১৯৫৮ সালে প্রথম মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের হদিশ মেলে এবং কঙ্গোতে ১৯৭০ সালে প্রথম মানবদেহে এই ভাইরাস সংক্রমণকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। ২০১৮ সালে ব্রিটেনে এই ভাইরাস আক্রান্তের খোঁজ মিললেও তা ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু গত ৭ মে প্রথম ইংল্যান্ডে এর ধরা পড়ার পর ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই মাঙ্কিপক্স। শেষরক্ষা হয়নি। এরপর ভারতেও পৌঁছে গিয়েছে এই ভাইরাস।
আরও পড়ুন-‘হাতি তার পথে চলতে থাকে, কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে থাকে’ অজয় মিশ্রর বক্তব্য ঘিরে প্রতিবাদ তৃণমূল কংগ্রেসের
মাঙ্কিপক্স কী
মাঙ্কিপক্স হল একটি ভাইরাস জনিত সংক্রমণ। এটি আমাদের খুব পরিচিত একটি ভাইরাস গোষ্ঠীর সংক্রমণ যেটির নাম অর্থোপক্স ভাইরাস। যে পক্সটিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান আজও গর্বিত সেটি হচ্ছে স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত। এই মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সঙ্গে খুব সাযুজ্যপূর্ণ লক্ষণ রয়েছে স্মলপক্সের। এর সিভিয়রিটি বা স্মলপক্সের তুলনায় অনেক কম। ১৯৮০ সালে স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত চলে যায় কিন্তু মাঙ্কিপক্স মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ছিল এবং সাধারণভাবে দুটি প্রজাতিকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। একটি পশ্চিম আফ্রিকায় পাওয়া মাঙ্কিপক্সের বিশেষ প্রজাতি অপরটি হল কঙ্গো বেসিনে পাওয়া মাঙ্কিপক্সের প্রজাতি, যেটাকে অনেকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতিও বলে থাকে।
আরও পড়ুন-২ কোটির বেশি খরচে বিজেপির প্রশিক্ষণ শিবির
কীসের থেকে সংক্রমণ
মাঙ্কিপক্স আসলে জুনোসিস অর্থাৎ এই রোগটি প্রাণীদের থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। বিশেষ করে যে ট্রপিকাল রেনফরেস্টগুলো আছে সেখানে মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস যারা ছড়ায় সেই ধরনের প্রাণী পাওয়া যায়। সাধারণ ভাবে একটি অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী কাঠবিড়ালিকে চিহ্নিত করা গেছে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস ইনফেকশনের সোর্স হিসেবে। এছাড়া বিশেষ প্রজাতির বানর, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং গাম্বিয়ার প্রদেশের কিছু বিশেষ প্রজাতির ইঁদুরও মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ ছড়ায়।
আরও পড়ুন-জোর করে পঞ্চায়েতে ভোট নয় : অভিষেক
মানবদেহে এর প্রভাব
এক্ষেত্রে অনেকের প্রশ্ন, মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর সম্ভাবনা কতটা। তাহলে বলা যায় সেই প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব সীমিত। তবে এই সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ নেই। কারণ ছ’টি ধাপে মাঙ্কিপক্স সংক্রমিত হয়েছে এমন ঘটনাও রয়েছে। সেই ঘটনায় শেষ যিনি ইনফেকটেড বা সংক্রমিত হয়েছিলেন তিনি একজন মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত ব্যক্তির থেকেই আক্রান্ত হয়েছিলেন এমনটা প্রমাণিত সত্য। যার প্রথমে মাঙ্কিপক্স হয়েছিল তার থেকে পরপর ছ’জনের কোনও লক্ষণ দেখা দেয়নি, সাত নম্বর ব্যক্তির শরীরে মাঙ্কিপক্স দেখা গিয়েছিল।
আরও পড়ুন-প্রয়াত সাংবাদিক স্বর্ণেন্দু দাস, শোক প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
কীভাবে ছড়ায়
মাঙ্কিপক্সে ত্বকে যে ফুসকুড়ি বা ফোসকা হয় সেই ফোসকা থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে যায়। সাধারণভাবে মুখ, গলা এবং মানবদেহের রেসপিরেটরি ড্রপলেটের মধ্যে দিয়েও কিন্তু এই ভাইরাসটি ছড়াতে থাকে।
কোভিডে যেমন পিসিআর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রোগ চিহ্নিতকরণের জন্য তেমনই মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও ভাইরাল ডিএনএ আইডেন্টিফাই করা যায় পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে। স্কিন র্যাশ বা ফ্লুইড নিয়েও পরীক্ষা করা হয়।
যে কোনও সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ইনকিউবেশন পিরিয়ড জানাটা খুব জরুরি। যখন থেকে আমার শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করল তখন থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত শরীরে কোনও সিম্পটম ডেভেলপ না করছে সেই সময়সীমা হল ইনকিউবেশন পিরিয়ড। অর্থাৎ এই সময় ভাইরাসটি শরীরে রয়েছে কিন্তু সে কখনও সিম্পটম তৈরি করেনি এবং জানান দেয়নি রোগটি হয়েছে। সাধারণ ভাবে এই সময়সীমা ছয় থেকে তেরোদিন পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে একুশদিন পর্যন্ত ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি একটু চিন্তার বিষয়।
আরও পড়ুন-মশলাপুরাণ
সংক্রমণের ক্ষমতা
র্যাশ বেরনোর এক দু’দিন আগে থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না আবার সব র্যাশ শরীরে মিলিয়ে গেল ততক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তির অন্যকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা থাকে।
সাধারণত একজন মানুষ থেকে আর একজন মানুষের ছড়ানো ক্ষমতা বড় বড় রেসপিরেটরি ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়।
যদি সরাসরি সংযোগ হয় অর্থাৎ মাঙ্কিপক্স হয়েছে যাঁর তাঁর ওই র্যাশ থেকে নির্গত ফ্লুইড বা রস যদি কারও শরীরে লাগে তাহলে তারও মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।
কখন সতর্কতা
কারও যদি কোনও ট্রাভেল হিস্ট্রি থাকে এমন কোনও দেশে যেখানে মাঙ্কিপক্স হচ্ছে। সেটা বিগত একুশ দিনের মধ্যে হতে হবে। তখন কোনও কারণ ছাড়া যদি ত্বকে অ্যাকিউট র্যাশ বেরয় তাহলে সন্দেহ করতে হবে।
এর সঙ্গে লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা, সারা শরীর ব্যথা হওয়া, খুব দুর্বলতা এই লক্ষণগুলি থাকে তাহলে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
আরও পড়ুন-ভদ্রেশ্বরে বন্ধ দোকানে বিস্ফোরণ নিয়ে ধন্দ
তখন যোগসূত্র খুঁজতে হবে কী কারণে এগুলো হচ্ছে এবং যখন থেকে আমরা আশঙ্কা করছি মাঙ্কিপক্স তখন থেকে সতর্ক হতে হবে যাতে এটা অন্য কারওর মধ্যে আর না ছড়ায়। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তার মুখোমুখি যেন কেউ না হয়। যে সব স্বাস্থ্যকর্মীরা এই রোগীর সামনে আসবেন তাঁদের মুখে যেন প্রপার পিপি পরা থাকে।
সরাসরি ফিজিক্যাল কনট্যাক্ট বা ত্বকের সংযোগ না হয়। আক্রান্ত রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন বিছানায়, বালিশ, খাওয়া-দাওয়ার, বাসন-কোসন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
মাঙ্কিপক্সের ভাইরাল ডিএনকে শনাক্তকরণ করতে হবে পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে।
মাঙ্কিপক্সের যে সিম্পটম দু’ থেকে চার সপ্তাহ থাকতে পারে। বাচ্চাদের কিছু কমপ্লিকেশন হয়, সিভিয়র হয়ে যেতে পারে। তাই ছোটদের জন্য সাবধান হতে হবে।
আরও পড়ুন-মহাকাশে প্রথম জনজাতি নারী
মাঙ্কিপক্স রোগীর মর্টালিটি রেট বা মৃত্যুহার কিছু কিছু দেশে জিরো পার্সেন্ট বা শূন্য হলেও কিছু দেশে কিন্তু এগারো শতাংশ। তাই অবশ্যই এটা ভাবার বিষয়। যারা খুব ছোট শিশু তাদের ক্ষেত্রে মর্টালিটি অনেক বেশি।খুব সতর্ক থাকতে হবে।
উপসর্গ
যে কোনও ভাইরাল ইনফেকশনে শরীরে লক্ষণ পরিলক্ষিত হবার আগেই প্রোড্রম পিরিয়ড থাকে অর্থাৎ স্কিন র্যাশ বেরনোর আগে কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় যেগুলোর মধ্যে জ্বর তো আছেই, বিভিন্ন লিম্ফনোডগুলো বেশ ফুলে যায় যেমন কানের পিছনের লিম্ফনোড, বগলের বা অ্যাক্সিলারি লিম্ফনোড এবং গলার লিম্ফনোডগুলো বা কুঁচকি কাছে যে ইঙ্গুইনাল লিম্ফনোড থাকে সেগুলো ফুলে যেতে পারে।
মাথাব্যথা, মাসল পেন, খুব ক্লান্তি থাকতে পারে।
ভীষণ কাঁপুনি সহ জ্বর আসতে পারে। খুব ঘাম বেরনো, কাশি থাকতে পারে, গলা ব্যথাও হতে পারে।
সাধারণ ভাবে জ্বর আসার এক থেকে তিনদিনের মধ্যে পক্স বেরতে শুরু করে এবং দুই থেকে চার সপ্তাহ রাশ থাকে।
বিভিন্ন রোগ যেমন চিকেন পক্স, হারপিস জস্টার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হারপিস সিমপ্লেক্স, মিজিলস এবং শিশুদের হ্যান্ড ফুট মাউথ ডিজিজ হয় সেই ক্ষেত্রেও এই রকমই র্যাশ বেরয় যার সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের মিল রয়েছে। কাজেই দেখতে হবে বা বুঝতে হবে আসলে কী হয়েছে।
আরও পড়ুন-ভাবা অ্যাটোমিকে নার্স, সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ
কমপ্লিকেশন
মাঙ্কিপক্স থেকে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের সম্ভাবনা থাকে। লাং-এ সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া হতে পারে, সিভিয়র ইনফেকশন বা সেপসিস হতে পারে, ব্রেন বা মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা এনকেফেলাইটিস হতে পারে। এমনকী কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্নিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেছে।
চিকিৎসা
রোগীকে আইসোলেট করে রাখতে হবে।
প্রোটেকশন নেওয়া অর্থাৎ স্কিন বা মিউকাস মেমব্রেনের যে ক্ষত হয়েছে সেই জায়গাগুলোর যত্ন নেওয়া।
বেশি করে জল খেতে হবে।
পুষ্টিকর খাওয়া-দাওয়া করতে হবে।
সিম্পটম অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা। নতুন কী কী হচ্ছে সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
অযথা ভয় পাবার দরকার নেই।
আরও পড়ুন-জিতে শুভমনের প্রশংসায় রাহুল
যাঁদের মাঙ্কিপক্সের মতো র্যাশ বেরিয়েছে তাঁদের থেকে দূরে থাকতে হবে।
র্যাশ চলে যাবার পর যে খসখসে দাগ থাকে একে স্ক্যাব বলা হয়। এই স্ক্যাবের সংস্পর্শে কোনওভাবে না আসা।
মাঙ্কিপক্স রোগীর ব্যবহার্য বস্তু আর ব্যবহার করা যাবে না। বাতিল করে দিলেই ভাল।
মাঙ্কিপক্স হয়েছে যাঁর তাঁর বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। এমনকী সাধারণ মানুষ যাঁদের মাঙ্কিপক্স হয়নি তাঁরাও নিয়মিত হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজেশন বিধি মেনে চললে এই ধরনের সংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন।