পাঁচের দশকের বিশিষ্ট কবি সুধেন্দু মল্লিক। কর্মজীবনের শুরুতে ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক। অবসর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে। তিনি কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের পৌত্র। বাল্যকাল কেটেছে পিতামহের স্নেহছায়ায়, উজানি-কোগ্রামে, অজয় নদের তীরে। আত্মকথায় বলেছেন, ‘‘উনি আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন গ্রামের গাছপালা, মঙ্গলচণ্ডীর সুগন্ধময় মন্দির, কবি লোচন দাসের ভিটা, নদীগর্ভে খুঁজে পাওয়া দেবদেবীর মূর্তি, মাঠভরা শস্য, গ্রামের পথ, পুষ্করিণী, অজয় ও কুনুর নদীর প্রবহমান জলস্রোত ও অবারিত আকাশ।” আরও বলেছেন, ‘‘আজ মনে হয় পিতামহ আমাকে কবিতা লেখাকেও ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।”
আরও পড়ুন-রোহিতকে আজ জয় উপহার দিতে চায় মুম্বই, অধিনায়ক হিসেবে ১০ বছর পূর্ণ
সম্প্রতি সারঙ্গ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি সুধেন্দু মল্লিকের কাব্যসংকলন ‘কবিতা মঞ্জুষা’। এই সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর ১৩টি কাব্যগ্রন্থের কবিতা। এক কাব্যগ্রন্থ থেকে অন্য কাব্যগ্রন্থে যেতে যেতে মনে হয়েছে, ক্রমশ বদলেছে কবিতার ভাষা। বদল ঘটেছে উচ্চারণে। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ কবিতা বহমান। নদীর মতো। বাঁকে বাঁকে বদল। যত দিন যায়, হয় আরও পরিশীলিত। এই কথা প্রযোজ্য যে-কোনও কবির ক্ষেত্রে। যাওয়া যাক আলোচ্য সংকলনের কয়েকটি কবিতায়।
আরও পড়ুন-আজ জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা
‘হিরন্ময় অন্ধকার’ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা ‘হিরন্ময় অন্ধকার’। শুরুটা এইরকম : ‘বহুকাল অদর্শন। বহুদিন পাইনি কুশল।/ আজ এই দ্বারপ্রান্তে বাতাসের স্পর্শে সম্ভবত/ এ প্রদেশে যত ছায়া তারা সব একদা স্বচ্ছল/ অনুরাগ গ্রাস করে সন্ধ্যানামে দেশান্তরে গত।’
প্রতীক্ষায় কেটে যায় দিন। কার প্রতীক্ষায়? উল্লেখ নেই। তবে এই প্রতীক্ষা অনন্ত। রয়েছে বহুকাল অদর্শনে চিন্তা, কুশল জানার ব্যাকুলতা। ‘অনুরাগ’ শব্দের প্রয়োগ বুঝিয়ে দেয় এই অপেক্ষা কোনও এক বিশেষ নারীর কারণে। সেই নারী প্রেয়সী হতে পারেন, অথবা ঈশ্বরী।
পরমুহূর্তেই কবি বলছেন : ‘বিষাদপ্রবণ আত্ম অভিমানে অজ্ঞাত সোপান/ নিম্নগামী; তোমারে দেখিতে প্রাণে বড় সাধ হয়—/ হয়তো দেখিতে চাই আরো দীর্ঘ পশ্চাৎ উদ্যান,/ ভালোবেসে রজত সন্নিভ শুভ্র কুসুম নিচয়।’
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
অংশটিতে লুকিয়ে রয়েছে তুমুল প্রেম। যদিও এই প্রেম একপক্ষের। স্পষ্ট হয়েছে তীব্র আকুলতা। বিষাদবিধূর মন ডুবে রয়েছে অভিমানে। এই অভিমান বিশুদ্ধ নর-নারীর অভিমান। অন্ত্যমিলের প্রয়োজনে এলেও ভাল লাগে ‘নিচয়’ শব্দের প্রয়োগ। রয়েছে আরও কয়েকটি পঙ্ক্তি। তোলা রইল আগ্রহী পাঠকদের জন্য। এটুকু বলা যায়, কবিতাটি গভীর অর্থ বহন করে। ভাবায়। বিস্ময় জাগায়।
‘সমস্ত অসুখে’ কবিতায় দেখা যায় সুরমা নামে এক নারীর উপস্থিতি। তাঁর জন্য চোখে পড়ে অস্থিরতা। হারানোর ভয়। কবি লেখেন : ‘ওরা কি নিয়েছে ডেকে তোমাকেও! সুরমা! সুরমা!/ তুমি সাড়া দিয়েছ তখনি/ যে জানলা খুলে দিলে চিররাত্রি আলোয় উধাও/ সুরমা আচমকা সেই জানলা খুলে দাও।’
প্রেম মনে হতে পারে। অথচ শেষ দুই পঙ্ক্তি জানান দেয়, কবিতায় ফুটে উঠেছে আশ্চর্য মৃত্যুচেতনা। রয়েছে বীভৎস মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আনন্দ।
আরও পড়ুন-দিনের আলোয় কলকাতা শহরের বুকে সেই গণহত্যার স্মৃতি ফেরাল ৩০ এপ্রিল
‘বৃষ্টিকে করেছো বৃষ্টি’ কাব্যগ্রন্থে আছে নানা বিষয়ের কবিতা। ‘করতলের ভিক্ষা’য় কবি লেখেন : ‘ধুলোর সঙ্গে ধুলো হয়ে মিশে দেখেছি/ ধুলো আমার হওয়া হবে না।/ ধুলোয় বড় আঘাত লাগে।’
নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি। ‘ধুলোয় বড় আঘাত লাগে’ মনে করায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,/ আমার লাগছে।’
পাওয়া না-পাওয়ার দোলাচলে আলোচ্য কবি দুলতে থাকেন। মস্ত বাড়ি বানাতে চান ঘরছাড়া স্বভাব দিয়ে। ‘ইচ্ছে’ কবিতার শেষ তিনটি পঙ্ক্তি পড়ে নেওয়া যাক : ‘সত্যি কি আমার বাড়ির খুব দরকার? না হলেও চলে।/ হয়তো ওই সামান্য আলসেমিটুকুর জন্যেই/ তোমাকে পাওয়া আটকে যাচ্ছে।’
এই না-পাওয়ার মধ্যে যতটা আনন্দ আছে, ততটা হয়তো পাওয়ার মধ্যে নেই। তাই হয়তো গাওয়া হয়েছে আলসেমির জায়গান। এই ভাবনা পুরোপুরি ছকভাঙা। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, কবি যেন নিজের সময়ের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে।
আরও পড়ুন-রুশ হামলায় রক্তাক্ত ইউক্রেন মৃত ২৬, জখম বহু
‘কেয়াকে সর্বস্ব’ এক আশ্চর্য কাব্যগ্রন্থ। পূর্বে ইঙ্গিত থাকলেও, এই পর্বে এসে কবির আধ্যাত্মিক চেতনা প্রবলভাবে বিকশিত হয়। ‘মাঝে মাঝে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ’, ‘ঈশ্বরের জন্যে গান’, ‘তুমিই ধর্ম’ ‘অতৃপ্ত ঈশ্বর’ কবিতাগুলো তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ‘বেদ আমাকে’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি : ‘বেদ আমাকে এক ধরনের উপাসনায় ব্যস্ত রাখছে।’ শেষ পঙ্ক্তিতে বলছেন : ‘বেদ আমাকে এক ধরনের ভালোবাসায় ব্যস্ত রাখছে।’ অর্থাৎ তাঁর কাছে উপাসনা এবং ভালবাসা অভিন্ন। যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটার মধ্যে পেয়ে যান অন্যকে। তাহলে কি আধ্যাত্ম ভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে প্রেম? প্রশ্ন জাগে।
‘সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ’ কাব্যগ্রন্থের সিংহভাগ কবিতায় মিশে রয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনা। মূলত শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিবেদিত। কবি দাঁড় করান এক নতুন জীবনবোধের সামনে। ‘প্রজ্ঞার গোপাল’ কবিতায় তিনি লেখেন : ‘মনে রেখো সব সত্যি হয়।/ দুঃখ ভ্রম শোক হতে উঠে আসে আত্মার বিস্ময়।/ এই আমি! কি আনন্দ!/ এই আমি এমন সুন্দর/ বৃষ্টির ধারার মতো সমর্পিত/ শান্ত অনুত্তর।’
আরও পড়ুন-কুস্তিগিরদের পাশে বাইচুং-সানিয়াও
যথার্থ বলেছেন কবি— ‘সব সত্যি হয়’। সত্যি হয় তবেই, যদি বিশ্বাস থাকে। সেই বিশ্বাস হয়তো ঈশ্বরে বিশ্বাস। নিজের প্রতি বিশ্বাস অটুট থাকলেই নিজে সুন্দর। মনের মধ্যে বৃষ্টিধারার মতো ছড়িয়ে পড়ে আনন্দ। কবিতাটি নিয়ে যায় ভাবনার এক অন্য স্তরে।
আধ্যাত্মিক চেতনা ফুটে ওঠে ‘পতিত পৌত্তলিক’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতায়। আছে সমর্পণ, আছে ছদ্ম উপেক্ষা। মাঝেমধ্যে ঘটে যায় ঈশ্বরের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ। প্রকাশভঙ্গি বড়বেশি আধুনিক। ‘সেই কি ঈশ্বর’ এক অনবদ্য কবিতা। কবি লিখেছেন : ‘অন্তরে যে পোড়ে/ শান্ত শর্তহীন সে কি ঈশ্বর!/ নাকি যে পোড়ায়!’ মনের গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসা এক প্রশ্ন। মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্বার্থযুক্ত। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্বার্থহীন, শর্তহীন। ছোট্ট পরিসরে সুন্দরভাবে বিষয়টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘শান্ত শর্তহীন’ প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে।
আরও পড়ুন-তদন্তে আরও ৬ মাস সময় চাইল সেবি
‘শুধু শব্দ শুধু অপেক্ষা’, ‘ধন্যবাদ অশেষ ধন্যবাদ’, ‘এই সবই আমার কবিতা’, ‘মেঘে আশ্বিন হাওয়ার জন্মদিন’, ‘এইতো পাওয়া : ভীষণ পাওয়া’, ‘পুষ্পিত ধিক্কার’, ‘শেষ জানালায়’, ‘দেরী হবে রে… তোর গায়ে এখনো সংসারের গন্ধ’ কাব্যগ্রন্থগুলোও নিবিড় পাঠ দাবি করে। পাতায় পাতায় আলো ছড়িয়েছে প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিক চেতনা। কোনও কবিতায় রয়েছে নিখুঁত ছন্দ, কোনও কবিতা ছন্দহীন। সবমিলিয়ে এ এক আশ্চর্য সংকলন। মুগ্ধতা জাগায়। একজন সাধক কবিকে চিনতে সাহায্য করে। এমন একজন কবি, যিনি অন্তরালপ্রিয়, বহু পঠিত নন। একটি প্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাতে হয় সংকলনের দুই সম্পাদক সুজিত সরকার এবং সাতকর্ণী ঘোষকে। কবিতাই বহন করে কবির পরিচয়। তবু এই কাব্যসংকলনে কবি সুধেন্দু মল্লিকের একটি সচিত্র পরিচিতি থাকলে উৎসাহী এবং নতুন প্রজন্ম উপকৃত হত। সৈকত নায়েকের প্রচ্ছদ প্রশংসার দাবি রাখে।