কমরেড! মুখ ঢাকুন লজ্জায়

বাংলার মানুষের মনে সাঁইবাড়ি থেকে কান্দুয়া, নন্দীগ্রাম থেকে নেতাই, কোনও স্মৃতিই বিস্মৃতির আস্তাকুঁড়ে জমা পড়েনি। দগদগে সেই ঘা, একবার ফিরে দেখছেন উত্তর বারাকপুর পুরসভার কাউন্সিলর শ্রীপর্ণা রায়

Must read

গণহত্যা আর সিপিএম (Genocide- CPM) এই বাংলায় প্রায় সমার্থক। সত্তরের সেই যুক্তফ্রন্টের আমলে ক্ষমতার শরিক হয়েই গণহত্যায় হাত পাকানো শুরু বর্ধমানের সাঁইবাড়ি গণহত্যা দিয়ে আর শেষ দক্ষতার শীর্ষে থেকে ক্ষমতার বিদায় লগ্নে পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতাই গণহত্যার মাধ্যমে! মাঝের সময়টা মরিচঝাঁপি, বিজন সেতু, কান্দুয়া, বানতলা, কেশপুর, ছোট আঙারিয়া, নানুর, ধর্মতলা, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস বহন করছে সিপিএমের গণহত্যার পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার চূড়ান্ত প্রদর্শন। ভারতবর্ষের মতো গণতান্ত্রিক দেশে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠ থাকার জন্য, মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য গণহত্যার মতো নৃশংস নির্মম পথ অবলম্বন করতে পারে— এটা ভাবা কষ্টসাধ্য হলেও এটাই নির্মম বাস্তব, এটাই চির সত্য। আর সেই রক্তস্নাত পিচ্ছিল অভিশপ্ত পথ বেয়েই যে তাদের মহাশূন্যের পথে অন্তর্জলি যাত্রা এটাও বাংলার মাটিতে সর্বজনীন উপলব্ধি। এ বাংলার মানুষের মনে যতদিন সাঁইবাড়ির মাকে ছেলের রক্তমাখা ভাত খাওয়ানোর স্মৃতি অমলিন থাকবে, যতদিন মরিচঝাঁপির নেতাজিনগরের অশক্ত মাকে‌ তাঁর ছোট্ট সন্তানের সামনে ধর্ষণ করে খুন করার স্মৃতি ধূসর না হবে, যতদিন বিজন সেতুর ওপর চোদ্দোজন আনন্দমার্গীকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্মম স্মৃতি মনে গেঁথে থাকবে, যতদিন অনিতা দেওয়ানকে ধর্ষণ করে তাঁর যৌনাঙ্গে টর্চ ঢুকিয়ে তাঁকে হত্যা করার ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করবে, যতদিন কান্দুয়ার গরিব ভাইদের হাতের কব্জি কেটে নেওয়ার মতো অমানবিক নৃশংসতা মনের গভীরে বাসা বেঁধে থাকবে, যতদিন কলকাতার রাজপথে তেরোজন যুবককে গুলি করে মেরে ফেলার ভয়াবহ স্মৃতি জীবন্ত থাকবে, যতদিন কেশপুর, ছোট আঙারিয়া, নানুর, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর ও নেতাইয়ের গরিব মানুষগুলোর রক্তাক্ত নিথর দেহগুলোর ছবি চোখের সামনে ভাসবে ততদিন এ বাংলার মাটিতে সিপিএমের কোনও ক্ষমা নেই, কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই, কোনও দয়ামায়া, করুণা কিচ্ছু নেই।‌ এ রাজ্যে ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু সিপিএম শেষ ইজ্জতটুকু কখনও বিজেপিকে দান করে, কখনও কংগ্রেসকে দান করে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা করছে। এছাড়া কিছু করার নেই এই রাজ্যের সিপিএমের (Genocide- CPM)।

কিন্তু কে বোঝাবে ওদের এই অমোঘ ভবিতব্য! ঘুরে দাঁড়ানোর মাতাল নেশায় ওরা এতটাই বিভোর যে সাগরদিঘিতে জোট শরিক কংগ্রেস জেতার পর পাড়ায় পাড়ায় আবার কাঁধে ঝোলা আর মাথায় টুপি পরে হার্মাদগুলো‌চলতে ফিরতে শুরু করে দিয়েছে আর সুযোগ পেলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালি দিচ্ছে। ওরা আবার ভুলে যাচ্ছে সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি থেকে ২১ জুলাই হয়ে নেতাই, একের পর এক গণহত্যার হিসেব যদি ক্ষমতায় বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিতে চাইতেন তাহলে আজ এরাজ্যে একটা কমরেড হার্মাদের বাড়িও আস্ত থাকত না, একটা হার্মাদের পক্ষেও সম্ভব হত না আস্ত হাঁটু নিয়ে চলাফেরা করার। নিজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সিপিএমের অসংখ্য ‘ভালবাসা’র অসহনীয় যন্ত্রণা প্রতি মুহূর্ত বয়ে নিয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ দিয়ে একবারের জন্যও পরিবর্তনের আগে কিংবা পরে হিসেব বুঝে নেওয়ার কথা বেরোয়নি! গণহত্যা, গণধর্ষনের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াটাও লজ্জার মাথা খেয়ে এই সিপিএম বেশ ভাল করায়ত্ত করেছে। ইতিমধ্যে কান্দুয়া গণধর্ষণ ও গণহত্যা, নন্দীগ্রাম গণহত্যা ও নেতাই গণহত্যার দায় স্বীকার করে বুদ্ধবাবু ও সূর্য মিশ্র প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন কিন্তু বাংলার মানুষ তাঁদের ক্ষমা করেননি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার আগে গোপনে সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন কি না সেটা অবশ্য এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। মরিচঝাঁপি, ও ২১ জুলাইয়ের গণহত্যার সব প্রামাণ্য নথি জ্যোতি বসু বেশ দক্ষতার সঙ্গেই লোপাট করে দিতে পেরেছিলেন। আর বানতলার বিচারের ভাগ্য জ্যোতি বসুর সেই অসাধারণ উক্তি— ‘‘এরকম ঘটনা তো কতই ঘটে”‌-র সঙ্গে সঙ্গেই নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিলো। বাকি গণহত্যাগুলোর মধ্যে নেতাই গণহত্যা (Genocide- CPM) মামলায় নয়জন নিরস্ত্র গ্রামবাসী খুনের তদন্তের চার্জশিটে দোষী অভিযুক্ত সিপিএমের বিনপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে সহ ১৯ জন সিপিএম নেতা-কর্মী গ্রেফতার, বিচার প্রক্রিয়া চলছে।

আরও পড়ুন: দেউলিয়া হওয়ার পথে ক্রেডিট সুইস ব্যাঙ্ক তীব্র আতঙ্ক ইউরোপে

নন্দীগ্রাম গণধর্ষণ এবং গণহত্যা মামলায় ১৪ জন গ্রামবাসী খুন এবং অসংখ্য গণধর্ষণের তদন্তের চার্জশিটে সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠ, অমিয় সাহু, অশোক গুড়িয়া সহ ৮৮ জন সিপিএম নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, অনেকেই জামিনে বাইরে আছেন, বিচার চলছে। সিঙ্গুরের তাপসী মালিক গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্তে তৎকালীন সিঙ্গুর জোনাল কমিটির সম্পাদক সুহৃদ দত্ত এবং সদস্য দেবু মালিক গ্রেফতার হন। নিম্ন আদালতের রায়ে দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্ত, বিচার প্রক্রিয়া চলছে। ছোট আঙারিয়া গণহত্যা মামলায় ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খুনের ঘটনার তদন্তে সিবিআই চার্জশিটে অভিযুক্ত সিপিএম নেতা তপন, সুকুর গ্রেফতার। প্রথমে এদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া ১৬ জন প্রত্যক্ষদর্শী পরে আদালতে বিরূপ হওয়ায় বিচারের শ্লথ গতি। অবশেষে ঘটনার মুল অভিযুক্ত দিল মহম্মদ গ্রেফতার হওয়ায় আবার বিচার প্রক্রিয়ায় গতি পেয়েছে। নানুর গণহত্যা মামলায় তৃণমূল সমর্থক ১১ জন ভূমিহীন গ্রামবাসীকে খুনের ঘটনায় সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদকসহ ৪৪ জন সিপিএম নেতা-কর্মী আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত। আদালত প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। কেশপুর গণহত্যা এবং কঙ্কাল-কাণ্ড‌ মামলায় অসংখ্য তৃণমূল কর্মী-সমর্থক খুনের ঘটনায় ২০১১ সালে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর কেশপুর, গড়বেতা জুড়ে একের পর এক মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার‌ হয় এবং তদন্তে মূল অভিযুক্ত প্রাক্তন সিপিএম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ গ্রেফতার হন। দীর্ঘদিন হাজতবাসের পর বর্তমানে জামিনে বাইরে আছেন, বিচার প্রক্রিয়া চলছে।

রক্তের হোলি খেলায় ৩৪ বছর ধরে বাংলাকে রক্তাক্ত করেও যাদের পিপাসা মেটেনি সেই সিপিএম (Genocide- CPM) আবার নতুন করে শান্ত বাংলাকে অশান্ত করতে চাইছে। মানুষের রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তারা দাঙ্গার মুখ বিজেপি এবং ৭২-৭৭ সালের চরম অরাজকতার নায়ক কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে এক অদ্ভুত জোট তৈরি করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আঁচলের তলায় লুকিয়ে আবারও বাংলার বুকে সেই গণহত্যার, গণধর্ষণের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। জননেত্রীর বিরল রাজনৈতিক সৌজন্যের নির্মম পরিহাসে আজ সামান্য সুযোগেই নিজেদের বিষাক্ত নখগুলি বের করে ফেলছে গণহত্যাকারী হায়নারা।
তবে বঙ্গবাসী সুদীর্ঘ এই রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে এসে পরিবর্তনের খোলা হাওয়ায় যে নির্মল নিশ্বাস নিচ্ছেন তা পরিত্যাগ করে আবার সেই পুরনো রক্তাক্ত দমবন্ধ করা গণহত্যা আর গণধর্ষণের ‘গণতন্ত্রের’ রাস্তায় ফিরে যে যাবেন না, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

Latest article