‘তাঁর লেখক জীবনে রয়েছে অনেক ভাঁজ। তাঁর লেখনীর ধারাও বহুমাত্রিক। গ্রামজীবনের প্রান্তিক অবহেলিত মানুষের কথা নিখুঁতভাবে বর্ণনা রয়েছে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে। অথচ লেখক সারা জীবন উপেক্ষিত ও বঞ্চিতই থেকেছেন। শত চেষ্টাতেও সংসারের নাছোড় দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পান না৷’ কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের এক সভায় মন্তব্য করেছিলেন বিশিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। অসুস্থ লেখকের চিকিৎসার জন্য ওই অনুষ্ঠানে একটি শিল্পগোষ্ঠীর তরফে আর্থিক সাহায্যের এক লক্ষ টাকার চেক তাঁর হাতে তুলে দেন কবি নীরেন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন-জনসমুদ্রে অবরুদ্ধ রামনগর, বিরোধী দলনেতাকে চ্যালেঞ্জ বীরবাহার
লক্ষ টাকার চেক হাতে পেয়ে নীরব লেখক আবছা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন উপস্থিত দর্শকদের দিকে। জীবন-অস্তাচলের দিকে পা বাড়িয়েছেন তিনি। দেখা দিয়েছে মস্তিষ্কবৈকল্য। স্মৃতি ধরে রাখতে পারছে না অতীত দিনের স্বর্ণ-সময়ের কোনও কথা। ফলে, জীবনসায়াহ্নের এমন এক সভায় কবির অমূল্য কথাগুলো মূল্যহীন তাঁর কাছে। সেটা ছিল ২০০৭ সাল। কথাসাহিত্যিক আবদুল জব্বারের সাহিত্য-জীবনের সেটাই ছিল শেষ সম্মাননা সভা। অর্থদানের আয়োজক সংস্থা ছিল ‘নতুন গতি’।
সাহিত্যিকের অসুস্থতার খবরটি তখন সামনে এনেছিলাম। সেই সংবাদের সূত্র ধরে খোঁজ নেন সমাজেসেবী সংস্থা বিশ্বকোষ পরিষদের কর্ণধার পার্থ সেনগুপ্ত। জব্বার সাহেবের সাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক ছিলেন পার্থবাবু। তিনিই প্রথম সাহিত্যিকের চিকিৎসার জন্য অর্থদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখকের বাড়ি যাবার জন্য সেদিন পার্থবাবুর সফরসঙ্গী আমি। লেখকের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার নোদাখালি গ্রাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন লেখকের আরও এক স্নেহভাজন কবি তথা নতুন গতির সম্পাদক এমদাদুল হক নূর।
আরও পড়ুন-ছুটি বাতিল, রাত জেগে আবাস যোজনার কাজ
আমাদের আগমনের বার্তা ছিল লেখকপুত্র গৌতম শাহেদির কাছে। দুপুরের রোদমাখা নিকানো দাওয়ায় খেজুরপাতার চওড়া চাটাইয়ে বসেছিলেন ‘বাংলার চালচিত্র’র জনক। সেদিন অসুস্থ লেখকের চিকিৎসার জন্য পার্থবাবু বিশ্বকোষের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদানের চেক তুলে দেন।
লেখকের প্রতিভাকে প্রথম চিহ্নিত করেন বাংলা সাহিত্যের প্রভাবশালী প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ। তখন উনি কৈশোর পেরিয়ে পা রেখেছেন যৌবনে। নবীন প্রতিভাকে এগিয়ে দিতেই কাজী সাহেব তরুণ লেখককে তাঁর সেক্রেটারি করে নেন। পরে ওদুদ সাহেব নিজের অর্থ ব্যয় করে লেখকের প্রথম বই ছেপে দেন। শুধু তাই নয়, ওদুদ সাহেবের অনুরোধে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীর লেখকের জন্যও মাসিক আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে দেন। কবি, সাহিত্যিক ও ভারতীয় রাজনীতির বোদ্ধা ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন কবীর ছিলেন ওদুদ সাহেবের অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। বন্ধুর সেই অনুরোধ রাখতেই তরুণ জব্বারকে না জেনে, না চিনেই তার জন্য এই অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
আরও পড়ুন-গো ব্যাক? মন্ত্রী সুভাষের লাথি দলীয় কর্মীকেই!
লেখককে এরপর চিহ্নিত করেন হরফ প্রকাশনীর কর্ণধার আবদুল আজিজ আল আমান। হরফের জনপ্রিয় মাসিক ‘কাফেলা’তে নিয়মিত লিখতেন তিনি। আজিজ সাহেবের সম্পাদিত কাগজ ‘জাগরণ’ ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয় ‘ইলিশমারির চর’। সেটা ছিল ১৯৫৮ সাল। প্রথম প্রকাশেই উপন্যাসটি কালজয়ী উপন্যাসের মর্যাদা পেয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী তিন উপন্যাস হল— সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। কালজয়ী সাহিত্যের সম-সারিতে স্থান পেয়ে যায় আবদুল জব্বারের ‘ইলিশমারির চর’। মাত্র ২৪ বছর বয়সে লেখা উপন্যাস কালজয়ী হিসেবে চিহ্নিত। ‘ইলিশমারির চর’ চলচ্চিত্রায়িত করার জন্য অনেকবার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রূপ পায়নি। বছরখানেক আগে শেষ বার চলচ্চিত্রায়িত করার পরিকল্পনা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য প্রাক্তন বিধায়ক ডাঃ এম নুরুজ্জামান। সে ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আধুনিক বাংলা গানের নবরূপকার কবীর সুমন। সে কাজও মাঝপথে থমকে রয়েছে। চালচিত্রের পর লেখকের অনন্য সৃষ্টি ‘সোঁদা মাটি নোনা জল’ দীর্ঘদিন সম্প্রচারিত হয় দূরদর্শনের বিশেষ এক বিভাগে। দর্শক চিহ্নিত করেন বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী এক প্রতিনিধিকে।
আরও পড়ুন-কুচিপুড়ি নৃত্যে মাতিয়ে দিল ঋষি-কন্যা অনুষ্কা
ইলিশমারির চর পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন প্রবীণ ভাষাচার্য আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। লেখা পড়ে তরুণ সাহিত্যিকের প্রতিভাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। পরে লেখকের সঙ্গে সখ্য বাড়ে ভাষাচার্যের। তিনি দেখা করতে বলেন সাগরময় ঘোষের সঙ্গে। সাগরময়বাবু তখন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক। বলা বাহুল্য, প্রথম দেখায় সাগরময়বাবু ঠিক রত্নটিকে চিনেছিলেন। আবদুল জব্বারের মাটির গন্ধ মাখা লেখা পড়ে দেশ পত্রিকায় সেটি ধারাবাহিক ছাপতে শুরু করেন। ‘বাংলার চালচিত্র’ নামের ছোট ছোট সাহিত্য সৃষ্টিতে পিছিয়েপড়া প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা প্রকাশ পেল। সাতের দশকের সেই সময়ের পাঠকমহল নতুন স্বাদের লেখনীর সন্ধান পেলেন।
আরও পড়ুন-প্রয়াত অভিনেতা বিক্রম গোখেল
দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন থেকে হাওড়া, মেদিনীপুর ও হুগলি জেলার গ্রামীণ অঞ্চলের পিছিয়েপড়া মুসলিম সমাজের কথ্যভাষাকে তিনি সাহিত্যের আঙিনায় প্রথম এনে হাজির করলেন। বাংলা সাহিত্যে যে কাজটি আগে কেউ করেননি। বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে যা অমূল্য দলিল হয়ে আছে।
‘বাংলার জীবন ও জীবিকা’ গ্রন্থে রাজ্যের প্রায় সব ধরনের জীবিকার কথা বর্ণনা রয়েছে। এই লেখার সূত্রে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। লেখকের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও সৈয়দ মুজতবা আলির সঙ্গে। ওঁদের আগ্রহে রেডিওতে সাপ্তাহিক ‘মুখের মেলা’ অনুষ্ঠানের শুরু হয়। যদিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
আরও পড়ুন-ডিউকের গোলে জয়ী অস্ট্রেলিয়া
প্রতিভা কখনও চাপা থাকে না। আবদুল জব্বারও ঢাকা থাকলেন না। তাঁর প্রতিভার আলোকে আর হাতের আড়ালে রাখা গেল না। তাঁর সৃষ্টি-প্রতিভা আরশির সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি চিহ্নিত হলেন। তাঁর সাহিত্যসম্মাননার ঝুলিতে সংগ্রহ হল বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, শৈলজানন্দ পুরস্কার, তারাশঙ্কর পুরস্কার ও নতুন গতি পুরস্কার। এই সম্মান কথাসাহিত্যিককে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী পরিচিতি এনে দিল।
তাঁর সম্বলে ছিল এটুকুই। শত চেষ্টা করেও সংসার জীবনের নাছোড় দারিদ্র্যের চৌকাঠ তিনি পেরোতে পারেননি। মৌলবি বাবা ছিলেন সাত গ্রামের পরিচিত সম্মাননীয় মুখ। সংসারে গরিবি হঠাতে সেই ব্যক্তিই একদিন ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে নিয়ে শূন্য হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিবেশীর উঠোনে। এক মুষ্টি চাল দাও গো মা… সেদিন প্রতিবেশীর বাঁকা দৃষ্টি দেখেছেন তিনি। গ্রামবাসীর কটাক্ষে সে রাতেই তিনি নিজের গলায় দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিতে ভুল করেননি। সেকথা সাহিত্যিক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। বলেছেন, ভিক্ষাবৃত্তির সেই দিনটাতে সারাদিন বাবার হাত ধরে পাড়ার রাস্তায়, গলিতে হেঁটে ঘুরেছিলাম। বাবার রেখে যাওয়া দারিদ্র্য-পাথরকে হাজার চেষ্টা করে আমিও ঠেলে সরাতে পারিনি। আজীবন দারিদ্র্যে ডুবুডুবু থেকেছে আমার ঘর-গেরস্থালি।
আরও পড়ুন-অভিষেকের সঙ্গে বৈঠকের পরেই পঞ্চায়েত প্রস্তুতি, শুক্রবারেই বীরভূমে প্রথম সভা
কথাসাহিত্যিকের বাড়ি সাতগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। যে কেন্দ্র থেকে জয়ী হতেন বাম জমানার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। নির্বাচন এলে প্রার্থী হিসেবে জ্যোতিবাবু এলাকায় যেতেন। লেখক দেখা করতেন। হুমায়ুন কবীরের স্নেহধন্য পরিচয় দিয়ে লেখকের জন্য রাজ্য সরকারের আর্থিক সাহায্যের আবেদন করতেন। প্রতিবার প্রতিশ্রুতি দিতেন জ্যোতিবাবু। তারপর যে কে সেই!
আরও পড়ুন-কুচিপুড়ি নৃত্যে মাতিয়ে দিল ঋষি-কন্যা অনুষ্কা
শেষবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। খুশি হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাইটার্সে। নিজে হাতে উপহার দিয়েছিলেন বাংলার চালচিত্র। লেখক মনে করেছিলেন এবার হয়তো দারিদ্র্যমুক্তি ঘটবে। মুখ্যমন্ত্রী সংস্কৃতি পরিবারের সন্তান। তা ছাড়া তাঁর লেখার উপজীব্য চরিত্রগুলো সকলেই পিছিয়েপড়া শ্রেণির। বঞ্চিত সেই মানুষের সমর্থন নিয়েই বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে। অতএব এবার লেখক যোগ্য সম্মান পাবেন। নিদেনপক্ষে সরকারের আর্থিক সহায়তা। কিন্তু না, দীর্ঘ বঞ্চনা ও দারিদ্র্য-দগ্ধ-দিন গুনতে গুনতে জীবনের লড়াই শেষ করে লেখক মাটির আশ্রয়ে চলে গেছেন ২০০৯ সালের ৩০ নভেম্বর। বাংলা সাহিত্যের জন্য রেখে গেছেন মাটির গন্ধমাখা মানুষের দগ্ধ-দলিল।