বিশ্বের বিস্ময় : সুন্দরবন
সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ অরণ্য, যেখানে জোয়ার-ভাটাতে ভয়ঙ্কর সুন্দর বাঘ বাস করে। ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনেই, দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঘের আশ্রয়স্থল। যেখানে বাঘ ও হরিণের সহাবস্থান আছে।
সুন্দরবনে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ শুধু নয়। একইসঙ্গে বাঘ এবং মানুষের নিরন্তর যুদ্ধের সহাবস্থান– এক বিস্ময়কর অরণ্যে পরিণত। যা অভিনব অরণ্য, যা দেশি-বিদেশিদের কাছে আকর্ষণের বিষয়।
একমাত্র সুন্দরবনকে ঘিরে একাধিক ব্যাঘ্র-দেবতার সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যাঘ্র-দেবতারা নারী ও পুরুষ উভয়েই পুজিত। যেখানে ধর্মীয় সমন্বয় ঘটেছে। সুন্দরবন মানেই সম্প্রীতির অরণ্য সাম্রাজ্য।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
সুন্দরবনই একমাত্র অরণ্য, যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ জঙ্গলজীবী। পিতা বাঘের পেটে গেলেও, আবার পুত্রও সুন্দরবনে যেতে বাধ্য হয়। সুন্দরবন একমাত্র অরণ্য, যেখানে বনজ সম্পদের ভাণ্ডার, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। যেখানে বিধবা পরম্পরায় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বিধবাপল্লি।
একমাত্র সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বিচিত্র জীবিকা সৃষ্টি হয়েছে, যেমন— কাঠুরে, মউলে, বাউলে, জেলে, মাঝি, শিকারি ও অসংখ্য বিধবা বনজীবী।
পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর ওপর যত বই লেখা হয়েছে, তাদের মধ্যে বাঘের ওপর সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ওপর বই সিংহভাগ দখল করে আছে।
আরও পড়ুন-নির্মলার কুৎসা, রাজ্যের জবাব
সুন্দরবনের দ্বীপে দ্বীপে গড়ে উঠেছে লোকজীবনের সাহিত্য-সংগীত সংস্কৃতির সম্ভার। আজও ‘দুখে পালা’র গান জীবন্ত কিংবদন্তি। অরণ্যনাট্য বিধবার অশ্রুসংগীত পৃথিবীর আর কোথাও জীবন ও নাটক একাকার হয়ে যায়নি। আর কি কোথাও সাগরকে ঘিরে ‘সাগরমেলা’ আর বনকে ঘিরে ‘বনবিবির মেলা’ হয় ? বন আর বনজীবী বিধবাদের আলাদা করা যায় না। কোনওদিন যাবে না!
আরও পড়ুন-কমলাপুর ও কদমতলা-কুর্তিতে পরপর দুটি বিশাল সভা
বনদেবী ‘বনবিবি’: অন্নদাতা রক্ষাদেবী
আলকাপ, কুশান, গম্ভীরা বোলান বিষহরা ও লেটোর মতো ‘বনবিবির পালা’ লোকনাট্য– সুন্দরবনকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলের লৌকিক সংস্কৃতির, লোকমানসে বিশ্বাস, সংস্কার শ্রমজীবনের আচার-বিচার-এর ঐতিহ্য পরম্পরায় গড়ে উঠেছে বনবিবি সাহিত্য। যা পুঁথি, পালা, প্রবাদ-প্রবচনে, ছড়া, ধাঁধায় প্রকাশিত হয়েছে। শুধু মনোরঞ্জন নয়, মূল্যবোধ ও নীতি শিক্ষায় বনবিবির পালা এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। যা সমাজ-সংস্কৃতির অজানা অধ্যায় বেরিয়ে আসে—
‘আঠারো ভাটির মাঝে আমি সবার মা।
মা বলি ডাকিলে কারো বিপদ থাকে না।।’
আরও পড়ুন-প্রবল কটাক্ষ সমালোচনায় প্রত্যাহার গরু আলিঙ্গন দিবস
সুন্দরবনের বনদেবী হয়েছেন বনবিবি। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সমন্বিত অরণ্যদেবী বনবিবি। বনবিবির মাহাত্ম্য প্রচারক নিত্য-পূজা, নৌকার পূজা ও জঙ্গলের পূজা হয়। সেই সঙ্গে ছলন ও মানত পূজা হয়। বনবিবির পূজা-হাজোতের কোনও তিথি নেই। নেই কোনও দিনক্ষণের বাতুলতা। সুন্দরবনের জঙ্গলে যাওয়ার প্রধান মাসগুলির যেকোনও দিনে পূজা-হাজোত হতে পারে। বনবিবির থান ও মন্দির হয় জঙ্গলের মধ্যে, নদীর ধারে, সর্বসাধারণের স্থানে। বনবিবি তো সবার। বনবিবির পূজা-হাজোতে কোনও পুরোহিত বা খাদেমের প্রয়োজন নেই। জঙ্গলজীবীদের কাছে পূজার উপকরণ সামান্যই। বনবিবির মূর্তি সাধারণত জলে বিসর্জন হয় না। জঙ্গলে রেখে আসা হয়।
আরও পড়ুন-পরীক্ষার্থীদের ভরসা দিতে যুগান্তকারী একাধিক পরিবর্তন এনেছে পর্ষদ : শিক্ষামন্ত্রী
বনবিবির থানে নিরাকার বিবিমা। একক বনদেবীর কোলে একটি শিশু। সেই শিশু দুঃখে হোক, না হোক—বিশ্ব-মাতৃত্বের নিরাপদ আশ্রয়। বনদেবী সচরাচার ব্যাঘ্রবাহন। আবার বনবিবির সঙ্গে অনেক সময় একই সঙ্গে পূজিত হন ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়। পূজার কোনও মন্ত্র নেই। নেই কোনও ব্রাহ্মণ যাজক। অব্রাহ্মণ যাজক পূজা করতে পারেন। অনাড়ম্বর পূজা হয় ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের। দরিদ্র জেলে, বাউলে, মউলে আর কাঠুরেরাই প্রধানত দক্ষিণ রায়ের পূজা করে, দক্ষিণ রায়-কেন্দ্রিক সবগুলি কাব্যে আছে বাঘের ভয়ঙ্কর উপস্থিতি।
বনবিবির অনুষঙ্গে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়কে একান্ত প্রয়োজন। দক্ষিণ রায় শুধু ব্যাঘ্রদেবতা নন, প্রয়োজনে তিনি বাঘের রূপ ধরতে পারেন। তাই বাঘই দক্ষিণ রায়। সাপের ভয়ে যেমন মনসার প্রচার, তেমন বাঘের ভয়ে দক্ষিণ রায়। সর্পদেবতা মনসা, বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়— পৌরাণিক দেবতা নয়, লৌকিক দেবতা। সুন্দরবনের স্থানীয় মানুষের অর্থনীতি ও জীবিকার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়।
দক্ষিণ রায়ও বনবিবির মতো গৃহদেবতা নন। জঙ্গলে কিংবা নদীর ধারে, গাছের তলায় দক্ষিণ রায়ের পূজা হয়।
আরও পড়ুন-ভারতে এবার মিলল লিথিয়াম খনির সন্ধান
ব্যাঘ্রদেবতা ‘বনরাজা’। আবার কিংবদন্তি অনুসারে দক্ষিণ রায় ছিলেন যশোহর বাংলার ব্রাহ্মণ নগরের রাজা মুকুট রায়ের সেনাপতি। দক্ষিণবঙ্গের শাসনকর্তা ছিলেন বলে তাঁর উপাধি ছিল ‘ভাটীশ্বর’। আবদুর রহিমের ‘বোনবিবি জহুরানামা’য় আছে— ‘নামেতে দক্ষিণারায় ঈশ্বর ভাটির। এসব জংগল জান তাহার জায়গীর।।’ এখানে বাঘ এবং মানুষ মিলেমিশে একাকার। এমন পশু ও মানুষ উন্নীত হয়েছে দেবতায়।
বন্যজন্তুর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যাঘ্র-দেবতার পরিকল্পনা হয়েছিল। আবার ক্ষেত্রপাল রূপে দক্ষিণ রায়ের পূজা দেখলে মনে হয় তিনি কৃষি- দেবতাও। সুন্দরবন অঞ্চলে প্রতি শনি-মঙ্গলবার দক্ষিণ রায়ের থানে অগণিত মানুষের ভিড়। শুধু মউলে, বাউলে, জেলে, কাঠুরিয়াদের দেবতা নন; কৃষকদেরও দেবতা, মাঝি-মাল্লাদেরও রক্ষক। এককথায় অরণ্যলালিত সুন্দরবনের মানুষের কাছে দক্ষিণ রায় হলেন প্রধান আশ্রয়, জাগ্রত দেবতা।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় বিজেপির সংকল্পপত্র-এ ‘বাংলা-মডেল’, গেরুয়া শিবিরকে ধুয়ে দিলেন অভিষেক
ব্যাঘ্র-দেবতা দক্ষিণরায়কে কেন্দ্র করে, রচিত হয়েছে ‘রায়মঙ্গল’ রুদ্রদেবের ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে বাঘের ৬৪টি বিচিত্র নাম, আকৃতি, বেশ ও ব্যবহারের চমকপ্রদ বর্ণনা আছে। এত বিচিত্র নাম আর কোন লৌকিক দেবতার আছে? দক্ষিণ রায় ও বনবিবিকে কেন্দ্র করে সৃজিত হয়েছে ‘বনবিবি পালা’, ‘দুখে পালা’, ‘ধনা-মনা পালা’, ‘দুখে চম্পাবতী’ পালা, ‘রায়মঙ্গল পালা’, ‘দক্ষিণ রায় পালা’। মূলত বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য দক্ষিণ রায় ও বনবিবির মতো লৌকিক দেবতার সৃষ্টি হয়েছে। যা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকলের দেবতা। বনবিবি ও ব্যাঘ্র-দেবতা দক্ষিণ রায় একই বৃত্তান্তের দুটি মুখ। একে অন্যের পরিপূরকও বটে। নারী ও পুরুষের সমন্বয় ধর্ম-বর্ণ সবার কাছে এক বিস্ময়।
আরও পড়ুন-তুরস্ক-সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ছাড়াল ২১হাজার
দেবতা দুই— দুরকম দেবতা— ভয়ের দেবতা ও ভক্তির দেবতা। দক্ষিণ রায় ও বনবিবি, দুই দেবতা একইসঙ্গে পূজিত হন। ভয় ও ভক্তি মিশে গেছে ব্যাঘ্র- দেবতা ও বনবিবি। বাঘ ক্ষতি করে। সুন্দরবনের ভক্তরা বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়কে পূজা-উপাসনা করে, ‘ভাটিশ্বর’ দক্ষিণ রায় প্রতাপশালী রাজা— ভয়-ভক্তির আধিক্যে দেবতার মতো মান্যতা পায়। কিন্তু তিনি মানুষ এবং পশু হল বাঘ। কালক্রমে দক্ষিণ রায় দেবতায় পরিণত হয়েছে। তিনি ব্যাঘ্র-দেবতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। পদাধিকারবলে বাঘ হয়েছে তাঁর বাহন। মা মনসার সাপের মতো তাঁর অসংখ্য বাঘ-সৈন্য আছে। সুন্দরবন দক্ষিণ রায়ের রাজত্ব। তিনি পরাক্রান্ত ব্যাঘ্র-দেবতা।
আরও পড়ুন-
জলে তিনি কুমির চরে বেড়ান, ডাঙায় বাঘের পিঠে চলেন। অন্যদিকে, অরণ্যদেবী বনবিবি অরণ্যের জীবজন্তুর রক্ষয়িত্রী— অরণ্যলালিত মানুষের অভয়দাত্রী দেবী। ভয়ের দেবতা দক্ষিণ রায় ও ভক্তির দেবী বনবিবি— দুজনে একইসঙ্গে পূজিত। সুন্দরবন অঞ্চলে এই বৈপরীত্য এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। সুন্দরবনের এমন কোনও গ্রাম নেই, যেখানে একটা না একটা বনবিবির ‘থান’ নেই। তাই শুধু নিছক ভ্রমণ নয়; সুন্দরবন নিয়ে অ্যাকাডেমিক গবেষণা সারা বিশ্বে ক্রমশ আগ্রহ বাড়াচ্ছে।
সুন্দরবনের লৌকিক দেবী ‘বনদেবী’ ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাপরায়ণা নন, বরং তিনি লাবণ্যময়ী ভক্ত বৎসলা। বনফুলের মালাপরিহিতা বনবিবি— কোথাও বনদুর্গা, বনষষ্ঠী, বনচণ্ডী নামে পরিচিত। সেই সঙ্গে মউলেরা মধু, মোম, মৎস্য সংগ্রহে মন্ত্রবলে ‘বাঘবন্ধন’, ‘বনবন্ধন’, ‘বাগজব্দ’ও প্রচলিত আছে। আবার কোথাও ব্যাঘ্র-দেবতা দক্ষিণ রায় যোধৃবেশে। ব্যাঘ্র-দেবতা দক্ষিণ রায়ের পাশাপাশি কুমিরের দেবতা কালু রায়ের মূর্তি আছে। বনবিবির থানে এক জোড়া ধারা বা ঘট থাকে। একজন ব্যাঘ্র-দেবতা, অন্যজন কুম্ভীর-দেবতা। আবার কোথাও ব্যাঘ্র-দেবতা বরখাঁ গাজি যিনি ‘জিন্দাপির’ বা গাজি সাহেব নামে পরিচিত। ‘পাঁচ-পির বদর বদর’-বিখ্যাত পাঁচজন পিরের মধ্যে গাজিসাহেব অন্যতম। মৎস্যজীবীদের লৌকিক দেবতা ‘মাকাল ঠাকুর’। অরণ্যের অচেনা রহস্য সৃষ্টি করেছে দেব-দেবীর মাহাত্ম্য।
আরও পড়ুন-প্রধান হয়েও আজও থাকেন মাটির বাড়িতে
দক্ষিণ রায় কথা
ইতিহাসের উৎস না থাকলেও ভূগোলের অবস্থান দক্ষিণবঙ্গ তথা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য থেকে জানা যাচ্ছে সুন্দরবন অঞ্চলের নৃপতি ছিলেন দক্ষিণ রায়ের পিতা প্রভাকর রায়। নৃপতি প্রভাকর রায় ছিলেন ‘আঠারো ভাটি অঞ্চলে’র অধিশ্বর। শিবের বরে নৃপতি প্রভাকর রায় জন্ম দেন পুত্র দক্ষিণ রায়কে। দক্ষিণ রায়ের মা ছিলেন নারায়ণী দেবী। সংগ্রামী এবং পরিশ্রমী প্রভাকর রায় সুন্দরবনের অরণ্যময় অঞ্চলকে লোকালয়ের উপযোগী করে তোলেন। পিতার নাম প্রভাকর রায়, মাতার নাম নারায়ণী দেবী; পত্নীর নাম লীলাবতী, শ্বশুরের নাম ধর্মকেতু। পিতা প্রভাকর রায়ের মৃত্যুর পর পুত্র দক্ষিণরায় সুন্দরবন তথা আঠারো ভাটি অঞ্চলের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষিণ রায় মানুষ না ব্যাঘ্রদেবতা, না স্বয়ং মানুষ খেকো বাঘ!
আরও পড়ুন-২০ শতাংশেরও বেশি কর্মী ছাঁটাই Yahoo-র
দক্ষিণ রায় নামটি খুব পুরাতন নয় বলেই মনে হচ্ছে। দক্ষিণ রায় একজনের মানুষের নাম হওয়ার সম্ভাবনায় সবচেয়ে বেশি। ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে দক্ষিণ রায়কে ‘ভাটীশ্বর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ রায় সুন্দরবন অঞ্চলে প্রবল প্রতাপশালী রাজায় পরিণত হন। দক্ষিণ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের কাছে নয়নের মণিতে পরিচিত হন। সাধারণ জনসাধারণ তাঁকে ভয় ভক্তির আধিক্যে দেবতার মতো মান্য করতে শুরু করে। কালক্রমে প্রজাদরদি রাজা দক্ষিণ রায় দেবতায় পরিণত হন। সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর পশু বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য রাজা দক্ষিণ রায়ের পরাক্রম-বল ব্যবহৃত হয়। রাজা দক্ষিণ রায়ের সৈন্যদের মাধ্যমে বাঘের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছিল অরণ্যজীবী দরিদ্র মানুষদের। কালক্রমে রাজা দক্ষিণ রায় প্রজাদরদি হিসাবে দেবতায় পরিণত হন— যেমন ‘নর-নারায়ণ’। মানবদরদি মানব দেবতা ক্রমে ব্যাঘ্র-দেবতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। দক্ষিণ রায় রাজা, তাই পদাধিকারবলে বাঘ হয়ে গেছে তাঁর বাহন। সাপের ভয়ে যেমন মনসা দেবী, তেমনি বাঘের ভয়ে দক্ষিণরায়ও ব্যাঘ্রদেবতা।
আরও পড়ুন-আদানি: আজ শুনানি সুপ্রিম কোর্টে
কবি কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে দক্ষিণ রায়কে মানুষ রূপেই দেখানো হয়েছে। রাজা দক্ষিণ রায়ের রয়েছে অসংখ্য বাঘ-সৈন্য। বাঘও রাজা দক্ষিণ রায়ের কথা শুনে চলে।
আসলে প্রতাপশালী পরাক্রমী রাজা দক্ষিণ রায়ের সৈন্যরা ছিল বাঘের মতো ক্ষিপ্র ও দুর্ধর্ষ। মানবসৈন্য যেন বাঘের মতো ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। রাজা দক্ষিণ রায়ের বাহন শুধু ব্যাঘ্র নয়, অশ্ব দুই-ই। তিনি ‘চন্দ্রবদন চন্দ্রকায়/ শার্দূল বাহন দক্ষিণ রায়।’ আবার ‘সাগরসঙ্গম সুন্দর কায়/ ঘোটকবাহন দক্ষিণ রায়।’ ঢাল-তরোয়াল টাঙ্গি হাতে অথবা পঞ্চবান ধনুক হাতে ‘সংকট তার নং রায় নমস্তে’। রুদ্রদেবের ‘রায়মঙ্গলে’ তিনি আবার নর-রক্ত পিপাসু।
দক্ষিণ রায় শুধু বাঘের দেবতা নন; ক্ষেত্রপাল হিসাবে তিনি কৃষি-দেবতা। সুন্দরবনের জঙ্গলজীবী বাউলে, মউলে, কাঠুরিয়া, জেলেরা দক্ষিণ রায়কে স্মরণ করে, পূজা দেয়। কৃষকদেরও তিনি দেবতা, মাঝি-মাল্লাদেরও রক্ষক তিনি।
আরও পড়ুন-তুরস্ক-সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ছাড়াল ২১হাজার
অরণ্যচারী জাতির মধ্যেই ব্যাঘ্র-পূজার সবিশেষ প্রচলন আছে। জঙ্গলে হিংস্র জন্তুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যাঘ্র-দেবতার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে দক্ষিণ রায় ছিলেন যশোহর জেলার অন্তর্গত ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের সেনাপতি। নিম্নবঙ্গের শাসনকর্তা ছিলেন বলেই দক্ষিণ রায়কে ‘ভাটীশ্বর’ বলা হয়েছে। বাংলার দক্ষিণে সুন্দরবনে, বাঘের বিচরণক্ষেত্র। সে জন্য ব্যাঘ্রদেবতাকে দক্ষিণ দিকের অধিকারী বা ক্ষেত্রপাল বলে অভিহিত করা হয়েছে। নিম্নবঙ্গে ব্যাঘ্রাধিকারী একজন দেবতার কল্পনা করা হয়েছে। যাঁর নাম দক্ষিণ রায়। তিনি শুধু রাজা বা শাসক নন, তিনি ব্যাঘ্র-দেবতা যাঁর বাহনও বাঘ তিনি একইসঙ্গে ভয় ও ভক্তির দেবতা।