সামাজিক সম্মেলনের দিক দিয়ে বাঙালির কাছে একটি বড় উৎসব দোল। আমরা বলি দোলযাত্রা। এই উৎসবের নায়ক হলেন বৃন্দাবনবিহারী যশোদানন্দন শ্রীকৃষ্ণ। যমুনার তট আজ গুলাল আর আবিরে একাকার। কী এক রঙের মেলায় জাগরিত হয়েছে সমস্ত বৃন্দাবন। কৃষ্ণপ্রিয়া রাধারানীর জন্ম বর্ষাণায়। কৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। আজ তিনি গোপী-সহ স্বয়ং রাধাকে রঙিন করে তুলবেন। বিশেষত তাদের মুখমণ্ডলকে রঙে রঞ্জিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য। কারণ, কৃষ্ণবর্ণ কানাই জানে গৌরবর্ণ রাধিকার গায়ের রঙের জন্য বড় অহঙ্কার। তিনি কেন কালো হলেন, যেখানে রাধা এত উজ্জ্বল বর্ণের। কেবল রাধা নন, গোপরমণীরা সকলেই গৌরবর্ণা এমনকী মাতা যশোদাও কত ফর্সা! তাই মা যশোদাকে একদিন দুঃখ প্রকাশ করে বললেন কৃষ্ণ, ব্রজবাসী, ব্রজরমণীরা সকলেই ধলো আমি কেন কালো হলাম। ওই দেখ রাধিকাকে, তার গায়ের রঙের জন্য অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না। মা যশোদা কৃষ্ণের মুখে এই খেদোক্তি শুনে হেসেই বাঁচেন না।
আরও পড়ুন-ঠাকুরবাড়ির উৎসবের দোল
‘ওরে কালা, কালো তো কী হয়েছে? তুমি নন্দরাজসূত, তোমার অহঙ্কারে আমি যে বাঁচি না? তবে রাধা আর গোপিনীদের যদি গায়ের রঙের জন্য এতই অহঙ্কার থাকে তবে নিশ্চয় তা ভাঙার উপায় আছে। ঐ দেখ কালা আকাশে বাতাসে কত রং! বৃন্দাবন তো রঙময়। তুইও এই রঙ দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল রাঙিয়ে দে না কেন?’ মায়ের বুদ্ধিতে আপ্লুত কৃষ্ণ। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে চললেন বর্ষাণা। আর সেখানেই রাধার অঙ্গে ছুঁড়ে দিলেন আবির। সেই আবিরের কিছুটা তাঁর গায়ে লেগে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে গেল। দু-জনে রঙের খেলায় মাতলেন। সেই হল দোল উৎসবের সূচনা। কবি গান লিখলেন, ‘ব্রজগোপী খেলে হোরি’। সেই কোন দ্বাপর যুগে এই রঙখেলার সূচনা! আজও ভারতের মন রেঙে ওঠে সেই উৎসবের কথা স্মরণ করে। কী করে এত যুগ ধরে প্রবহমান ইতিহাসের অলি-গলি ঘুরে, কত বিদেশি শত্রুর আগমন আর শাসনের পরেও একভাবে টিকে রইল এই উৎসব? এখনও কেন দোলের সকালে মাতোয়ারা হয়ে উঠি আমরা? এক অমৃতবাহী প্রাণশক্তি নিয়ে বেঁচে আছে এই রঙের উৎসব দোল।
আরও পড়ুন-দাপুটে জয়ের দিনে কাঁটা আশিক ও কাইথের চোট, আইএসএলের শেষ চারে মোহনবাগান
দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর গোপীগণ রঙের উৎসবে মেতেছিলেন। কিন্তু এটাই কি সব? শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আমরা যতগুলি অনুষ্ঠান দেখি তাদের পিছনে যাত্রা শব্দটি যুক্ত। দোলযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, স্নানযাত্রা আর রাসযাত্রা। এই যাত্রা শব্দটির অর্থ কী? কে যাত্রা করেন? কখনও তিনি রাধার সঙ্গে রঙ খেলেন, কখনও তিনি দোলনায় দোল খান আবার কখনও তিনি স্নান করেন বা একান্তে নৃত্য করেন গোপিনীদের সঙ্গে। এইসব কার্যের সঙ্গে যাত্রা শব্দটির কেন যুক্ত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পণ্ডিতগণ বলেছেন, আসলে কৃষ্ণের জীবন আধারিত এই উৎসবগুলি প্রকৃতপক্ষে সূর্যের গতিপথের চলন ব্যতীত আর কিছুই নয়। আমাদের জীবনধারায়, উৎসব অনুষ্ঠান, তিথি— সবই নির্ধারিত হয় সূর্য ও চন্দ্রের গতিকে নির্ভর করে। সূর্যদেব তাঁর চলনে দুটি স্পষ্ট পথ বা অয়ন সৃষ্টি করেন। একটি দক্ষিণায়ন অপরটি উত্তরায়ণ। কখনও তিনি উত্তরদিক-গামী, কখনও বা দক্ষিণদিক-মুখী। কিন্তু এই দুই প্রধান চলনের মধ্যেও থেকে যায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সেই মুহূর্তগুলিকে শ্রীকৃষ্ণ জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-শ্রদ্ধায়-স্মরণে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
এই তিথিগুলির সময়টির দিকে যদি নজর দেওয়া যায় তাহলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এক ঋতু থেকে আরেক ঋতুতে গমনের সময় প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আসে তা সূর্যের নৈকতয়ের জন্যই ঘটে থাকে। কখনও তিনি দূরে কখনও কাছে। ঋতু পরিবর্তনের ক্ষণটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রচলিত কথা আমরা দোল উৎসবের ক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই পারি। কথায় বলে, দোলের পর পুরোপুরি গ্রীষ্মের শুরু। তাই দোলের আগে গরমজামা লেপ-কাঁথা ধুয়ে তুলে রাখতে হয়। আবার ঝুলনযাত্রাও গ্রীষ্ম-শেষে বর্ষায় অনুষ্ঠিত হয়। তাই সূর্যের চলন আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ কৃষকগণ বলেন, ‘মীগের বাত’ এল আর এখনও বর্ষা এল না? এখানে মগের বাত মানে মৃগশিরা নক্ষত্র। চন্দ্র আদ্রা নক্ষত্র ত্যাগ করে মৃগশিরা নক্ষত্রে প্রবেশ করলে তারপর বর্ষা আসে। সূর্য আর চন্দ্রের চলন আমাদের উৎসব আর আনন্দকে নিয়ন্ত্রিত করে। তাই খেয়াল করলে দেখা যায় কৃষ্ণ-সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসব পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং দোল কেবল আনন্দের বা রঙের উৎসব নয় তা হল আদিম মানুষের ধীরে ধীরে জীবনকে তিথি ও নক্ষত্রে বেঁধে রাখার সুনিপুণ প্রয়াসের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লাগামহীন কুৎসা, আইনি জালে কং-নেতা
দোল উৎসব নিয়ে কত পর্যটক কত কথাই লিখেছেন। কিন্তু তা শুধুই বর্ণনা। উৎসবের গভীরতায় অবগাহন করেননি তাঁরা। এক্ষেত্রে ভগিনী নিবেদিতা একেবারে ব্যতিক্রম। তাঁর দোল সম্বন্ধে সুন্দর একটি প্রতিবেদন পাই। যেখানে তিনি প্রথমেই বলছেন, ‘ফাগুন পূর্ণিমার দিন। রাতের শেষে এল সুন্দর সকাল। এক ঝলক হাওয়া ভেসে এল গঙ্গার তীর থেকে। তার সঙ্গে ভেসে এল ভারতীয় বাঁশির সুন্দর সুর। আশ্চর্য রহস্যময় সূর্যোদয়ের এই প্রথম মধুর মুহূর্তে সেই আশ্চর্য রহস্যময় সেই সুর, তার ওঠাপড়া, মধুর বিরতি, কোমল টানের উপর ছড়িয়ে আছে বিষাদের ভাব। সেই সুর পূজার মন্ত্রের মতো বেজে ছিল সেই রাতে, যা ছিল চৈতন্যের জন্মের রাত, নদীয়ার মহাপুরুষ, বাংলার কবি ও মুক্তিদাতা চৈতন্য। আহা, মানব প্রেমিকের নদীয়ায় জন্ম কী অপূর্ব।’ বাস্তবিকই দোলপূর্ণিমা হল শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি, তাই এই পূর্ণিমাকে বৈষ্ণবগণ বলেন ‘গৌরপূর্ণিমা’।
আরও পড়ুন-মিড ডে মিলের দায়িত্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠী
দোল উৎসব আমাদের কাছে কেবল রঙের উৎসব নয়, তা হল প্রেমের উৎসব। প্রাচীন কালে মানুষ নিজের সঙ্গী নিজেই খুঁজে নিত। কিন্ত তার জন্য ছিল কিছু আনন্দের অনুষ্ঠান। আদিবাসীরা কখনও বিশেষ মেলায় গিয়ে আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সঙ্গী নির্বাচন করত। দিন যত এগিয়েছে ততই পরিশীলিত হয়েছে মানবমন। তাই প্রেমের দিবসে এসেছে ভিন্নতা। প্রতি দেশেই রয়ে গিয়েছে এমন একটি দিন যেই দিনে পূজিত হন প্রেমের দেবতা। সেই দিনটি এমন সময় নির্দিষ্ট হত যে সময়ে প্রকৃতি হয়ে উঠত সবচেয়ে সুন্দর। উন্মুক্ত আকাশ, না রোদের তীব্রতা না বৃষ্টির ম্যাজমেজে আবহাওয়া। সবচেয়ে সুখকর প্রকৃতির অনুষঙ্গ সঙ্গে থাকবে সুন্দর ফুলের সমারোহ। বসন্তকাল শীতের শেষ গ্রীষ্মের শুরু। চারিদিকে শিমূল, আর পলাশ ফুল আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে তার রক্তিমা দিয়ে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অশোক আর আমের মুকুল। প্রচলিত কথায় বলে সুন্দরী কন্যার পায়ের শব্দ শুনলেই অশোক ফুল প্রস্ফুটিত হয়। আর আমের মুকুল? সে তো কামদেবের পঞ্চশরের একটি। কামদেব পুষ্পপ্রিয়। তিনি ফুলের গহনা ধারণ করে ঘুরে বেড়ান চারিদিকে। তাঁর পঞ্চশর এমন ফুল দিয়ে তৈরি যেগুলি মধুতে পূর্ণ। সেই মধুপূর্ণ পুষ্পরাজির মধ্যে ভোমরারা গুন-গুন করে উড়ে বেড়ায়। আর যখন তাঁরা ফুলের মধু খেতে বসে তখন মনে হয় কামদেবের পুষ্পধনুটি যেন ভোমরা দিয়েই তৈরি।
আরও পড়ুন-দল জিতলেও ট্রোলড রোনাল্ডো
দোলের আরেক অনুষঙ্গ হোল দোলনা। প্রাচীন যুগে মেলাগুলোতে দোলনা থাকত। সেখানে নারী-পুরুষ আনন্দ করে দোলনায় দুলত এবং নিজেদের সঙ্গীকে পছন্দ করত। পরবর্তী কালে এই দোলনাকেই কৃষ্ণ-জীবনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। রাধা এবং কৃষ্ণ এই দিনে দোলনায় একত্রে দোল খান। তাঁদের এই আনন্দবাহী স্মৃতিতে অনেক প্রাচীন মন্দিরে আমরা দোলনার দেখা পাই। এই উৎসবকে আমরা মদন উৎসবও বলতে পারি। এই উৎসবের দুটি দিক আছে, প্রথমত স্ত্রী-পুরুষের স্বাধীন ভাবে মেলামেশা আর এর সঙ্গে থাকে অমার্জিত কিছু রঙ্গরস। বিশেষ করে ইউরোপের ভ্যালেন্টাইন ডে-র সঙ্গে আমরা এর তুলনা করতে পারি। তবে ‘উদ্ধব সংবাদ’ গ্রন্থে রাধারানীর একটি বিরহী রূপও অঙ্কিত হয়েছে। রঙের উৎসব শেষ করে মথুরায় চলে গিয়েছেন কৃষ্ণ। আর বৃন্দাবনে ফিরে আসার সময় নেই। তিনি পাঠিয়েছেন উদ্ধবকে। যার আকৃতি ও রূপ কিছুটা কৃষ্ণের মতো ছিল। তাকে দেখে ব্রজবাসী অবাক! কৃষ্ণের মতো কিন্তু তিনি কৃষ্ণ নন। সকলের সঙ্গে সম্ভাষণ শেষ করে উদ্ধব উপস্থিত হয়েছেন রাধার কাছে। কৃষ্ণ-বিরহে নিজেকে ভুলে গিয়েছেন রাধা! বাতাসের চলন দেখে তাঁর মনে হয়েছে বসন্ত সমাগত। তিনি ইতিউতি চাইছেন, কৃষ্ণ কি এলেন? এমন সময় ভোমরা গুন-গুন করতে করতে রাধার মুখমণ্ডলের চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে করেছে এও এক ফুল বুঝি! আর রাধিকা তার কালো রঙ দেখে মনে করেছেন এ নিশ্চ্য়ই কৃষ্ণের দূত বা কৃষ্ণ স্বয়ং! তাই বিরহে, বিষাদে বলছেন, ‘নিষ্ঠুর সেই কালা আমাদের ছেড়ে গেছে, তার হয়ে কিছু অজুহাত দিতে এস না।’ ফাগুনের হাওয়ায় এ-রাধার এই বিষণ্ণ রূপ আমাদের উদাস করে দেয়।
আরও পড়ুন-অ্যাডিনো-সামলাতে হল ১৬ শয্যার শিশু ইউনিট
আজ আমরা বহু রঙের আবির ব্যবহার করি। কিন্তু রক্তবর্ণের আবিরই এই উৎসবে ব্যবহার করা উচিত। কারণ, বলা হয় কৃষ্ণ যখন কংসরাজকে হত্যা করেছিলেন তখন যমুনা নদীর তট রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষ অত্যাচারী রাজার মৃত্যুতে আনন্দিত হয়ে রক্তে লাল হয়ে যাওয়া বালু দিয়েই আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। লাল আবির হল সেই রক্তমাখা বালুকণার প্রতীক। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে বহুকাল আগে ফাল্গুন মাসে নববর্ষ পালিত হত। এই উৎসবকে তাই শস্য উৎসবও বলা যায় কারণ এই সময় নতুন ফসল তোলার সময়। তাই উৎসবের আগে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের রীতি।
আরও পড়ুন-মরুরাজ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ভুগছে বিজেপি
এই উৎসবের মধ্যে আদিম উৎসব সংযুক্ত হলেও আজ তা পূজার আবশ্যিক অঙ্গ রূপে চিহ্নিত হয়। তাই যাঁরা অতীত জানেন না, ঐতিহ্যকে মান্য করেন না, তাঁরা দোকান থেকে আবির ও রঙ সংগ্রহ করেই খেলায় মেতে ওঠেন। আর যাঁরা অতীত, ঐতিহ্যকে মান্য করেন তাঁরা পুজো হওয়ার পর প্রসাদী আবির ব্যবহার করেন। এই দিন সকলের আবির গ্রহণ করার দিন। উচ্চ-নীচ ভেদে আবির গ্রহণ করাই রীতি। তবে আবির দানের পরিবর্তে অসভ্যতাকে কেউ আজ সহ্য করে না।