জল জমে তৈরি হয় বরফ। শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে জলের উষ্ণতা পৌঁছে গেলে সেই জল জমে বরফ হয়। ওটাই জলের হিমাঙ্ক। আর এই বরফ জলে ভাসে। কারণ জলের চেয়ে বরফের ঘনত্ব কম। এই ধরনের তথ্যগুলো সকলেরই জানা। কিন্তু বিজ্ঞানের বই থেকে এই তথ্যের পাশে এবারে হয়তো একটা ফুটনোট বসানোর সময় এসে গিয়েছে। কারণ বিজ্ঞানীরা এবার এমন এক ধরনের বরফ তৈরি করেছেন, যা জলে ভাসছে আবার ডুবেও যাচ্ছে! এই বরফের এরকম কিছু ধর্ম রয়েছে যা এতদিন ধরে দেখে আসা বরফের চেয়ে অনেকভাবেই আলাদা।
আবিষ্কারটিও হয়েছে বেশ আকস্মিকভাবে। সম্প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে খবরটি। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের অধ্যাপক আলেকজান্ডার রোসু-ফিনসেন এবং তাঁর কয়েকজন সহকারী মিলে গবেষণাগারে তৈরি করেছেন এই বিশেষ ধরনের বরফের নমুনা।
এই বরফের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যামরফাস আইস’ (Amorphous ice), বাংলায় বলা যেতে পারে অনিয়তাকার বরফ। এর মধ্যে জলের অণুগুলি সাধারণ বরফের মধ্যে ঠিক যেভাবে সজ্জিত থাকে, সেইভাবে নেই। এমনিতে আমরা জানি যে কঠিন বস্তুর সহজ হিসেবে দুটো ভাগ— নিয়তাকার আর অনিয়তাকার। যেসব পদার্থের নির্দিষ্ট আকার আছে, যেমন বরফ বা চিনির দানা সেগুলো নিয়তাকার; আর যেসব বস্তুর নির্দিষ্ট আকার নেই, যেমন ময়দা বা বালি, সেগুলো অনিয়তাকার। নতুন ধরনের এই বরফ অনিয়তাকার কারণ এর মধ্যে অণুগুলি সাধারণ বরফের মতো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা নিয়ম মেনে সজ্জিত নেই, আছে অনিয়মিতভাবে। তরলের মধ্যে যেমন থাকে অণুর গঠন, অনেকটা সেইরকম। তবে কি এই বরফ আসলে কঠিন নয়, তরল? সেটা নিয়েই এখন মাথা ঘামাচ্ছেন ওঁরা।
কীভাবে তৈরি হল এই বরফ (Amorphous ice)?
ঠিক কীভাবে তাঁরা তৈরি করলেন এমন বরফ। সে উপায়টা ভারি সহজ। একটা পাত্রে রাখা হবে কিছুটা বরফ আর স্টিলের গোল গোল কয়েকটা বল (এক-একটার ব্যাস এক সেন্টিমিটারের মতো)। তবে ওই বলগুলোর উষ্ণতা বেশ কম— মাইনাস দুশো ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এবার ওই পাত্রটাকে ধরে বেশ আচ্ছা করে ঝাঁকাতে হবে। এতে কী হবে, ওই বরফটা ভেঙে যেতে থাকবে। আর একটু পরে দেখা যাবে পাত্রের মধ্যে রয়েছে সাদা মিহি পাউডারের মতো বরফের গুঁড়ো। ওটাই অনিয়তাকার বরফ, যেটার আশ্চর্য ধর্ম দেখে বিজ্ঞানীরা হতবাক। প্রসঙ্গত, এই পদ্ধতিটার নাম Ball-milling। এর আগে এই পদ্ধতিতে অন্য পদার্থের অনিয়তাকার রূপ তৈরি করা হলেও এতদিন কেন বরফের মতো একটা পরিচিত জিনিসকে নিয়ে কাজটা করে দেখা হয়নি এটা ভেবে ওঁরা যারপরনাই বিস্মিত। এই নতুন ধরনের বরফের ওঁরা নাম দিয়েছেন ‘Medium density amorphous ice’ বা MDA। এর বাংলা বলা মুশকিল। তবে এই বরফের ঘনত্বের মান অনেকটা জলের মতোই। এর আগে এইরকম গুঁড়ো বরফ যখন তৈরি হয়েছিল, তার ঘনত্ব দাঁড়িয়েছিল হয় বরফের চেয়ে কম বা বেশি। এবারে সেটা প্রায় সমান। এর আরও একটা অবাক-করা ব্যাপার— এক গ্লাস জলে যদি এই বরফ কিছুটা ফেলে দেওয়া হয়, ঘটবে এক আশ্চর্য ঘটনা। টুকরোগুলো ডুববেও না, আবার ভেসেও থাকবে না। সেগুলো জলের মধ্যে ওঠানামা করতেই থাকবে, তবে প্রতিবারে আলাদা-আলাদা পথে।
আরও পড়ুন: কমরেড! মুখ ঢাকুন লজ্জায়
কম্পিউটার স্টিমুলেশন
নতুন ধরনের বরফ তৈরির পরের কাজ ওই বরফের অণুর গঠন ঠিক কীরকম, সেটা বোঝবার জন্য তার কম্পিউটার চিত্র তৈরি করা। এর নাম ‘কম্পিউটার স্টিমুলেশন’। এতে কম্পিউটারের পর্দায় বাস্তবের মতো নতুন ধরনের ওই বরফের চিত্র তৈরি করে নিয়ে তার বিভিন্ন ধর্ম অনেক ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়। ওইভাবেই জানা গিয়েছে যে এই বরফ আর তরল জলের আণবিক গঠনে রয়েছে বেশকিছু মিল। যেমন দুটোর মধ্যেই অণুর গঠন এলোমেলো, অনিয়মিত।
আজব বরফের আরও কিছু অনিয়ম
এছাড়া এই বরফের আরও একটি চরিত্র সামনে এসেছে ওঁদের। দেখা গিয়েছে যে এই বরফকে যখন চাপ প্রয়োগ করে কিছুটা গরম করা হয় (মাইনাস ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে), তখন ওই বরফ আবার কেলাসিত বা ক্রিস্ট্যালাইজড হয়ে সাধারণ বরফে পরিণত হয়। আর ওর থেকে বেরিয়ে আসে কিছুটা তাপ। এমনিতে আমরা জানি যে জল যখন বরফ হয় তখন সে কিছুটা লীনতাপ বাইরে বের করে দেয়, যেটা তাকে তরল থেকে কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে। এই হিসেবে ওই অনিয়তাকার বরফ আরও একদিক থেকে জলের সঙ্গে মিল দেখাল।
শেষে যেটা বলবার, ওঁরা জানাচ্ছেন যে এই ধরনের বরফের অস্তিত্ব রয়েছে ভিনগ্রহের উপগ্রহগুলিতে। যেসব গ্রহ গ্যাসীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি (যেমন বৃহস্পতি বা শনি), সেগুলির বরফে ঢাকা উপগ্রহগুলিতে পাওয়া যেতে পারে এই ধরনের বরফ। আগামী দিনে এই ধরনের উপগ্রহে যদি মহাকাশযান পাঠিয়ে সেখানকার নমুনা সংগ্রহ করে আনা হয়, তবে তাকে বিশ্লেষণ করতে এই বরফের ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান বিজ্ঞানীদের কাজে লাগবে। সব মিলিয়ে এই বিশেষ ধরনের বরফ আবিষ্কার হওয়াটা বিজ্ঞানীদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে গেল। এর থেকে আরও কী ধরনের আবিষ্কার আগামী দিনে বেরিয়ে আসে ওঁদের হাত ধরে, সেদিকে আমাদের অবশ্যই নজর থাকবে।