ভালবাসা, জেদ, গর্ব, অহংকার, সবকিছু মিলেমিশে একাকার

দুর্গাপুজোয় ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বঙ্গসংস্কৃতির মুকুটে একটা নতুন পালক সংযোজন। অথচ সেটাকে ঘিরেই ক’দিন ধরে নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে চলল কুৎসার বৃন্দগান। কিন্তু সৌজন্যবোধের শিক্ষয়িত্রী যিনি, তিনি আপন কর্তব্যে অবিচল। তিনি দেখালেন আলো, চেনালেন পথ। লিখছেন অশোক মজুমদার

Must read

শিক্ষা আনে সভ্যতা। সত্যিই কি তাই? আজকাল আমার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখে কখনওই সেটা মনে হয় না। শিক্ষা যদি সভ্যতাই আনত তবে অনৈতিক, মিথ্যা, অকারণে কাউকে কালি ছিটানোর এক অদ্ভুত পাগলের মতো প্রতিযোগিতা চলত না যারা তথাকথিত শিক্ষিত সুশীল সভ্য সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন তাঁদের মধ্যে। প্রতিযোগিতা কী নিয়ে? এঁদের প্রত্যেকে কে কার থেকে বেশি একটি ষাটোর্ধ্ব মহিলাকে গালি দিতে পারবে তা নিয়ে।

আরও পড়ুন-প্রতিমা তৈরির সরঞ্জামে কোপ, জিএসটি কাড়ছে পেটের ভাত

ঘটনার সূত্রপাত খুব সামান্য। সম্প্রতি ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে আমাদের দুর্গাপুজো। দুর্গাপুজোর ব্যাপ্তি ও বাঙালি জীবনে তার প্রভাব অত্যন্ত আনন্দময়। চারদিনের এই পুজোয় বাংলার ঘরে ঘরে খুশির জোয়ার বয়ে আনে। সামাজিক একাত্মতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে ফি-বছরের এই প্রাণের উৎসব।
দুর্গাপুজোর সার্বিক চিত্রকে সামনে রেখে জনৈক অধ্যাপিকা তপতী গুহঠাকুরতা দুর্গাপুজোর উপর তৈরি একটি তথ্য-সংবলিত গবেষণাপত্র জমা করেন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায়। এটার জন্য যা যা প্রসেস রাজ্য সরকারের তরফে করা দরকার তার সবটাই সরকার করেছে। ইউনেস্কো টিমও দুর্গাপুজোয় তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ওদের যা যা করণীয় সেটাও করেছে। এ-সবই চলছে অনেকদিন ধরেই। মুখ্যমন্ত্রী দপ্তরে কাজ করার সুবাদে এগুলো আমি দেখেছি। অবশেষে গত ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি হিসেবে দুর্গাপুজো জায়গা করে নেয় ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকায়। বাংলার মুকুটে আর-একটি উজ্জ্বল পালক যোগ হয়।

আরও পড়ুন-প্যারা ব্যাডমিন্টনে রাজ্যে সেরা পার্থ

এই স্বীকৃতি আসার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসন্ন দুর্গাপুজো নিয়ে কিছু কর্মসূচি পালন করার কথা ঘোষণা করেন। আর অমনি চিরকালীন স্বভাবে ওঁর বিরোধী রাম-বাম আর মিডিয়ার মিলিত হরিনাম সংকীর্তন শুরু হয়ে যায়। সমস্যা কী? না মুখ্যমন্ত্রী নাকি কৃতিত্ব চুরি করছেন দুর্গাপুজোর হেরিটেজ স্বীকৃতি নিয়ে। আর বঞ্চিত করছেন তপতীদেবীকে।
এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কিছুদিন আগে কান পাতা দায় হয়ে গেছিল। অবশেষে পয়লা সেপ্টেম্বর রেড রোডে মুখ্যমন্ত্রী ইউনেস্কোর কিছু প্রতিনিধি ও তপতীদেবীকে পাশে নিয়ে দুর্গাপুজোর ঠিক একমাস আগে র‍্যা-লি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুজোর সুর বেঁধে দিলেন। কিছু অতি-পক্ব মানুষের অতি-জল্পনা মাঠে মারা গেল তো গেলই সঙ্গে মুখও পুড়ল যখন তপতীদেবী নিজেই সংবাদমাধ্যমগুলিতে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী স্বীকৃতি চুরি করেছেন এটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা।

আরও পড়ুন-বিজেপির বাংলা ভাগের চক্রান্ত রুখতে ঢল তৃণমূলের মিছিলে

আমি জানি ঝগড়া লাগিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলি এতে মোটেই খুশি হননি। এঁরা সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তপতী এই অনুষ্ঠানে না এলে। আসলে বাংলার রাজনীতির এই অদ্ভুত চরিত্র দেখে আমি যারপরনাই অবাক হচ্ছি ইদানীং। যা ডিজিটাল জমানায় তা আরও অদ্ভুত হয়েছে। এখানে এগারো সালের পর থেকে সবসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব কাজে কোমর বেঁধে খুঁত ধরার খেলা চলে। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি এঁদের সাধারণ বোধ কোথায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে বিশ্বের মানচিত্রে এমন একটি স্বীকৃতিকে শুধুমাত্র পঙ্কিল করে তুলছে একটি মহিলার উপর তীব্র প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে। এঁদের ধিক্কার জানানোর ভাষা সত্যিই আমার জানা নেই।

আরও পড়ুন-ঘুমিয়েই ৬ লাখ টাকা জিতে নিলেন শ্রীরামপুরের তরুণী

আনন্দের পাশাপাশি দুর্গাপুজো একটা বিরাট অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টা। মৃৎশিল্পী, মণ্ডপশিল্পী, আলোকশিল্পী, লোকশিল্পী, পুরোহিত, বাদ্যকর-সহ রাজ্যের বহু মানুষের উপার্জনের একটা বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে এই পুজো। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যাপারটার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি খুশি কারণ ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি বাংলার পুজোকেন্দ্রিক অর্থনীতির পালে সুবাতাস লাগাবে। পুজোয় পর্যটকেরা আরও বেশি ভিড় করবেন। তাতে রাজ্যেরই লাভ। বহু অর্থনীতিবিদও এখন এ-কথাটা বলছেন। আর এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে মুখ্যমন্ত্রী সবকিছুকে দেখেন বাংলার মানুষের পক্ষে কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ তার নিরিখে।

আরও পড়ুন-ভাঙন প্রতিরোধের কাজ শুরু করেছে প্রশাসন, সঙ্গে পুনর্বাসন, ফের ভয়াবহ ভাঙন সামশেরগঞ্জে

এখানেই আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর অনন্যতা। আমি শুনেছি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বাংলার রূপকার ছিলেন। তাঁর মতো ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু তাঁর পর রাজ্যের আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীই বাংলার মানুষের স্বার্থ ও উন্নয়ন নিয়ে এতটা ভাবেননি। যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। এটা যে-কোনও গবেষক, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ রাজ্যের অতীত বর্তমান প্রাপ্তির খাতা খুললেই দেখতে পাবেন। তাই বিধান রায়ের হাত দিয়ে বাংলা যে সাজে সাজতে শুরু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব নিয়ে বাংলাকে আবার একটা নবসাজে সজ্জিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। সফলও বটে। এটাতেই ওঁর বিরোধীদের জ্বালা ধরে গেছে বুকে।

আরও পড়ুন-পাঠ ছেড়ে শিক্ষকদিবসে প্রতিমা গড়া

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যবোধ নিয়ে যাঁদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল তাঁরা বোধহয় পরিবর্তনের ওই সময়গুলো চাক্ষুষ করেননি। চৌত্রিশ বছরের অত্যাচারের মুক্তি পাওয়ার বাঁধভাঙা আনন্দে উদ্বেল জনতাকে ওই ছোট্ট মহিলাটি একা হাতে সামাল দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটতেই পারত বদল নয় বদলা। কিন্তু না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক সৌজন্য মুড়ি-মিছরির সমান নয়। এটা বিরোধীদের মস্তিষ্কে কোনওদিনই ঢুকবে না। কারণ বাংলায় বর্তমান সময়ে বিরোধী রাজনীতি হচ্ছে না। হচ্ছে ব্যক্তি মমতার নামে কুৎসার চাষ। এই করেই নাকি পরিবর্তনের পরিবর্তন হবে।

আরও পড়ুন-মাদ্রাসা নির্বাচনে জয়ী হল তৃণমূল

যাক গে যাক— এঁদের ধর্মের বাণী শুনিয়ে লাভ নেই। এঁরা রাজনৈতিক বিচক্ষণশীলতা হারিয়ে মানসিক পঙ্গুত্বের দিকে যাত্রা করেছেন। তাই ওঁদের কথায় কী এসে যায়। আসলে দিদির আর নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই। রাজনীতির এবিসিডি গুলে খেয়ে তিনি এখন বিরোধীদের তুর্কিনাচন দেখতে থাকেন। বোধহয় মনে মনে হাসেনও এঁদের নির্বুদ্ধিতায়।
যাই হোক, আজ শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানেও মুখ্যমন্ত্রী সৌজন্যের সঙ্গে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বলেছেন দিকে দিকে। কারণ সমাজের প্রতি অন্তরের উদারতা থেকে শিক্ষাই তো জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মুখ্যমন্ত্রীর গোটা জীবনকেই সেই শিক্ষার অনন্য উদাহণস্বরূপ দেখি।

আরও পড়ুন-প্রথম এগারো ঠিক করুন : শোয়েব

আমার মুখ্যমন্ত্রী তাই আমার গর্বের। অহংকারের। ওঁর গোটা জীবনটাই এক হার না-মানা জেদের একলা সংগ্রামের শিক্ষা। আমি জানি একদিন উনি বাংলা তথা দেশের ইতিহাসের স্মরণিকায় রাজনৈতিক সৌজন্যের শিক্ষকরূপে অর্জন করবেন অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি। এ আমার বিশ্বাস।

Latest article