২৫ জুন, ১৯৭৫ সাল। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। সেদিন ঘোষিত হয়েছিল দেশে জরুরি অবস্থা। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি এবং ভয়ঙ্কর আক্রমণ নেমে এসেছিল সংবাদপত্রের ওপর। রাতারাতি দিল্লি থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-সহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের অফিসে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল। সমগ্র সংবাদমাধ্যমে চালু হয়েছিল প্রেস সেন্সারশিপ। অর্থাৎ, সরকারি অনুমোদন ব্যতিরেকে কোনও সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না।
আরও পড়ুন-ফের ছাঁটাই ট্যুইটারে
তখন অবশ্য বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম বাজারে আসেনি। টানা ২১ মাস গোটা দেশ দমবন্ধ জরুরি অবস্থার মধ্যে দিন কাটিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সেই অবস্থার অবসানের পর লোকসভার ভোটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং শাসক কংগ্রেসের কী হাল হয়েছিল, সেটা আমরা সকলেই জানি। জনরোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ব্যালটে। গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ সেই বিপ্লবে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল শাসককুল। একসময় যারা জরুরি অবস্থার পক্ষে সওয়াল করছিলেন, আর কুর্সিকে তোয়াজ করার জন্য বলছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’, তারাই রাতারাতি ভোল পাল্টেছিলেন। এদের মধ্যে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য। অসমের ওই কংগ্রেস নেতা ইন্দিরাকেই ‘দেশ’ বলেছিলেন। আর দলের বিপর্যয়ের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইন্দিরা হটাও, দেশ বাঁচাও’!
আরও পড়ুন-ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হানা সিরিয়ায়, মৃত ১৬
এই ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন হচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘স্বৈরাচারী’ মনোভাব দেখে। বিবিসি-র মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদমাধ্যমের ওপর মোদির সরকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমনিতেই একনায়কী শাসকের ন্যায় দেশের ‘নিরপেক্ষ এজেন্সি’গুলিকে দলের শাখা সংগঠনে পরিণত করেছে বিজেপি। বিরোধীদের দমন করতে, যথেচ্ছভাবে সিবিআই, আইটি, ইডি’র মতো সংস্থাগুলি এখন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের অঙ্গুলিহেলনে নির্লজ্জভাবে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সংবাদমাধ্যম— কেউ এজেন্সির আক্রমণের বাইরে নয়। রাজনৈতিক মহল বলছে, ভারতবর্ষে এইরকম স্বৈরচারী সরকারি আক্রমণ, এজেন্সিগুলির মাধ্যমে আগে কখনও হয়নি।
বিবিসি-র অপরাধটা কী? সম্প্রতি তারা একটি তথ্যচিত্র টেলিকাস্ট করেছে।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টে ক্যাভিয়েট শিন্ডের
বিষয় হল, গুজরাতের কয়েকবছর আগের কলঙ্কিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বিষয়টি বিজেপি এবং মোদি-শাহের কাছে বড়ই স্পর্শকাতর! নিজেদের অতীত কুকীর্তি এমন সময় ফের ফাঁস হয়েছে, যাতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের অস্বিস্ত ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছে। কারণ, দিল্লিতে জি-টোয়েন্টি গোষ্ঠীভুক্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির সম্মেলন আসন্ন। প্রধানমন্ত্রীর মোসাহেবরা বলতে শুরু করেছেন, এই সম্মেলনে মোদিজি বিশ্ববন্দিত হবেন। বাজনদারদের বাজনার আড়ালে দেশে দাঙ্গার খলনায়কের ‘কালো ছবি’ প্রকাশ হতেই, মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে মোদি-শাহের। তাই বিবিসি-র ওপর নজিরবিহীন অত্যাচার শুরু হয়েছে। হাতের অস্ত্র সেই এজেন্সি।
আরও পড়ুন-দুই হাজার কোটির ডিল! শিবসেনার প্রতীক বিক্রি নির্লজ্জ নির্বাচন কমিশনের
অবশ্য শাসককুল যে বরাবরই স্তাবক সংবাদমাধ্যম পছন্দ করে, সেটাও একটা ট্রাডিশন। তার অন্যথা হলেই, তখন ক্ষমতায় আসীন শক্তির আসল রূপ দেখা যায়। সিপিএমের কথাই ধরা যাক। আশির দশকে একের পর এক বিতর্ক তাড়া করছিল বামফ্রন্ট সরকারকে। তাদের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিল, সংবাদপত্রের একাংশের সমালোচনা। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের আজকের বেড়ালতপস্বীদের সেদিনের আচরণ কীরকম ছিল? সিটুর ব্যানারে আন্দোলনের নামে প্রায় দু’মাস ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সংস্থার কর্মচারীদের আর একটি ইউনিয়নের কর্মকর্তারা মধ্যস্থতা চেয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। জ্যোতিবাবু পরোক্ষে সিটুর আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। তাদের বলেছিলেন, ‘ওরা তো বসে পড়েছে, এখন আমি কী আর করব!’ শুধু তাই নয়, আনন্দবাজার পত্রিকায় আন্দোলনের সমর্থনে এক সভায় বক্তৃতা করেছিলেন সেই সময় সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক লক্ষ্মী সেন। এখনও সংবাদমাধ্যমের একাংশ মা-মাটি-মানুষের সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদে পদে খুঁত ধরতে ব্যস্ত। সমালোচনায় মুখর।
আরও পড়ুন-নিক্কি খুনে নাম জড়াল পুলিশের
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এবং সরকার তার তোয়াক্কা করেন না। নিজেদের কাজ তাঁরা করেই চলেছেন। এটাই তো যে কোনও সহিষ্ণু শাসকের চরিত্র হওয়া উচিত। কিন্তু মোদি-শাহরা বুঝে গিয়েছেন, সোজা আঙুলে মাখন না উঠলে, তার অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতেই দেশের সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগ হয় বাধ্য হয়েছে, নয় তো নিজেদের স্বার্থেই মোদি-ভজনায় মেতে রয়েছে। তাতেও স্বস্তিতে নেই দিল্লির বিজেপি শাসকরা। বিবিসি-র ওপর হামলা তারই বহিঃপ্রকাশ। এই মোদিজি ২০১৩ সালে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ভারতবর্ষের মানুষের কাছে বিবিসি-র প্রচণ্ড বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। এমনকী দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর চেয়ে এদেশের মানুষ বিবিসি-কে অনেক বেশি বিশ্বাস করে।
আরও পড়ুন-তুরস্কে উদ্ধারের গতিতে ক্ষোভ
আজ প্রধানমন্ত্রীর মনে হচ্ছে, এই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দুশমনি করছে। ইন্দিরাজিও সত্তর দশকে দেশের সংবাদপত্রগুলিকে সবক শেখাতে চেয়েছিলেন। তাঁকেও তোষামদ করে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল সবক শেখানোর। তার পরিণতি ইন্দিরাজির যা হয়েছিল, সেই পথেই কি এগােচ্ছেন মোদি-শাহরা? এই প্রশ্নের জবাব পেতে আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত দেশবাসীকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে, দিল্লির শাসকের আত্মবিশ্বাসে যে চিড় ধরেছে তাতে আর সন্দেহ কী!