের কথাও ভুলবে না।