সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে নির্ঘাত লিখতেন, ‘‘মোদি বাবাজী শাসিত দেশে / হিসাবপত্র সর্বনেশে / ব্যারেলের দাম যদি একটু বাড়ে/ প্রচুর টাকা মাশুল ধরে / আর যদি দাম নিচেও যায়/ খুঁচিয়ে বাড়িয়ে টাক্স চাপায় / খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়/ অশ্রু ঝরায় একশো বার।”
লিখতেনই, কারণ পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি তেলের দাম।
আরও পড়ুন-কলকাতার প্রথম থিমশিল্পী বন্দন রাহার রহস্যমৃত্যু
পেট্রোল-ডিজ়েলের দাম কিছুতেই এদেশে কমে না। কারণ জানতে চাইলেই এত দিন মোদিবাবুর মোক্তাররা বলতেন একটাই কথা। বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দর বড্ড চড়া। দেশের বাজারে তাই দাম না বাড়িয়ে কোনও উপায় নেই।
আমরা, এদেশের হতভাগ্য নাগরিকরা, সেই অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার বুলি শুনে বুঝতাম, আমাদের মোদিবাবুর সদিচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় নেই। বিশ্ব বাজারের ওপর তো আর মোদি-শাহ-নির্মলাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই! সুতরাং, জ্বালানির দাম কমবে কীভাবে?
গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকে। ব্যারেল প্রতি পৌঁছে যায় ১৩৯ ডলারে। সত্যিই তো। কিস্যু করার ছিল না মোদিবাবুদের।
আরও পড়ুন-ভৌমবতী অমাবস্যায় তারাপীঠে চলছে মহাপুজো
কিন্তু গত সোমবার সেই ব্রেন্ট ক্রুড সোমবার এক সময় নেমেছিল ৭১ ডলারের নিচে। চাকা উল্টো দিকে ঘুরছে। তেলের দাম সেই সময়ের প্রায় অর্ধেক। সোমবার রাতে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ৭২ ডলারের আশেপাশে। আর এক অশোধিত তেল ডব্লিউটিআই-এর ব্যারেলের দাম কমতে কমতে ঠেকেছে ৬৬.৪৬ ডলারে। অথচ গত প্রায় ১০ মাস ধরে দেশে তেলের দাম স্থির।
ওই যে, বলছি না। মোদি জমানায় সবই উলটো। বাড়লে বাড়ে, কিন্তু কমলে কমে না। এই জমানায় তেলের এমনই বিচিত্র গতি।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টে ফের পিছলো DA মামলার শুনানি
তেলের চড়া দরের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা যখন তা বিদেশে রফতানি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছিল, তখন গত জুলাইয়ে সেই পড়ে পাওয়া মুনাফায় কর (উইন্ডফল ট্যাক্স) বসিয়েছিল কেন্দ্র। অশোধিত তেল ৭৫ ডলারের উপরে থাকলে সংস্থাগুলির বাড়তি মুনাফা হয় ধরে সেই করের হিসাব কষা হয়। তেলের দাম কমায় সেই করের হারও এখন সর্বনিম্ন। কেন্দ্র সংস্থাগুলির উইন্ডফল কর কমিয়েছে। কিন্তু তেলের দাম কমার সুফল সাধারণ মানুষের পকেট পর্যন্ত পৌঁছয়নি। ভারতের তেলের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করতে হয়। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম যেমন কমেছে, তেমনই এই আমদানিকৃত তেলের ৩৫% এখন রাশিয়া থেকে আসছে। যে দাম ৬০ ডলারের আশেপাশে। ফলে তেলের আমদানি খরচও কমাতে পেরেছে ভারত। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে, তার সুবিধা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া না গেলে লাভ কার?
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনা: টানা দুদিন ধর্নায় বসবেন মুখ্যমন্ত্রী
জিনিসের দাম হু-হু করে বাড়ছে। সুদ বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধিতে যে রাশ টানা যাচ্ছে না সেটা পরিষ্কার। এই অবস্থায় তেলের দাম কমানো এর বিকল্প রাস্তা হতে পারে। তাতে জিনিসপত্রের দাম কমবে। সাদাবুদ্ধি বলে, মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে তেলের দাম ছাঁটাই। বিশেষত খাদ্য-সহ অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ যেহেতু দামি জ্বালানি। বিশ্ববাজারে অশোধিত তেল সস্তা হয়েছে। ফলে দেশেও দাম কমানোর সুযোগ এসেছে। এর সদ্ব্যবহার করা উচিত। সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমানো যায়। কিন্তু ভারতে মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ ছিল জোগানের অভাব। এই অবস্থায় সুদ বাড়াতে গিয়ে আর্থিক অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার মুখে।
আরও পড়ুন-ইডেনে প্রস্তুতি শুরু করল কেকেআর
সোজা কথায়, ভারতে মূল্যবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক ভাবে চড়া থাকার অন্যতম কারণ পেট্রোল-ডিজ়েলের অতিরিক্ত দাম। যা সরাসরি ভোগ্যপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণ। বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম এখন নিম্নমুখী হলেও দেশে পেট্রোপণ্যের দাম কমেনি।
সুদ বাড়িয়ে সবসময় মূল্যবৃদ্ধিকে যে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না তা প্রমাণিত। এতে আর্থিক বৃদ্ধি শ্লথ হয়, সেটাও সবাই জানি। এ-ক্ষেত্রে জোগান বৃদ্ধির পাশাপাশি পেট্রোপণ্যে করের হার কিছুটা কমালে তা মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে সাহায্য করবে।
কিন্তু মোদিবাবুদের কানে ও জ্ঞানে কি সেকথা প্রবেশ করবে?