তাঁর গ্রামের নাম ছিল নয়াপাড়া। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে কর্ণফুলী নদী। পাঠশালার শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন নয়াপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে। আর সেখানেই ভাল লেগে গিয়েছিল মাস্টারমশাই হেমেন্দ্রবাবুকে। তিনি গলা ছেড়ে আবৃত্তি করতেন নবীনচন্দ্র সেনের দেশাত্মবোধক কবিতাগুলি। তাঁর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকত বিদ্যাসাগরের ছবি। পরে পড়তে এলেন চট্টগ্রাম শহরে। এই সময় হাতে আসে সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’। মন দিয়ে তখন পড়ছেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ও। স্কুলের পাঠ শেষ করে ভর্তি হলেন কৃষ্ণনাথ কলেজে। ভাগীরথীর তীরে, জেলখানার পাশে কলেজ। অধ্যক্ষ শশিশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াতেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। পড়ানো হত গিবন-এর ‘দি ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’। পাশাপাশি পড়তেন আয়ারল্যান্ডে বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস, বিপ্লবী জন মিচেলের আত্মত্যাগের কাহিনি, ইস্টার বিদ্রোহের কথা। বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে গেছেন বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায়। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বন্যাত্রাণে।
আরও পড়ুন-প্রসঙ্গ : চিরঞ্জিত
এহেন সূর্য সেন মাস্টারদা হলেন উমাতারা উচ্চবিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর। সেখানে তিনি শিক্ষক। ছাত্রদের মুখে মুখে তখন তিনি ‘মাস্টারদা’। কিছু দিন পর গোটা ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন কেমন চলছে, তা দেখার জন্য রওনা দেন গুয়াহাটির দিকে। বেশ কয়েক মাস অসমে কাটিয়ে লখনউ এসে যখন পৌঁছন, তখন উত্তর ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এসেছে। লখনউ থেকে কলকাতা, এসে উঠলেন ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের গোপন আস্তানায়। সেখানেই তাঁকে গ্রেফতার করা হল, ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর। পাঠিয়ে দেওয়া হল রত্নগিরি জেলে। পাশেই আরব সাগর। সেই সময় ‘ভারতী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। শোভাবাজারের গুপ্ত আস্তানায় হ্যারিকেনের আলোয় রাত জেগে চলত ‘পথের দাবী’ পড়া। পরবর্তিকালে বারবার বলতেন, মহৎ সাহিত্য মনকে সজীব রাখে। ভালর প্রতি লোভ জন্মায় এ-সব বই পড়লে।
আরও পড়ুন-গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত
বিএ পরীক্ষা দিয়ে আসার পর বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রীর নাম পুষ্পকুন্তলা। বিয়ের সময় মাস্টারদা কিছুটা মানসিক দোলাচলের মধ্যে ছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় তাঁর উচ্চশিক্ষার যাবতীয় খরচ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বহন করেছিলেন ভাবী শ্বশুরমশাই। দেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিপ্লবী দলে যোগদানে মনস্থির করে ফেলেছিলেন আগেই। কৌমার্যব্রত পালন ছিল বিপ্লবীদের কঠোর অনুশাসন। কিন্তু ভাবী শ্বশুরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত এই বিয়েতে অস্বীকৃত হতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন তিনি। যদিও বিয়ের রাতেই তিনি নববধূ পুষ্পকুন্তলাকে তাঁর মনোবাসনার কথা জানান এবং পর দিনই চট্টেশ্বরী দেবীর মন্দিরে শপথ নিয়ে বিপ্লবী দলে যোগ দিয়ে সংসারত্যাগী হন।
এর পর থেকে সারা দিন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন পুষ্পকুন্তলা, কারও নিষেধ শুনতেন না। শেষ চিঠিতে পুষ্প লিখেছিলেন, ‘তোমার দেওয়া দেবী চৌধুরাণী বইটা কাল রাতে শেষ করেছি।’ আঁকাবাঁকা হরফে আরও লেখা, ‘আমি যখন থাকব না, তখন টোনার দিকে একটু লক্ষ্য রেখো।’ টোনা, সূর্য সেনের বড়দার ছেলে। পুষ্প সূর্য সেনের বৌদিকে বলতেন, ‘আমি কী তোমার মেজমশাইয়ের কাজে কোনও সাহায্যই করতে পারতাম না দিদি?’
আরও পড়ুন-গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত
মাস্টারদাকে প্রীতিলতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মেয়েদের আপনারা দলে নিতে চাইতেন না কেন দাদা? তাঁরা কি দেশসেবার যোগ্য নন?’ মাস্টারদা জবাব দিয়েছিলেন, ‘না, দেশসেবার কঠিন কর্তব্য থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা চলে না। দেশসেবায় নরনারী ভেদ নেই।’ মাস্টারদার পাশে তখন রাখা আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী ড্যানিয়েল ব্রিন-এর সেই বিখ্যাত বই, ‘মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম’। বইটা পড়ার জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রীতিলতা। মাস্টারদার নির্দেশেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয় সেই খবর, ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দেদার গত ৫ জুলাই, মঙ্গলবার, চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত।’ অন্তর্ধানের পর প্রীতিলতা ছিলেন পড়ৈকড়া দাতব্য হাসপাতালের চিকিৎসক হেমন্তকুমার ঘোষের বাড়িতে, তাঁর শ্যালিকা পরিচয়ে। হেমন্তবাবুর বাড়ি থেকেই তিনি রওনা দেন সূর্য সেনের গোপন আস্তানার উদ্দেশে। নৌকো কর্ণফুলী নদী বেয়ে খালের মধ্যে ঢুকে পড়ৈকড়া গ্রামের গোপন ঘাটে এসে পৌঁছয় যখন, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। নির্মল সেন বলেছিলেন, ‘মাস্টারদা কারও কাছে কিছু চান না। ওঁকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। এক-এক সময় টাকাপয়সার চিন্তায় আমার ঘুম হয় না, আর মাস্টারদা শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েন। ঠিক একটি ছোট ছেলের মতো, আমার ভারী চমৎকার লাগে।’
আরও পড়ুন-ভোরবেলা টালিগঞ্জের এনটি ওয়ান স্টুডিও’র একাংশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বলেছিলেন, পলাতক এই জীবনে অনেক কষ্ট তোমায় সহ্য করতে হবে। রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত হয় প্রীতিলতার। ঠিক হয়, ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, ইউরোপিয়ান ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বেই আক্রমণ করা হবে। মাস্টারদার সে দিন মুসলমান চাষির বেশ। পরনে লুঙ্গি, কাঁধে গামছা, খালি গা। চলে যাওয়ার আগে প্রীতিলতা বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু আর ফিরে আসব না দাদা। এক জনকে তো জীবন দিয়েই শুরু করতে হবে। মানুষ মনে করে, মেয়েরা অক্ষম, মেয়েরা দুর্বল। ভ্রান্ত এই ধারণা ছিন্ন করার সময় এসেছে। তা হলেই আমার বিশ্বাস, বাংলার বোনেরা দুর্বলতা ত্যাগ করবে, হাজারে হাজারে যোগ দেবে বিপ্লবী সংগ্রামে।’ প্রীতিলতার মৃত্যুর পর সূর্য সেন লিখেছেন, ‘সাজিয়ে দিয়ে যখন করুণভাবে বললাম, তোকে এই শেষ সাজিয়ে দিলাম। তোর দাদা তো তোকে জীবনে আর কোনওদিন সাজাবে না।’
আরও পড়ুন-কম্বল-কাণ্ডে নয়ডা থেকে ধৃত জিতেন্দ্র
জেলে মাস্টারদার সঙ্গী ছিল চারটি বই। গীতা, চণ্ডী, মহাভারত আর রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’। খুব ভোরে উঠে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন বা স্তোত্রপাঠ করতেন। সকাল কেটে যেত গীতা পাঠে, দুপুরে পড়তেন মহাভারত। পড়বেন বলে চেয়ে পাঠিয়েছিলেন জলধর সেন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং অনুরূপা দেবীর বই। প্রায় এগারো মাস জেলে থাকার পর তাঁর ফাঁসির রায় বেরয়। জেলে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে বাড়ির লোকের দেখা করার অনুমতি দেয়নি ব্রিটিশ। ফাঁসির পরেও তাঁর দেহ দেখতে পেলেন না কেউ। ফাঁসির আগে জেলের কয়েক জন ব্রিটিশ পুলিশ মাস্টারদার উপর প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। চিৎকার শুনে পাশের কুঠুরিতে মাস্টারদার বিপ্লবী সহযোদ্ধা ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত তারকেশ্বর দস্তিদার প্রবল প্রতিবাদ করলে তাঁর উপরেও নেমে আসে নির্যাতনের কঠোর শাস্তি। মাস্টারদার প্রায় সমস্ত দাঁতই উপড়ে ফেলা হয়। শেষে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারি ফাঁসি হয় সূর্য সেনের।
আরও পড়ুন-কুন্তলকে সম্মান, কেন দায় নেবে না মিডিয়া?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহ-অধ্যাপক হায়াত হুসেন মাস্টারদার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আশির দশকে, যা তিনি বাংলাদেশে সূর্য সেন শতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি প্রকাশিত (১৯৯৩-’৯৪) স্মারকগ্রন্থে উল্লেখ করেন। সেখানেই মাস্টারদার মৃতদেহের যে কী করুণ পরিণতি হয়, তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী ব্রজেন সেন ও পটিয়ার মাস্টারদার গ্রামের অধিবাসী নুর আহমেদের সাক্ষাৎকারে। দুজনেই বলেছেন মাস্টারদার মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নুর ১৯২৮ সালে কনস্টেবল পদে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি জানান মাস্টারদার ফাঁসির দিন প্রায় পঞ্চাশ জন পুলিশ নিযুক্ত করা হয়েছিল কারাগারের ফটকের সামনে। ফাঁসির পরে একটি ট্রাকে করে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চার নম্বর জেটির কাছে। সেখানে তখন একটি জলযান নিয়ে হাজির আরও কিছু সশস্ত্রবাহিনী ও অফিসারের দল। জলযানে তুলে দেহ দু’টি বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করলে কয়েক জন ব্রিটিশ মৃতদেহ দু’টিতে পদাঘাত করতে শুরু করে। এই অমানবিক দৃশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ব্রিটিশরা নিবৃত্ত হয়।
আরও পড়ুন-সমর্থকদের ট্রফি উৎসর্গ দিমিত্রিদের, গোয়েঙ্কার উপহার, সরে গেল এটিকে
দেহ দু’টিকে পৃথক ভাবে লোহার দড়ি দিয়ে বেঁধে ছুঁড়ে ফেলা হয় বঙ্গোপসাগরের অতলে।
মাস্টারদার শেষ চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে এক আশিরনখ বিপ্লবীর স্বপ্ন ও সাধনার বৃত্তান্ত :
‘‘আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই ত’ সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত’ সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকেও স্মরণ করার এই ত’ সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাইবোনেরা, তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্র্যহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করছিল। জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পিছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মত তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধু্রা— এগিয়ে চল। এগিয়ে চল— কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
আরও পড়ুন-পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুতে শীর্ষস্থানে মোদি-শাহ’র গুজরাত
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোন দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে— এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
বন্দে মাতরম্।”