সাতের দশকের বিশিষ্ট কবি সুজিত সরকার। অধ্যাপনা করতেন। সম্পাদিত পত্রিকা কবিকৃতি। কবিতার পাশাপাশি কবিতা-বিষয়ক গদ্য লেখেন। আলোচক হিসেবে সমাদৃত। ছোঁয়া থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘কবিতা সংগ্রহ’। এই সংকলনে স্থান পেয়েছে গত চার দশকে লেখা ১৫টি কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
আরও পড়ুন-রবিবার কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা
ভূমিকায় কবি লিখেছেন, ‘কবিতা লিখে কী হয়?— নিজেকে নিরন্তর এই প্রশ্ন করেছি। অবশেষে একদিন নিজের ভিতরে উত্তর পেয়েছি : হয়ে-ওঠা হয়, ভিতরে ভিতরে হয়ে-ওঠা হয়।’ বিশ্লেষণ ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। কবিতার অন্তবিহীন পথ। কেউ কেউ যথার্থই হয়ে উঠতে পারেন, কেউ কেউ ব্যর্থ হন।
নির্ভার কবিতা লেখেন এই কবি। তাঁর কবিতায় দেখা যায় না অপ্রয়োজনীয় কথার আধিক্য, অতিরিক্ত শব্দের ভার। প্রায় প্রতিটি কবিতাই নিঃশব্দ কবিতা। অতি মাত্রায় বিনীত, মার্জিত। উচ্চারিত হয় নিচু স্বরে। মন অস্থির হয়ে উঠলে তাঁর কবিতায় ছায়ায় দু-দণ্ড বিশ্রাম নেওয়া যায়। চোখ রাখা যাক কয়েকটি কবিতায়।
আরও পড়ুন-এপ্রিলেই মুখ্যমন্ত্রীর দিঘা সফর
‘ধরে রাখতে চাই’ প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কবিতা ‘বেদনার অন্ধকারে’। কবি লিখেছেন:
‘বেদনার অন্ধকারে দেখেছি তোমার চোখ জেগে আছে/ নক্ষত্রের উচ্ছ্বলতা নিয়ে।/ সুখ শুধু জীবনের বৃত্তটিকে ছোট করে আঁকে,/ জীবন অনেক বড়— এই সত্য দুঃখের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে/ বারবার টের পাই।’
গভীর উপলব্ধির কবিতা। উল্লেখ করা হয়েছে যে চোখের, সেই চোখ অশ্রুসিক্ত। তীব্র বেদনাজাত। চিকচিক করে নক্ষত্রের মতো। স্পষ্ট হয় নীরব আঁধারে। বলা হয়েছে ‘সুখ শুধু জীবনের বৃত্তটিকে ছোট করে আঁকে’। কেন এই উচ্চারণ? কারণ সুখ ক্ষণস্থায়ী। সুখের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে অকারণ স্বার্থপর করে তোলে, ছোট করে তোলে। এ-ও জানা, দীর্ঘ দুঃখই বাড়িয়ে দেয় সুখের প্রাবল্য। এটাই হয়তো বলতে চেয়েছেন কবি। উৎসবপ্রিয় মানুষও নিরিবিলি খোঁজে। মাঝেমধ্যে একা হতে চায়। এই ভাবনা থেকেই পরবর্তী অংশে লিখেছেন : ‘বেঁচে থাকতে হলে এই নিরিবিলি অন্ধকার/ প্রয়োজন হয় মানুষের।’ কবিতাটি চুম্বকের মতো। টেনে রাখে। বাধ্য করে অন্য কবিতায় যেতে।
আরও পড়ুন-হলদিয়া মেচেদা রাজ্য সড়কে পথ দুর্ঘটনা, আহত ২৭
‘বড়ো আকাশের নীচে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘আমার আত্মা’। প্রথম পঙক্তি : ‘অন্ধকারে জেনেছি নিজেকে।’
এই ভাবনার প্রকাশ দেখা গেছে নানা কবিতায়। কবি আলোর বিপরীতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অতিরিক্ত আলো সাধনার অন্তরায়। তাই চান নিভৃত অন্ধকারে মগ্ন থাকতে, নিজেকে জানতে।
এগিয়ে যাওয়া যাক আরও একটু। কবি লিখেছেন :
‘দুই স্তবকের মধ্যবর্তী শূন্যতাও/ যেমন কবিতা, তেমনই/ আলোয়-অন্ধকারে/ অদৃশ্য আমার আত্মা—/ সময়ের ক্ষয়ক্ষতি পেরিয়ে এসেও/ আজো বিশুদ্ধ, নির্ভার।’
যথার্থ। কিছু বলা যেমন কবিতা, পাশাপাশি না-বলাও তুমুল কবিতা। আলোচ্য কবির কবিতা শূন্যতার ভাষার মতো। নির্মল, অচঞ্চল, বিশুদ্ধ। মন্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়।
আরও পড়ুন-ঘরে বসেই এবার কাটুন মেট্রোর টিকিট
‘আকাশ আরো আকাশ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘বৃত্ত’। কবি লিখেছেন : ‘স্থির হতে হবে।/ যে স্থির, সে নিজেও জানে না/ সে কখন একদিন কেন্দ্র হয়ে যায়।’
ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল। অথচ কী গভীর। সমস্ত চঞ্চলতাই স্থিরতা দাবি করে। কারণ স্থিরতাই চূড়ান্ত সত্য। কবিতার এই ‘কেন্দ্র’ কি তাহলে মৃত্যু? কারণ মৃত্যুর মতো চূড়ান্ত সত্য দ্বিতীয়টি নেই। অবস্থান করে জীবনের কেন্দ্রে। কবিতার শেষ পঙক্তি : ‘যেখানে সমাপ্তি সেখানেই সূচনা আবার।’
উত্তরণের পথ দেখা যায়। অন্ধকারের পর যেমন আলো। সেই পথেই সমাপ্তির পর সূচনা। তাহলে কি মৃত্যুর পরে নতুন জীবন? প্রশ্ন জাগে। ভাবায়।
আরও পড়ুন-কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট নিয়ে রাজ্যপালের নির্দেশ খারিজ
‘ঘর মিথ্যা হয়ে যায়’ এক আশ্চর্য কবিতাগ্রন্থ। যা কবিকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। শুরুতেই বিভাব কবিতা : ‘দেয়াল তুললেই ঘর/ ভেঙে ফেললেই পৃথিবী।’
অল্প কথায় অনেকটা বলা। দীর্ঘ সাধনায় এই অকল্পনীয় দক্ষতা অর্জন করেছেন কবি। পঙক্তি দুটি প্রবাদ হয়ে উঠেছে। মুখে মুখে ফেরে। এই সময় থেকেই বেশি মাত্রায় নির্মেদ হয়েছে কবির কবিতা। হয়েছে সংকেতধর্মী। দেখা গেছে ছোট কবিতার প্রতি মনোযোগী হতে। টুকরো টুকরো কবিতা নিয়েই ‘কবিতাকণা’।
প্রথম সংখ্যক কবিতা : ‘ছাদে উঠে এলে/ ছাদ গৌণ হয়ে যায়,/ মুখ্য হয়ে ওঠে আকাশ, নক্ষত্র।’ এ যেন সীমা থেকে অসীমের পথে যাত্রা। তৃতীয় সংখ্যক কবিতায় দেখা যায় মৃত্যুচেতনা। কবি লিখেছেন : ‘মাথাভর্তি কালো চুলে দু-একটি শাদা—/ মৃত্যু একদিনের ঘটনা নয়,/ প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যু হয়।’
আরও পড়ুন-দুয়ারে সরকারে রাজ্যে ২ লাখের বেশি শিবির
‘শাদা’ রং এখানে বার্ধক্যের প্রতীক। বার্ধক্যের সঙ্গে মৃত্যু সমানুপাতিক। হঠাৎ নয়, মৃত্যু হয় তিলে তিলে। সেই ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি। গভীর অর্থবহ অণুকবিতা রচনায় আশ্চর্যরকমের পারদর্শিতা তাঁর। ছোট ছোট শব্দে কবিতা নির্মাণের ধারায় তিনি অননুকরণীয়।
‘আমিহীনতায়’ গ্রন্থের ‘ছাদ থেকে’ কবিতাটি পড়া যাক : ‘ওপরে আকাশ,/ অস্তগামী সূর্য,/ ঘরে-ফেরা কাক/ নিচে দোকান-বাজার,/ রিকশা-স্কুটার,/ কোলাহল/ ওপরের ছবি চিরদিন একই রকম—/ নিচের ছবিটা শুধু/ বদলে বদলে যায়।’ প্রকৃত দেখার চোখ সকলের থাকে না। আলোচ্য কবির আছে। গভীর দৃষ্টি। তাই সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে অসাধারণ। আকাশ চিরকাল এক, বদলে যায় মাটির ছবি। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ।
আরও পড়ুন-শহিদ মিনারেই সভা, চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু
আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘কারখানা সত্য, কৃষ্ণচূড়া মিথ্যা নয়’। আছে বেশ কয়েকটি মনে রাখার মতো কবিতা। ‘নিজস্বতা’ কবিতায় কবি লেখেন : ‘সকলেই গেট খুলে ঢুকি/ শব্দ হয়/ ঘরের ভিতরে বসে/ শব্দ শুনে/ মা ঠিক বুঝতে পারে/ কে এসেছে/ সকলেই যে যার মতো গেট খুলি।’ আপাতভাবে কবিতা লাগে না। অথচ গভীর উপলব্ধির কবিতা। ছত্রে ছত্রে ঘটেছে সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ। লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক দর্শন : নিজস্বতা আছে সকলের। অন্যেরা বোঝে না। প্রতিটি তফাত মা শুধু বোঝে।
‘কণা কণা’ এবং ‘আমার অল্পই কথা’ কাব্যগ্রন্থে রয়েছে অসামান্য কিছু অণুকবিতা। একটি তুলে ধরা যাক : ‘জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে বিছানায়—/ টিউবের সাদা আলো/ নিভে গেলে বোঝা যায়।’
আরও পড়ুন-বার্সেলোনায় খেলেই মেসি অবসর নেবে, দাবি আগুয়েরোর
এমন কবিতা বড় বেশি মগ্নতা দাবি করে। এ-ছাড়াও আছে ‘আমি মাটি আমিই আকাশ’, ‘কেন এই জন্ম’, ‘অজানায় শুরু, না-জানায় শেষ’, ‘হয়তো আছি হয়তো নেই’, ‘জয় নেই, পরাজয় নেই’, ‘কিছুই চূড়ান্ত নয়’, ‘ঢেউয়ের পরে ঢেউ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
অসংখ্য কবিতার মধ্যে আলোচনা করা হল সামান্যই। বাকি থেকে গেল সিংহভাগ। তোলা রইল আগ্রহী পাঠকদের জন্য। এই ‘কবিতা সংগ্রহ’ পাঠ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আস্ত একটা জীবন লেখেন সুজিত সরকার। তিনি শুধুমাত্র কবি নন, একজন দার্শনিক। তাঁর কবিতা মোমবাতির আলোর মতো। স্নিগ্ধ, পবিত্র। পাঠ করলে মনের আরাম হয়।