নারীদিবস এমন একটা মঞ্চ যেখানে সমাজের অনেক পুরনো কথা আবার নতুন করে উঠে আসে। এখনও আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে। আমি নিজে যেখানে বাস করি সমাজের সেই সচ্ছল মধ্যবিত্ত অংশে এখনও কীভাবে নরনারীর বৈষম্যের চোরাস্রোত বয়ে যায় ভাবলে অবাক লাগে।
আরও পড়ুন-হাসপাতালে তাণ্ডবে এফআইআর
এই সমাজ দেখেছে যে মেয়েরা পারে না এহেন কাজ নেই। কার্গিল যুদ্ধে মেয়েদের আমরা বীর পরাক্রমে লড়তে দেখেছি, এভারেস্ট জয় করতে দেখেছি, রাজ্য চালাতে দেখেছি। কোথাও নারী বলে তাঁদের দমে যেতে দেখিনি। বিজ্ঞানের বই থেকে কবিতার খাতায়— মেয়েদের দাপট আমরা দেখেছি। কিন্তু তবু এখনও আমি ঘরের কোণে, অফিসের টেবিলে, মিছিলে, স্লোগানে, বাসে বা বিমানে দেখেছি লিঙ্গবৈষম্যের নগ্ন রূপ।
মেয়েদের শক্তিকে এখনও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না সমাজের একটা বড় অংশ৷
আরও পড়ুন-মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ শীঘ্রই
মেয়েদের অসহায় ধরে নেবার একটা মনস্তত্ত্ব ঘরে বাইরে থেকে গিয়েছে। তার থেকেও বড় কথা অনেক সময় মেয়েরা নিজেরা চুপ করে থাকছেন, মেনে নিচ্ছেন এমনকী সাদরে গ্রহণ করছেন লিঙ্গবৈষম্য। নিজের বিয়েতে বাবা-মাকে ধার করতে দেখে নীরব থাকছেন মেয়েরা। আর সেটা করছেন লেখাপড়া শেখা, কাজকর্ম করা যথেষ্ট সাব্যস্ত মেয়েরা। এই প্রবণতার শিকড় খুঁজে বের করা বড়ই জরুরি।
প্রীতীশ নন্দী তাঁর একটা নিবন্ধে একবার লিখেছিলেন, খবরের কাগজের ম্যাট্রিমনিয়াল পাতাগুলো সমাজের দর্পণ। মানুষ আসলে কতটা এগিয়েছে বা আদৌ এগিয়েছে কিনা সেটা বোঝা যায় এই বিবাহেচ্ছু পরিবারের বিজ্ঞাপন থেকে। সকলেই গৃহকর্মে নিপুণ মেয়ে চান। প্রায় সকলেই সরকারি চাকুরে বর চায়। মেয়ে বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে এখনও বাড়িতে কান্নার হিল্লোল বয়ে যায়। এই শতাব্দীর দোরগোড়ায় আইন করে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ বন্ধ করতে হয়। এমনই ভয়ানক আকার নিচ্ছিল কন্যাভ্রূণ হত্যার সংখ্যা।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত ভোটে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান
যতদিন মেয়েদের হাতে সমাজ, পরিবারের রাশ আসবে না ততদিন কন্যাসন্তান চাইবেন না সমাজের একটা বড় অংশ৷ নারীর হাতে টাকা, ক্ষমতা আসা তাই খুব জরুরি। তার থেকেও জরুরি নারীর অনড় মনোভাব। নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারার জোর। মেয়েরা চাকরি করলে এখনকার পরিবারের লোকজনের ভালই লাগে৷ কিন্তু মেয়েদের দাপট দেখলে এখনও লুকোনো সমাজপতিরা বেশ রেগে যান। মেয়েরা চাকরি করুক, সংসার করুক, কবিতা লিখুক সব মানা যায়, কিন্তু মেয়েরা দাপটের সঙ্গে একা সব কাজ করছে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিচ্ছে, মেয়েদের আলাদা করে অসহায় লাগছে না এটা এখনও অনেকে ঠিক হজম করতে পারেন না। মেয়েদের কাছে পরাজয়ও অনেকে সহজ মনে মেনে নিতে পারেন না। মেয়েরা হবে নরম, মাথানিচু, গলে পড়বে, বায়না করবে, সাহায্য চাইবে, মাথার ওপর পুরুষ নামক ‘বটবৃক্ষ’ ছাড়া মেয়েরা গৃহহীন পক্ষিশাবকের মতো অসহায় হবে— এই না হয়ে মেয়েরা যদি ‘বড় বড় কথা’ বলে, বড় বড় কাজ করে জিতে যায়, নিজের জীবন নিজেই বুঝে নেয়, নিজের সুরক্ষার জন্যে যে একাই একশো, তেমন মেয়েকে এখনও খোলা মনে মেনে নিতে পারেন না অনেকে।
আরও পড়ুন-বিনিয়োগ ১৩০০ কোটি, কর্মসংস্থান বহু
নারীর আত্মবিশ্বাসকে যে মানুষ, যে সমাজ ভয় পায় সেই সমাজের মাটি ক্রমশ অনুর্বর হবে। এখন মেয়েদের আরও এগিয়ে যাবার সময়৷ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনও কথায় কান না-দেবার সময়। আরও বেশি করে চিন্তা-ভাবনা করা, বেশি করে বই পড়া দরকার আমাদের। বই মনে এমন একটা শক্তি তৈরি করে দেয় যেটা আর কোনও বন্ধু বা পরিবার, আত্মীয়রা পারে না। আত্মবিশ্বাস একবার তৈরি হলে তা আর ভাঙতেও পারে না কেউ। তাই বেশি করে পড়া আর ভাবার কাজ চলুক। একজন নারী কী পরবেন, কী করবেন, আর তাঁর নিজের দেশে কীভাবে থাকবেন সেই সিদ্ধান্ত যেন তিনি নিজে নিতে পারেন। কারও চাপিয়ে দেওয়া চিন্তা ও সিদ্ধান্ত যেন সজোরে প্রত্যাখ্যান করতে পারি আমরা। স্বাধীনতা আমাদের সকলের জন্মগত সাংবিধানিক অধিকার, কোনও ভিক্ষার দান নয়। একটা কথা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যেমন পূর্ণ স্বরাজ চাওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন-বিনিয়োগ ১৩০০ কোটি, কর্মসংস্থান বহু
নারীদিবস প্রসঙ্গে এই কথাই বলতে চাই যে, নারীর ক্ষেত্রেও পূর্ণ স্বরাজ নারীর বিকল্পহীনভাবে জরুরি। কারও চাপের কাছে নতিস্বীকার করলে আমাদের জীবনটা তাৎপর্য হারিয়ে ফেলবে। তাৎপর্য হারিয়ে গেলে ধীরে ধীরে আনন্দ হারিয়ে যাবে জীবন থেকে। নিজের দুর্লভ জীবনে আর নিজের মতো করে বাঁচা যাবে না। আর শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম বলে অমূল্য এই জীবনটায় ঠিকমতো বাঁচব না— এটা তো কোনওভাবেই চলতে দেওয়া যায় না।