যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করা যায় না। সারাজীবন চেষ্টা করলেও কেউ তা পেরে উঠবে না।
যাঁর নিজের উপরেই কোনও বিশ্বাস নেই, তিনি ভগবানকে কী করে বিশ্বাস করবেন!
ঈশ্বর একজনই, আর তাঁর নাম সত্য। তিনিই জগতের সৃষ্টিকর্তা। তিনি কাউকে ভয় পান না। কাউকে ঘৃণা করেন না। তিনি জাগতিক জন্ম-মৃত্যুশর ঊর্ধ্বে। তিনি স্বীয় দীপ্তিতে আলোকিত হন। একমাত্র প্রকৃত গুরুই তাঁর সন্ধান দিতে পারেন। এই ঈশ্বর সৃষ্টির শুরুতেও প্রাসঙ্গিক ছিলেন, আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং আগামী দিনেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমবে না।
আপনাকে যদি কেউ সত্যিই ভালবাসে তা হলে জানবেন আপনি ঈশ্বর পেয়ে গেছেন।
পৃথিবী আসলে একটি নাট্যমঞ্চ, আর আমরা সকলে স্বপ্নের মধ্যে এখানে অভিনয় করে চলেছি।
মাংস খাওয়া উচিত নাকি সবজি— এসব নিয়ে মূর্খেরা তর্ক করে। কোনটি মাংস আর কোনটি সবজি সেটি কে ঠিক করে দিয়েছে? আর কোনটি খেলে পাপ হবে সেটাই বা আসলে কে জানে!
আরও পড়ুন-আধুনিক পরিকাঠামোর মোড়কে সেজে উঠছে পেটুয়াঘাট, গভীরতম মৎস্যবন্দরে গতি আনছে রাজ্য
যদি প্রকৃত মৃত্যুর অর্থ কেউ জানতে পারে তা হলে সে মৃত্যুকে আর ভয় পাবে না।
যে-সব মানুষকে একই মনে করে সে-ই প্রকৃত ঈশ্বরবিশ্বাসী।
ঈশ্বর তোমাকে যে ধনসম্পত্তি দিয়েছেন তা যদি তুমি শুধু নিজের বলেই আগলে রাখো তা হলে তা পূতিগন্ধময়। কিন্তু যদি তা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নাও তা হলে তা পবিত্র প্রসাদের চেয়েও বেশি পুণ্যি বলে ধরা হবে।
তোমার কথা শুনে অন্যেরা যেন তোমাকে সম্মান করতে পারে এমন কথাই সবসময় বোলো।
উপরিউক্ত এই সেই দশ প্রসিদ্ধ বাণী যা যুগে যুগে মানুষকে বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি জোগায়।
শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক ছিলেন অসাধারণ এক সত্তা যিনি মানুষের কাছে
‘ইক ওঙ্কার’ অর্থাৎ এক ঈশ্বর-এর বার্তা প্রচার করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে স্রষ্টা তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেরই বসবাস করেন। আধ্যাবত্মিক যুক্তি ও অভ্যযন্তরীণ শান্তির জীবনযাপনের মূলমন্ত্র মানবজাতিকে শিখিয়ে গেছেন যে সমস্ত মহামহিম, তাঁদের অন্যতম গুরু নানক।
নানক ছিলেন দশজন শিখগুরুদের মধ্যে প্রথম। ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল, বর্তমান পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের লাহোরের কাছে অবস্থিত নানকানা সাহিব-এ এক হিন্দু পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যদিও গ্রামের নাম ছিল রাজ ভর দি তালবন্দি। পরবর্তীকালে নানকের নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয় নানখানা সাহিব। সেখানে একটি বৃহৎ উপাসনালয় রয়েছে বর্তমানে, যার নাম গুরুদ্বার জনম আস্থান। গুরুনানককে আর একটি প্রিয় নামে ডাকেন তাঁর ভক্তবৃন্দ, তা হল বাবানানক।
আরও পড়ুন-শিখ ধর্মের অভ্যুত্থান এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
তাঁর জন্মতিথিটি সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘গুরুপরব’ নামে। গুরুনানকের জন্মদিন গুরুনানক জয়ন্তী হিসেবেও উদযাপিত হয়।
এই দিনটি উদযাপিত হয় হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে কার্তিক পূর্ণিমায় অর্থাৎ কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে। সাধারণভাবে এই তারিখটি পড়ে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। যেমন এই বছর অর্থাৎ ১৯২২ সালে গুরুনানক দিবস বা জয়ন্তী পালিত হবে ৮ নভেম্বর।
তিনদিনব্যাপী এই উৎসবের সূচনা হয় শিখদের পবিত্র গুরুগ্রন্থসাহিব পাঠের মাধ্যমে। বিরামহীনভাবে টানা ৪৮ ঘণ্টা এই গ্রন্থসাহিব পাঠ করা হয়, একে বলা হয় অখণ্ডপাঠ। গুরুনানক জয়ন্তীর আগের দিনে এই পাঠ সমাপ্ত করা হয়।
তারপর আয়োজিত হয় পবিত্র প্রভাতফেরি। এই প্রভাতফেরি গুরুদুয়ারা থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন লোকালয়ের দিকে যায়। মিছিলের আগে পাঁচজন সশস্ত্র রক্ষী নিশান সাহিব পতাকা বহন করে নিয়ে চলে যার মধ্যে থাকে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত গুরুগ্রন্থসাহিব। পবিত্র মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ধর্মীয় গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেন। দুপুরে গুরুদুয়ারায় উপস্থিত সকলকে লঙ্গরখানার বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। অসংখ্য শিখ ধর্মাবলম্বী সেবা ও ভক্তি প্রদর্শনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজেদের নিয়োজিত করেন সেখানে।
আরও পড়ুন-আজ ফিরহাদের সভা ঘিরে প্রস্তুত জঙ্গিপুর
গুরুনানক তাঁর জীবনে বহু স্থানে ভ্রমণ করে তাঁর মতবাদ একেশ্বরবাদ প্রচার করেন। পরে যা প্রচলিত হয়। তিনি সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও সদাচরণের ওপর নির্ভর করে একটি অনন্য ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন করতে সক্ষম হন। শিখ ধর্মে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, পরবর্তী শিখ গুরুদের গুরুপদ লাভের সময় তাঁদের মধ্যে গুরুনানকের ঐশ্বরিক ক্ষমতা, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও পবিত্রতা প্রবাহিত হয়ে থাকে।
নানকের পিতার নাম ছিল মেহতা কলণন দাস বেদী, যিনি ছিলেন পাটোয়ারি এবং চাকরি করতেন গ্রামের মুসলিম জমিদার রায় বুল্লারের অধীনে। নানকের মায়ের নাম ছিল তৃপ্তাদেবী। নানক অল্প কিছু লেখাপড়া শিখে প্রথমে স্থানীয় জমিদারিতে কেরানির কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি সুলক্ষণী নামক এক স্থানীয় মহিলাকে বিবাহ করেন। তাঁর দুই পুত্রের নাম শ্রীচান্দ ও লক্ষ্মীচান্দ। একসময় স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন নানক। বহুদিন ভ্রমণের পর অবশেষে তিনি ঈশ্বরের স্বরূপ অনুধাবনে সক্ষম হন এবং ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। তিনি প্রচার করেন, ‘ঈশ্বর কেবল একজনই, তিনিই সত্যি, তিনিই স্রষ্টা, তাঁর ভয় নেই, তাঁর ঘৃণা নেই, তিনি কখনও বিলীন হন না, তিনি জন্ম-মৃত্যুচক্রের ঊর্ধ্বে, তিনি অজ-অমর স্বয়ংপ্রকাশ। সাধনার দ্বারা প্রকৃত গুরুর মাধ্যমেই শুধুমাত্র তাঁকে অনুধাবন করা যায়। তিনি আদিতে সত্য, কালের সূচনায় সত্য, তিনি চিরকালব্যানপী সত্য।’
আরও পড়ুন-আজ ফিরহাদের সভা ঘিরে প্রস্তুত জঙ্গিপুর
গুরুনানক নানা দেশে ঘুরে ঘুরে তাঁর বাণী প্রচারের জন্য ‘রাবাব’ (এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র) বাদক মুসলিম বন্ধু মারদানাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল তো বটেই, ভারতের বাইরেও আরবের মক্কা, মদিনা, বাগদাদ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি স্থানে স্থানীয় ভাষায় রাবাব বাদনের ছন্দে তাঁর বাণী তথা ধর্মপ্রচার করেছেন।
তিনি তাঁর সময়ে লঙ্গরের প্রচলন করেছিলেন। সেখানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ পাশাপাশি বসে আহার করতে পারেন। এই লঙ্গরকে বলা হয় ‘গুরু কা লঙ্গর’। বিভিন্ন মানুষের দানে চলে এই লঙ্গর। আর যাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমে এই লঙ্গরগুলি পরিচালিত হয় তাঁদের বলা হয় ‘সেবাদার’।
আরও পড়ুন-হাইকোর্টে খারিজ শুভেন্দুর আর্জি
শুধু ধর্মপ্রচারই নয়, গুরুনানক নানা সামাজিক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন এবং কাজে নেতৃত্ব দিতেন। যেমন, জলের অভাব ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্যক কূপ খনন ও জলাশয়ের স্থায়ী ব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রামবাসীদের সুবিধার্থে পাঠশালা স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। নারীদের উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর উদার ভূমিকা আজও শিক্ষণীয়। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এক প্রকাণ্ড জলাশয়ের ধারে তৈরি করবেন একটি অপূর্ব মন্দির। জলাশয়টির নাম তিনি রাখেন ‘অমৃতসায়র’। কিন্তু মন্দির গড়ার স্বপ্ন তাঁর বাস্তবায়িত হয়নি। অমৃতসায়রের নাম থেকেই আজকের প্রসিদ্ধ শহর অমৃতসর, যেখানে রয়েছে বিশ্বখ্যািত স্বর্ণমন্দির। ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে শিখগুরু অর্জুন সিং অমৃতসায়রের ধারে স্বর্ণমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
আরও পড়ুন-স্টলদুর্নীতি মামলায় পুলিশি হেফাজতে অধিকারী-ঘনিষ্ঠ
মোগল সম্রাট বাবর গুরুনানক ও তাঁর বন্ধু মারদানাকে কারাবন্দি করেন। পরে নানক সম্পর্কে সব জানার পর সসম্মানে তাঁকে কারামুক্ত করেন। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর বর্তমান পঞ্জাবের করতারপুর নামক স্থানে নানক নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কথিত আছে, একদিন নানক বাইন নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর তিন দিন পরে নানক সবার সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘আমি ঈশ্বরের দেখা পেয়েছি, তিনি আমাকে তাঁর প্রেরিত গুরু হিসেবে উল্লেখ করেছেন’।
নিজেদের পবিত্র কর্তব্যর পালনের প্রভায় যাঁরা যুগে যুগে সারা বিশ্বকে আলোকিত করেছেন তাঁদের অন্যেতম গুরুনানক। এই অসামান্য জ্যোতির্ময় পুরুষ চিরাচরিত প্রথা ও রীতিনীতির বাইরে গিয়ে নতুন এক ভাবধারায় প্রাণিত করতে চেয়েছেন বিশ্ববাসীকে। গুরুনানকের অসাধারণ সংযম ও অতুলনীয় সহনশীলতা আজও পথ দেখাচ্ছে মানবসভ্যতাকে।
শিখ ধর্মে আধ্যাত্মিক ভ্রমণকে বলা হয় ‘উদাসিস’। ১৫০০ থেকে ১৫২৪ সালের মধ্যে প্রায় ২৮০০০ কিলোমিটার আধ্যাত্মিক-ভ্রমণ করেন গুরুনানক।
আরও পড়ুন-প্রিয় মাঠ অ্যাডিলেড, পছন্দের খাবার গাজরের হালুয়া, জন্মদিনে সোজাসুজি বিরাট
তিনি বলতেন, ‘একসাথে থাকো, সবাইকে সাহায্য করো, কাউকে শোষণ ও প্রতারণা কোরো না, সৎ চিন্তা করো, সৎ জীবন যাপন করো, পবিত্র হও। ঈশ্বরের নামগান করো, জপ করো, ধ্যান করো। ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করো। মনে রেখো সব কিছুই হয় তাঁর অর্থাৎ ঈশ্বরের মর্জিতে, মনে রেখো ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।’