বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যর দেশ আমাদের এই ভারত। আমরা সবকিছুতে একে অপরের পরিপূরক। বিশেষ করে উৎসব এবং অনুষ্ঠানে এই দেশের বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন এমন অনেক উৎসব রয়েছে যেগুলির ঐতিহাসিক উৎস বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নরকম কিন্তু বেশ লক্ষণীয় যেটা, সেই উৎসবগুলোর উদযাপন বছরের কোনও একটা নির্দিষ্ট সময় একই দিনে হয়ে আসছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসবকে একই সময়ের আওতায় নিয়ে আসার মতো ঘটনা এই দেশেই সম্ভব যেখানে সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ মানুষ আপদে-বিপদে এক হয়ে মিলেমিশে থেকেছে। এটাই ভারত তথা ভারতীয়দের অনবদ্যতা।
আরও পড়ুন-রেকর্ড! ৫১ বছরে উষ্ণতম মকর সংক্রান্তি বাংলায়
হোলি, দিওয়ালি, নবরাত্রি, ভাইদুজ, দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে বিভিন্ন সর্বভারতীয় উৎসব এমন করেই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক হয়ে গেছে। এই সব মেগা উৎসবগুলোর তালিকায় একটা উৎসবের নাম করতেই হয় সেটা হল মকর সংক্রান্তি। প্রতিবছর ১৪ জানুয়ারি পালিত হয় মকর সংক্রান্তি। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এইদিন পৌষমাস শেষ হয়ে মাঘমাস শুরু হয়। এই দিনটি থেকেই নতুন ফসল রোপণের মরশুম শুরু হয়। তাই আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশে মকরসংক্রান্তি খুব উল্লেখযোগ্য।
মকর সংক্রান্তিতে সূর্যের উদ্দেশ্যে আরাধনা করা হয়। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনটি বিশেষ সৌরদিন হিসেবে চিহ্নিত। এইদিন থেকে সূর্যের উত্তরে যাত্রা শুরু। সেই কারণে মকর সংক্রান্তিকে অনেক স্থানে উত্তরায়ণ উৎসবও বলে। রাশিচক্রের বিচারে এই তিথিতে সূর্য মকররাশিতে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
মকরসংক্রান্তির মূলপ্রথাটি হল গঙ্গাস্নান এবং অন্নদান সেই সঙ্গে বিশেষ মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন পিঠে, পুলি, পায়েস তৈরি করা। অন্য রাজ্যগুলিতেও একই রকমভাবে কোথাও দইচূড়া, কোথাও খিচুড়ি আবার কোথাও গুড় বা তিলের মিষ্টি তৈরি করা হয়। বিভিন্ন রাজ্যে এর নানা নাম এবং নানা পালনি। বাংলায় পৌষসংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পাঞ্জাবে, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশে লোহরি, মাঘি, দিল্লিতে সিধা, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত, মধ্যপ্রদেশে সুকরাত, বিহার বা ঝাড়খণ্ডে খিচড়ি পরব। যদিও অনেক রাজ্যই মকর সংক্রান্তি নামটাও ব্যবহার করে। শুধু এদেশ নয়, দেশের বাইরে নেপালে এই সময় মাঘে সংক্রমণ পালিত হয়, তাইল্যান্ডে সোংক্রান, কম্বোডিয়ায় মোহা সোংক্রান ইত্যাদি। এই রাজ্যে মকর সংক্রান্তির দিন হাজার হাজার সাধুসন্ত পুণ্যার্থী একত্র হন গঙ্গাসাগর মেলায়। স্নান করে উঠে তিলদানের প্রথা রয়েছে এখানে। একই উৎসব নানা নামে, রীতিতে-নীতিতে।
আরও পড়ুন-ঘাঁটি গেড়েছেন আট মন্ত্রী, অরূপ ছুটছেন-সামলাচ্ছেন
পোঙ্গল
তামিলনাড়ুতে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে টানা চারদিন ধরে সূর্যদেবের আরাধনা করা হয়। যাকে বলে পোঙ্গল। প্রথম দিনটি ‘বগি পন্ডহি পোঙ্গল’। ওই রাত থেকেই নতুন করে ঘর সাজানো হয়। পরদিন ভোর থেকে শুরু পোঙ্গল, অর্থাৎ সূর্যপুজো। নতুন সিদ্ধ চাল দিয়ে বাড়ির উন্মুক্ত স্থানে ভাত রান্না করে তাতে গুড়-দই দিয়ে কলাপাতায় সাজিয়ে দেবতাকে অর্পণ করা হবে। সেটিই পুজোর প্রসাদ। ফসল কাটার পর ধানের শিষ ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদন করা হয়। সঙ্গে প্রার্থনা করা হয় যেন প্রতিবছর এভাবেই প্রতিবছর যাতে ফসল আরও ভাল হয়, সংসারে যাতে শ্রীবৃদ্ধি হয়।
ভোগালি বিহু
অসমে মকর সংক্রান্তির নাম ভোগালি বিহু। পৌষের শেষদিন শুরু হয়। ভোগালি অর্থাৎ ভোজনের উৎসব বলা হয়। চলে পরে তিনদিন পর্যন্ত। একে মাঘ বিহুও বলে। টেকলি ভোঙ্গা যাকে বলে হাঁড়ি ভাঙা, বাফেলো ফাইট ইত্যাদি খেলা হয়। এই বিহুর সময়ে অসমবাসীরা পিঠে, নাড়ু ইত্যাদি তৈরি করেন। তিল পিঠে মাঘ বিহুর প্রধান পিঠে। এ ছাড়া চুঙ্গা পিঠে, ঘিলা পিঠে, সুতুলি পিঠে, হেঁচা পিঠে, ডেকা পিঠে, ভুরভুরি পিঠে আরও কত যে পিঠে করেন অহমিয়ারা। এই সময় নতুন ধান ওঠে অসমেও।
আরও পড়ুন-কাল রাজ্য জুড়ে আইনজীবীদের কালাদিবস পালন
মকর চাউলা
ওড়িশার ট্রাডিশনাল মকরসংক্রান্তির জনপ্রিয় পদ হল মকর চাউলা। এটার নামেই উৎসবটারও এমন নাম হয়ে গেছে। যদিও মূল উৎসব মকর সংক্রান্তিই বলা হয়। এই পদ সংক্রান্তির দিন ওড়িশাবাসীর ঘরে ঘরে তৈরি হয়। মকর চাউলা হল মিষ্টি ভাত। এটি তৈরি হয় সদ্য খেত থেকে তোলা ধানের চাল, চিনি, গুড়, কলা এবং গোলমরিচ দিয়ে। সূর্যদেবতাকে প্রসাদ হিসেবে এটি অর্পণ করা হয়। ওড়িশার বিভিন্ন এলাকায় গঙ্গাস্নান এবং উপোসের রীতি রয়েছে। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলা হয়। কোনারকের সূর্যমন্দিরে ভক্তসমাগম হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরেও আলাদা করে বিশেষ মকর সংক্রান্তির রীতি পালিত হয়।
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন
উওরায়ণ
গুজরাতে মকর সংক্রান্তি ‘উত্তরায়ণ’ নামে পরিচিত। ঘুড়ি ওড়ানোই এই উৎসবের অন্যতম রীতি। ‘কাই পো ছে’ দিয়ে শুরু হয়। এ ছাড়া এদিন সূর্যদেবের আরাধনা করা হয়। প্রত্যেকেই ঘুড়িকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের মনের বার্তা পৌঁছে দেয়। তৈরি হয় তিল, বাদাম আর গুড়ের লাড্ডু। এই দিনটি ভারতের অন্যতম একটি ফসল কাটার দিন।
লোহরি
হরিয়ানা ও পঞ্জাবে মকর সংক্রান্তির আগের দিন লোহরি পালন করা হয়। পরের দিনটাই হল মাঘী। রাতে আগুন জ্বালিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা আগুনের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরে গান গাইতে থাকেন। সুখ ও সমৃদ্ধির কামনা করে আগুনের মধ্যে তিল, মুড়ি ও ভুট্টা অর্পণ করা হয়। ফসল কাটার শুভ উদযাপন এই উৎসব। লোহরি উপলক্ষে মহিলারা বিশেষ পোশাক পরে গান গেয়ে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে নাচ করেন। তিল আর গুড়ের মিষ্টি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন
খিচড়ি পরব
এই দিন গঙ্গায় ডুব দিয়ে সংক্রান্তি পালন শুরু করেন ঝাড়খণ্ডের মানুষ। বিহারে একে তিলসংক্রান্তিও বলে। চূড়া-দই খাবার রীতি রয়েছে যাকে দই-ভাত বলা যায় সঙ্গে থাকে গুড়। এইদিন তিলকূট তৈরি করেন গৃহবধূরা। দুপুরে থাকে খিচুড়ি-পরব। নতুন চাল ও নতুন সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করা হয়, সঙ্গে আলু চোখা, ঘি, আচার আর পাপড়।
মকর সংক্রমণ বা ইল্লু বিল্লা
কর্নাটকে খুবই ধুমধাম করে মকর সংক্রান্তি পালিত হয়। এইদিন গৃহস্থরা তাদের ঘরদোর পরিষ্কার করে। পুরনো জামাকাপড়, পরিত্যক্ত সামগ্রী আগুনে আহুতি দেয়, নতুন পোশাক পরে পুজো করে।
সুন্দর করে রঙ্গোলি আঁকে ঘরে। এইদিন ঘরে ঘরে তৈরি হয় তিলের লাড্ডু, চাল, গুড়, নারকেল, দুধ দিয়ে তৈরি চক্কারা পোঙ্গলি, তিল চিক্কি, টামারিন্ড পুলিয়োগারে (টামারিন্ড রাইস), আর সাবুদানা বড়া।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়ির দুই রাস্তা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল
তিলগুল বা মাঘী সংক্রান্তি
গোটা মারাঠি সংস্কৃতিতে এই উত্তরায়ণের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহারাষ্ট্রে মকর সংক্রান্তির আগের দিনটাকে বলা হয় ভোগী এবং এইদিন তৈরি হয় ভোগিচি ভাজি যা ইন্দ্রদেবের, প্রসাদ বলা হয়। যিনি সমৃদ্ধি এবং ভাল ফলনের দেবতা তাই তাঁর আরাধনা দিয়ে শুরু পরবটি। এইদিন তিলগুল বা তিলের লাড্ডু করেন তাঁরা। মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চলে এই দিন কালো পোশাক পরার রীতি রয়েছে। ঘুড়িও ওড়ে গুজরাতের মতোই।
পেড়া পান্ডুগা
অন্ধ্রপ্রদেশে তিনদিন ধরে মকর সংক্রান্তি পালিত হয়। প্রথমদিনকে বলা হয় ‘ভোগী পান্ডুগা’। এইদিন পুরাতনকে আগুনে আহুতি দেন অন্ধ্রবাসী। দ্বিতীয় দিনটিকে বলা হয় ‘পেড়া পান্ডুগা’। এই দিনটি খুব বড় করে উদযাপন করেন তাঁরা। নতুন জামা পরেন। বাড়িতে অতিথি, অভ্যাগত আসেন। বাড়ির দরজায় মুগ্গু আঁকা হয়। এটা একধরনের রঙ্গোলি। তৃতীয় দিনটি হল ফানুম্মা। কৃষকদের জন্য এই দিনটি বিশেষ দিন। মাক্কানুমা হল শেষ দিনটি। এই দিনে তারা উন্নতমানের ফসল পেতে মাটি, বৃষ্টি এবং আগুনের পুজো করেন। তারপর জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন। থাকে তিল আর গুড়ের মিঠাই।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়ির দুই রাস্তা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল
মকরাভিলাক্কু
কেরলবাসীরা মকরসংক্রান্তির শুভদিনে এই বার্ষিক উৎসবটি পালন করেন শবরিমালা মন্দিরে। ভগবান আয়াপ্পার জন্য, এইদিন হাজার হাজার ভক্ত এই মন্দিরে আসেন। তাঁরা একত্র হন পোনামবালামেডু পাহাড়ে উদ্ভাসিত মকরাভিলাক্কু অর্থাৎ স্বর্গীয় একটি আলোর বিন্দু বা তারা দর্শনের উদ্দেশ্যে। যে আলো তিনবার দেখতে পাওয়া যায়। কেরলবাসী নুতন জামা পরে বাড়িতেই সংক্রান্তি উদযাপন করেন। এইদিন বাড়িতেই তৈরি করেন তিলের লাড্ডু, পুরনপোলি, মকর চাউলা, খিচুড়ি, পায়েস পিন্নি তৈরি করে।
সুকরাত বা সাকারাত
মধ্যভারতের মধ্যপ্রদেশ এবং বুন্দেলখণ্ডে মকর সংক্রান্তি সুকরাত বা সাকারাত নামে পরিচিত। খুব পবিত্র একটি দিন এটি রাজ্যবাসীর কাছে। এইদিন সূর্যদেব দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণের পথে পা বাড়ান। এই দিন মধ্যপ্রদেশের হোসঙ্গাবাদ, জবলপুর, অমরকণ্টকে মানুষ পবিত্র নর্মদা এবং বেতয়া নদীতে পুণ্যস্নান করেন পুণ্যকালে। পুণ্যকাল অর্থাৎ স্থানীয় ভাষায় মকরস্নানের নির্দিষ্ট সময়। সূর্যদেবকে পুজো করে তাঁরা দানধ্যান করেন। ইন্দোরে এইদিন আকাশে ওড়ে রংবেরঙের ঘুড়ি। সবাই বাড়ি-বাড়ি মিষ্টি দেন। তিলের লাড্ডু আর গুড়ের লাড্ডু, মিষ্টি চিকি আরও অনেক কিছু তৈরি করেন তাঁরা।
আরও পড়ুন-কামারহাটির রেল বস্তিতে আগুন
শায়েন ক্রাত
মকর সংক্রান্তি সাড়ম্বরে পালিত হয় জম্মু এবং কাশ্মীরে। এই উৎসবের স্থানীয় নাম শায়েন ক্রাত। এখানকার বহুমানুষ এই দিন পবিত্র মকরস্নান করেন। পুজো ও যাগযজ্ঞর আয়োজন করা হয়। সংক্রান্তিতে কাশ্মীরিরা একটা বিশেষ নাচ করেন যাকে বলে ‘ছাজ্জা’। আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ফুল দিয়ে সাজিয়ে নাচ করেন মেয়েরা। থাকে ট্রাডিশনাল লাড্ডু।