তুষার সরদার: অনেকটা সময় হাতে থাকতে থাকতেই খোঁজখবর নিয়ে দেখেছিল তারক। এই বছরের শুদ্ধ, বিশুদ্ধ ইত্যাদি সব রকমের পঞ্জিকামতে এবারে দেবী দুর্গার নাকি দোলায় আগমন, ফল— মড়ক! পঞ্জিকাতে লেখা থাকলেও মড়কের ভয়টা অবশ্য তেমন লাগেনি। নানারকমের ওষুধ আর চিকিৎসার কল্যাণে এখন তো কোনও রোগই আর সেই আগের মতো মহামারী বা মড়কের আকার নিতে পারে না।
কিন্তু মড়কের ভয় না লাগলেও অন্যরকমের দুঃশ্চিন্তা তার হয়েছিল বইকী। মড়ক হবার কথাটা যদি না-ও ধরা যায় তবুও এসব তো অমঙ্গলের লক্ষণ— কোনও না কোনওরকম বিপদের পূর্বাভাস। আসন্ন দুর্গাপুজোর মূর্তিগড়ার জন্য তার কাছে এই বছরে ঠিকমতো বায়না আসবে কি না এবার কে জানে!
আরও পড়ুন-ফের ২৩৮ চাকরি দেউচায় চক্রান্তের অভিযোগ মন্ত্রীর
শেষ পর্যন্ত অবশ্য তার আশঙ্কা অনেকখানিই অমূলক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। দুর্গা-প্রতিমা গড়ার মোটামুটি বায়না পেয়েছিল সে। কিন্তু বিপদ এসেছিল অপ্রত্যাশিত দিক দিয়ে, না-ছোড় বিলম্বিত বর্ষার আকারে। মেঘ-কলঙ্কিত বিষণ্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় চিন্তিত হয়েছিল তারক।
নামকরা মৃৎশিল্পী নয় সে। তবে বিখ্যাত মৃৎশিল্পীর দীর্ঘদিনের দক্ষ সহকারী হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সহকারীর কাজ ছেড়ে এই বছর থেকে সে নিজের বাড়িতে স্বাধীনভাবে মূর্তি তৈরি করা শুরু করেছে। মৃৎশিল্পী হিসেবে একটা পরিচয় থাকায় কিছু ঘরোয়া বা ছোট পুজোর প্রতিমা গড়ার বায়না পেয়েছিল তারক।
কিন্তু এই বর্ষা, এই অসময়ের ঘ্যানঘেনে বর্ষার উপদ্রবের ফলে ঠিক সময়ের মধ্যে প্রতিমা তৈরি করা শেষ করে ফেলতে পারাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছিল। এর ভাবী ফলাফল হিসেবে আগামী বছর তার কাছে দুর্গা-প্রতিমার বায়না আসার সম্ভাবনা কমে যাবে। আর দুর্গা-প্রতিমার বায়না কমলে, অন্য পুজোর মূর্তিগুলোর বায়নাও কমে যাবে!
আরও পড়ুন-সোমবার আবহাওয়া বদল মঙ্গলেই সুন্দরবনে হামলা!
তবু দমে গেল না তারক। পাশের গ্রাম থেকে ডেকে আনল মূর্তিগড়ার ঠিকা কাজের সহকারী অনিলকে। তার পনেরো বছরের ছেলে অতনু, অতনুর মা নিরূপা, আর সে নিজে, এই চারজনে মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল সময়মতো কাজ তোলার।
কাঠের আগুন আর দুটো ব্লোয়ার স্টোভের সাহায্য নিয়ে দিন-রাত ভুলে তারা কাজ করে গিয়েছিল। শেষের দিকে বর্ষাও সদয় হয়ে বিদায় নিয়েছিল। অর্ডার মাফিক সব ঠাকুরই ঠিকমতো দেওয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া শেষের দিকে হঠাৎ-আসা একটা ছোট একচালা ঘরোয়া প্রতিমার অর্ডারও সামাল দেওয়া গেছে।
প্রতিমা তৈরির কাজের সুবিধার জন্য তারক তার বসত বাড়ির লাগোয়া জায়গায় টিনের উঁচু শেড দেওয়া তিনদিক বন্ধ একটা ঘর বানিয়েছিল। বায়না অনুযায়ী সবগুলো ডেলিভারি হয়ে যাবার পর সেই ঘরটায় এখনও লক্ষ্মী-সরস্বতী আর কার্তিকের বেশ কয়েকটা রং না-চাপানো মূর্তি রয়ে গেছে। তা ছাড়া মাথা না লাগানো দুটো গণেশ মূর্তিও পড়ে আছে।
আরও পড়ুন-ঘোমটার আড়ালে কেন সিপিএম! গোয়েবেলসীয় কায়দায় সেই মিথ্যাচার
পঞ্চমীর রাতের দিকে নিশ্চিন্ত সুখে খাওয়াদাওয়া করার সময় কথাটা প্রথম তুলল অতনু। এ-বছর বাড়িতে প্রতিমা তৈরির ব্যাপারটাতে সে খুব উৎসাহ আর আগ্রহ নিয়ে বাবাকে সঙ্গ দিয়েছিল।
—‘আচ্ছা বাবা, লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক মিলিয়ে আটখানা তো বাড়তি পড়ে থাকল, তার সঙ্গে আবার গণেশও দুটো আছে। এগুলো তৈরি করতে অনেক টাকার খড়-কাঠ-দড়ি-কাদা— মজুরি এসব লেগে গেছিল। সব নষ্ট হবে তো বাবা? সামনের বছর পর্যন্ত এগুলো কিন্তু কিছুতেই ঠিক থাকবে না। সবগুলোই নষ্ট হয়ে যাবে।
—‘নষ্ট হবে কেন? নষ্ট হবে না। সামনেই তো লক্ষ্মীপুজো আসছে। তারপর কালীপুজো, কার্তিকপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো পর পর পড়বে। তারপরে সরস্বতীপুজো তো আছেই। বরং আরও কিছু মূর্তি বানাতে হবে।
কচি অপরিণত মাথার অতনু হাসে এবার। নিশ্চিন্ত হয় কিছুটা। যাক তাহলে ওগুলো নষ্ট হবে না। কিন্তু পরিণত মাথার নিরূপা হাসে না নিশ্চিন্তও হয় না। চিন্তিত গলায় বলে—
—‘যত সরস্বতী আর লক্ষ্মীর মূর্তি আছে ততগুলো অর্ডার যদি না আসে তখন কী হবে? কার্তিকগুলোই বা কী হবে। আর গণেশদুটো তো ডাহা নষ্ট হবে। আগ বাড়িয়ে এতগুলো না করলেই কিন্তু ভাল হত।
আরও পড়ুন-যখন তিনি ডাকাত কালী
তারক একটু তাড়াতাড়ি খায়। খাওয়া শেষ হবার পর অভ্যাস বা সংস্কারবশত ভাতের এঁটো থালায় গ্লাস থেকে খানিকটা জল ঢেলে দিয়ে উঠে পড়ে তারক। জলের মগটা তুলে নিয়ে বারান্দার ওধারে গিয়ে মুখ ধোয়। তারপর গামছায় মুখ মুছতে মুছতে হেসে বলে—
—‘না গো, কোনওটাই নষ্ট হবে না দেখো। যতক্ষণ না মূর্তির গায়ে রঙ চাপছে ততক্ষণ সব মূর্তি বলতে গেলে প্রায় একরকম। লক্ষ্মীপুজোর সব বায়না সামাল দেবার পরও লক্ষ্মীর মূর্তি যদি বেশি থাকে তবে সেইগুলোর পেঁচা আর লক্ষ্মীর ভাঁড় সরিয়ে নিয়ে হাঁস আর বীণা লাগিয়ে দিলেই খাঁটি সরস্বতী!
—‘আর সরস্বতী তো এমনিতেই বাড়তি থেকে গেছে— সেগুলো? কার্তিকগুলো কোথায় লাগাবে? আর গণেশ? মাথা নাহয় লাগানো হয়নি এখনও, কিন্তু বড় ভুঁড়ির জন্য গণেশগুলো তো লাগাতেই পারবে না কোথাও।
আরও পড়ুন-১০ দুষ্কৃতী মিলে গণধর্ষণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে
—‘হা হা হা’ হেসে ওঠে তারক— ‘ভেব না, ভেব না সব লেগে যাবে। সরস্বতীপুজো পেরিয়ে যাবার পর যদি মূর্তি বাড়তি থেকে যায় তা হলে সরস্বতীর বীণা আর হাঁস সরিয়ে নেব। কয়েকখানা সাপ তৈরি করে সেখানে লাগিয়ে দিলেই মা-মনসা বলে মনসা-ভক্তরা মানত চোকাতে নিয়ে যাবে। আবার সাপটাপ না দিয়ে পেছনে একটা গাধা তৈরি করে দিলে সেটাতেই সাড়ম্বরে মা-শীতলার পুজো করা হবে। শীতকালের পুরো সময়টাতে এইসব ছলন-মূর্তির খুব চাহিদা। কার্তিক বাড়তি হলে কার্তিকের পেছন থেকে ময়ূর সরিয়ে দাও। শুধু একটা ময়ুর-পাখা লাগাও মাথায়। গায়ের রঙটা করতে হবে চাহিদামতো কালো বা নীল। তির ধনুকের বদলে হাতে বাঁশি দিয়ে দিলে হয়ে যাবে কৃষ্ণঠাকুর! বাঁশি না দিয়ে আরও দুটো হাত লাগিয়ে চারহাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম দিয়ে দিলেই নারায়ণ বা বিষ্ণুমূর্তি! আবার কার্তিকের ময়ূরটা সরিয়ে গালে দাড়ি লাগিয়ে দিলেই তো একেবারে নিখুঁত গাজিবাবা! ভিতরে ভিতরে সবই তো সেই এক। সেই একই খড়-দড়ি-বাঁশ-কাঠ-কাদার মূর্তি। বাইরেটাই শুধু আলাদা রঙ, আলাদা রকম।’
আরও পড়ুন-শারদ সাহিত্যের আলোকিত অক্ষরমালা
পরিবেশন সেরে নিরূপা এতক্ষণে খেতে বসেছে। অতনুর খাওয়া হয়ে গেছিল। উঠে পড়ে সে। মুখ ধোয়ার জলের মগটা হাতে তুলে নিতে নিতে সে বলে—
—‘কিন্তু বাবা, মা যে কথাটা বলছিল— ওই দুটো গণেশ নিয়ে কী করা হবে? ওদের তো আবার ভুঁড়ি করা হয়েছিল।’
—‘কেন রে? ভেবে দেখ, গণেশের মাথা যখন এখনও লাগানোই হয়নি তখন গণেশের দুটো হাত বাদ দিয়ে যে কোনও দেবতার মাথা লাগিয়ে মাথায় জটা বানিয়ে দিলেই দিব্যি শিবঠাকুর করা যাবে। কালীমূর্তির সঙ্গে শিবের মূর্তি তো লাগেই। না হলে মানতের শিবমূর্তি হিসেবে লেগে যাবে। অবশ্য চতুর্ভুজ শিবমূর্তিও হয়। সেক্ষেত্রে আর দুটো হাত বাদ দেবারও দরকার হবে না। যে কোনও মূর্তির শুধু বাইরের দিকটাতে কিছু অদল-বদল করে নিলেই পুরো মূর্তিটাই একদম বদলে যাবে।’
আরও পড়ুন-ঋষিকে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ বরিসের
খেতে খেতে নিরূপাও এবার মুখ তুলে তারকের দিকে হাসিচোখে তাকায়। অতনুও মায়ের দেখাদেখি হাসে। তারক আগের কথার রেশ টেনে বলতে থাকে,
—‘এই ধরো জল গ্লাসে আছে। জল এখন ঠিক গ্লাসের মতোই লম্বাটে! ওই থালায় ঢেলেছি, দ্যাখো সেই জল কিন্তু এবার থালার মতোই চ্যাপটা! হা হা হা, দেখতে আলাদা হলে কী হবে আসলে কিন্তু সবই এক— জল! সেইরকম যে কোনও মূর্তির বাইরেটাই পাবলিকের ইচ্ছামতো সুবিধেমতো চাহিদামতো নানারকম করে দেওয়া হয়। আসলে কিন্তু একই জিনিস দিয়ে একই পদ্ধতিতে তৈরি নানা ঢংয়ের মূর্তিকে বিভিন্ন লোকে বিভিন্নভাবে ভজনা করে— পুজো করে। অথচ মজার কথা এই যে তারা নিজেদের কেউ শৈব, কেউ শাক্ত, কেউ বা বৈষ্ণব বলে জাহির করে। শুধু কী তাই! এই সব ব্যাপার নিয়ে আবার কতরকমের ভেদাভেদ করতেও ভোলে না। সুযোগ পেলে সে-সব নিয়ে দস্তুরমতো কলহ এমন কী তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করতেও ছাড়ে না! হা হা হা…!’