হারমনি

জলসার আসর থেকে বিবাহবাসর— আজও অপরিহার্য সে। গিটার, সিন্থেসাইজারের যুগেও অপ্রতিরোধ্য। শিক্ষানবিশ থেকে নামজাদা— সকলকেই বেঁধে রাখে এক সুরে। সেই হারমোনিয়াম তৈরির বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’ পার করল একশো বছর। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সমাদৃত পাকড়াশিদের হারমোনিয়াম। রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ইতিহাস। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

আনুমানিক ১৮৬০ সালে জোড়াসাঁকোতে স্থাপিত শখের থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম হারমোনিয়াম বাজান। যতদূর জানা যায়, ভারতবর্ষে এটাই প্রথম হারমোনিয়ামের ব্যবহার।
রবির আর এক দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈশবে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের তালিম নিতেন। তিনি পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম, সেতার বাজানোয় ছিলেন দক্ষ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে আর সব বাদ্যযন্ত্র ছাড় পেলেও বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মতো ব্রাত্য হয়েছিল এই হারমোনিয়াম যন্ত্রটি।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের কাছে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া, টাকা পেতে আবেদন সংগ্রহে মন্ত্রীর শিবির

রবীন্দ্রনাথের প্রাণের শান্তিনিকেতনে হারমোনিয়াম নিষিদ্ধ হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই নির্দেশে। শৈলজারঞ্জন জানিয়েছেন, ‘শান্তিনিকেতনে এসে দেখলাম হারমোনিয়ামের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ। এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ওই যন্ত্র আর ছুঁয়েও দেখিনি।’ (রবীন্দ্রসঙ্গীতচিন্তা)। শান্তিদেব ঘোষও তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন, ‘১৯২২ সাল থেকে অর্থাৎ বিশ্বভারতীর যুগ থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির ব্যবহার গুরুদেব শান্তিনিকেতনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’ কলকাতা রেডিওর তৎকালীন স্টেশন-ডিরেক্টরকে রবীন্দ্রনাথ ১৯ জানুয়ারি ১৯৪০ তারিখে লিখছেন, ‘I have always been very much against the prevalent use of Harmonium for the purpose of accompaniment in our music and it is banished completely from our Ashrama. You will be doing a great service to the cause of Indian music if you can get it abandoned from the studios of All India Radio.’ (রবীন্দ্রভাবনা, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মুখপত্র)। আকাশবাণী কলকাতা দীর্ঘদিন ব্যান করে রেখেছিল হারমোনিয়ামকে। শুধু তাই নয়, যেসব সংগীতশিল্পী আজীবন শান্তিনিকেতনেই জীবন অতিবাহিত করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন এবং স্বয়ং শান্তিদেব ঘোষ— তাঁরা কেউই যন্ত্রটি বাজাতে পারতেন না। কারণ, বাজানোর সুযোগই পাননি!

আরও পড়ুন-কবিতার শরীর জুড়ে আধ্যাত্মিক আলো

একশো বছর আগেও যার প্রচলন ছিল না সেই হারমোনিয়াম আজ কালে কালে বঙ্গজীবনের অঙ্গ। সাতসকালের টি-টেবলে চা-বিস্কুটের মতোই বাঙালি, অবাঙালির সঙ্গে তার যোগ। আরও বড় বিষয় হল, শুধু দেশে নয়, বিদেশেও হারমোনিয়ামের এখন মারাত্মক চাহিদা। এই হারমোনিয়াম যন্ত্রটিকে অবগুণ্ঠনমুক্ত করে চাহিদার বাজারে নিয়ে আসার সম্পূর্ণ কৃতিত্বের দাবিদার ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’। যার শতবর্ষ পূর্তি হল সম্প্রতি। একশো বছর মুখের কথা নয়, একটা গোটা সাম্রাজ্যের ইতিহাস লেখা হয়ে যায় একশো বছরে।
রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে মেট্রো স্টেশনের ঠিক পাশেই ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’-এর শোরুমটি তার ছোট্ট ছাপোষা চেহারার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে বহু ঐতিহ্য, স্মৃতি, সম্মান, ভালবাসা, ইতিহাসের এক লম্বা স্মরণিকা। হারানো দিনের সেইসব গল্প যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়ে যাবে যুগে যুগে। অতীতে কিন্তু এত ছিপছিপে ছিল না শোরুমটি। তখন সে পৃথুলা। শোরুমের সঙ্গেই ছিল হারমোনিয়াম তৈরির ফ্যাক্টরিও।

আরও পড়ুন-রোহিতকে আজ জয় উপহার দিতে চায় মুম্বই, অধিনায়ক হিসেবে ১০ বছর পূর্ণ

১৯২২-এ সুধীরচন্দ্র পাকড়াশি এবং তাঁর এক ভাই হেমচন্দ্র পাকড়াশি মিলে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন। লেজেন্ড পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গে সুধীরবাবুর গভীর বন্ধুত্ব ছিল তাই তিনিও জড়িয়েছিলেন এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। প্রথমে এখানে তৈরি হত গ্রামোফোন, তারপর শুরু হল হারমোনিয়াম তৈরির কাজ। সেই থেকে আজ একশো বছরের ইতিহাস গড়ল ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’।
সেই অজানাকে জানতে ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’-এর বর্তমান প্রজন্মের কর্ণধাররা হলেন বাবা সুফল পাকড়াশি এবং ছেলে শুভজিৎ পাকড়াশি। সিগনেচার ব্র্যান্ড পাকড়াশিদের এই হারমোনিয়াম যন্ত্র। যার প্রতিটা রিডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের ইতিহাস। শুধু নামী ব্যক্তিত্বদের প্রথম পছন্দের ব্র্যান্ড নয়, আসলে এটা মানুষের ব্র্যান্ড, কারণ মাস-আপিল ছাড়া যাত্রাপথে এতদিন টিকে থাকা অসম্ভব। কেন এই পাকড়াশি অ্যান্ড কোং-এর হারমোনিয়ামই শিল্পীদের প্রথম পছন্দ, কেন আলাদা এই ব্র্যান্ড? প্রশ্নের উত্তরে শুভজিৎ পাকড়াশি জানালেন, ‘‘হারমোনিয়াম যন্ত্রের ইতিহাস যদি দেখি তাহলে দেখব এটি ইউরোপিয়ান অরিজিন হলেও সবচেয়ে বেশি পপুলারাইজ হয় ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এই অংশগুলোতে। এরপর এর বিবর্তন গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে আমরা একুশটা দেশে হারমোনিয়াম এক্সপোর্ট করছি, প্রায় গোটা বারো দেশে ওয়ার্কশপ করছি। আরও অনেক সংস্থা রয়েছে যারা হারমোনিয়াম বানায়।

আরও পড়ুন-আজ জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা

তফাতটা হল আমরা শুধুই ব্যবসার জন্য ব্যবসা করতে আসিনি, পাশাপাশি গানবাজনাটাও শিখেছি। যেমন আমি ৬ বছর থেকে সেতার বাজাই, আমার ছেলে সরোদ বাজায়। আসলে একজন শিল্পী কী চাইছেন সেটা তখনই কেউ উপলব্ধি করতে পারবে যখন তিনি নিজে শিল্পী হবেন। এই বিষয়ে একটা ছোট গল্প বলি— একবার জগজিৎ সিং কলকাতায় এসেছেন, সালটা ১৯৯৮। বাবা বললেন দেখা করতে যাবেন। তাঁকে একটা যন্ত্র দেওয়ার ছিল। পরের দিন সকালে আমি তৈরি। আমরা পৌঁছলাম ওঁর কাছে। উনি এলেন। অতবড় একজন শিল্পী, আমার প্রায় বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেছিল। বাবা হারমোনিয়ামটা দিলেন। উনি আমাদের আনা হারমোনিয়ামটি বাজালেন তারপর বললেন, ‘‘সুফলদা আপনে কাম আচ্ছা কিয়া হ্যায় লেকিন ইসমে থোড়া জান ডাল দিজিয়ে।’’ আমি বিষয়টা প্রথমে অনুধাবন করতে পারিনি যে একটা হারমোনিয়াম নিষ্প্রাণ যন্ত্র, তার মধ্যে প্রাণ দেওয়াটা কীভাবে সম্ভব! পরে কাজ করতে করতে যখন অভিজ্ঞতা বেড়েছে বুঝেছিলাম যে যিনি কথাটা বললেন এবং যাকে বললেন তাঁদের পক্ষে ছাড়া আর কারও পক্ষেই এটা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন-অভিষেককে ঘিরে জনজোয়ার

এটা লিখে বোঝানোর বিষয় নয়। একজন শিল্পী কী চাইছেন, অপরদিকে যিনি আছেন তাঁকেই বুঝতে হবে আর সেই বোঝার জায়গা তৈরি করতে হলে তাঁকে গানবাজনা সাধনার মধ্যে দিয়ে আসতেই হবে। পাকড়াশি-প্রজন্ম শিল্পীদের এই চাহিদাটা বুঝতেন তাই আলাদা একটা জায়গা করে নিতে সময় লাগেনি।
‘ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন্স’ নামের একটি বহু প্রাচীন সংস্থা ছিল যারা মূলত পিয়ানো টিউনিং এবং অন্যান্য মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট রিপিয়ারিংয়ের কাজ করত। ১৮৭৫ সালে গড়ে ওঠা এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দ্বারিকানাথ ঘোষ। সংস্থাটির আরও একটি কাজ ছিল, এখানকার চার্চগুলোর জন্য অর্গান ইমপোর্ট করা। কারণ চার্চগুলিতে মিউজিকের জন্য তখন অর্গানের দরকার পড়ত। সেই অর্গান এবং পিয়ানোগুলো এতটাই বড়সড় হত যে হ্যান্ডেল করা খুব কঠিন ছিল। রীতিমতো লোক লাগত। পরবর্তীকালে এই অর্গানের একটা ভারতীয় ভার্সন তৈরি হয় যেটা আজও পুরনো কলকাতার কিছু বাড়িতে রয়ে গেছে। আগের চেয়ে একটু ছোট সাইজের। তখন পা দিয়ে বাজানো হত সেই যন্ত্র। এরপর সেটাকেই আরও পরিবর্তন করে পা দিয়ে বাজানোর অংশটা হাতে নিয়ে আসা হয় এবং এটার নাম দেওয়া হয় ‘হ্যান্ড অর্গান’। মূলত এই উদ্যোগ ছিল সাহেবদেরই।

আরও পড়ুন-রুশ হামলায় রক্তাক্ত ইউক্রেন মৃত ২৬, জখম বহু

এই সময়েই পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং সুধীর পাকড়াশির মধ্যে এটা নিয়ে জোরদার আলোচনা চলে এবং তাঁরা এর মধ্যে ইনভলভ হয়ে পড়েন। সেই সময় ঢাকার দাস ব্রাদার্সও এই প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই আলাপ-আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবে হ্যান্ড অর্গান থেকে তৈরি হল সেকালের হারমোনিয়াম। সেই যন্ত্র আরও প্রেজেন্টেবল হল কালের পরিবর্তনে। এরপর ধীরে ধীরে মডিফিকেশন চলতে থাকে তৈরি হয় স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম। যদিও হারমোনিয়াম কিন্তু তখনও এত জনপ্রিয় ছিল না। সেই সময়েই তিরিশ বছর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ব্যান ছিল হারমোনিয়াম, রবীন্দ্রনাথও বললেন বেসুরো। পূর্ণ হয়েছিল হারমোনিয়াম-বিরোধিতার ষোলোকলা। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়।
প্রথাগত শিক্ষার বিবর্তনের যুগে ধীরে ধীরে মানুষ তথা শিল্পীমহল অনুভব করল সা থেকে নি— সপ্তকের এই সাতসুরকে আলাদা করে বুঝতে হারমোনিয়ামের বিকল্প নেই, যা শ্রুতিমধুরও। যে-কারণে তানপুরার চেয়েও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ল হারমোনিয়ামের। তানপুরা সংগীত শিক্ষায় অপরিহার্য। ঠিক ঠিক স্বরগুলো বসাতে, গলা তৈরি করতে তানপুরা চাই-ই কিন্তু হারমোনিয়াম আমাদের রেডি পিচ দিতে, স্বর চেনাতে সাহায্য করল। তাই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল যন্ত্রটি। আর সেই জনপ্রিয়তার পুরোভাগে রইল ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’। ডোয়ার্কিনরা হারমোনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করলেও পরের দিকে পাকড়াশিরাই হয়ে উঠলেন একমাত্র অপশন।

আরও পড়ুন-স্বেচ্ছা ন্যাড়াকে বেধড়ক মারল কংগ্রেস কর্মীরা

মাঝে একশো বছর পার। তখন লতা মঙ্গেশকর থেকে শুরু করে মুম্বইয়ের নামী শিল্পীরা চলে আসতেন কলকাতায় ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’-এর হারমোনিয়াম কিনতে। কে ছিল না নামীদামি শিল্পীদের তালিকায়? নৌশাদ, সলিল চৌধুরী, জগজিৎ সিং, ওস্তাদ জাকির হোসেন এবং তৎকালীন কলকাতা শিল্পীমহলের প্রায় সকলেই। সেই সঙ্গে এখনকার শিল্পীদের কাছেও পাকড়াশিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ভরসাযোগ্য একটি নাম। এরপর মুম্বই বা কলকাতায় আরও বড় বড় হারমোনিয়াম ব্র্যান্ড এসেছে। কিন্তু ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’-এর তৈরি হারমোনিয়ামের চাহিদা আজও একরকম।

আরও পড়ুন-দিনের আলোয় কলকাতা শহরের বুকে সেই গণহত্যার স্মৃতি ফেরাল ৩০ এপ্রিল

সেই একশো বছর আগের প্রথম হারমোনিয়াম আর আজকের হারমোনিয়ামের মধ্যে ফারাকটা কি জমিন আর আসমানের? কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে? এই প্রশ্নের প্রসঙ্গে শুভজিৎবাবু বললেন, ‘‘খালি চোখে দেখলে বাহ্যিক তেমন পরিবর্তন নজরে পড়বে না। কিন্তু প্রচুর টেকনিক্যাল মডিফিকেশন করা হয়েছে। আগে পুরোটাই কাঠের হত। কিন্তু যখন যন্ত্রটা এক্সপোর্ট করতে শুরু করি দেখা গেল এখানকার আবহাওয়ায় ভাল চললেও বিদেশে এক্সট্রিম ওয়েদার কন্ডিশনে যাওয়ার পর হারমোনিয়াম আর পারফর্ম করতে পারছে না। কারণ কাঠ আবহাওয়া অনুযায়ী বাড়ে বা কমে, ফলে ভাল ফিডব্যাক আসছিল না। ২০০৫-এ ইউএসএ-তে গিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দীর্ঘ গবেষণার পর উপরের অংশটা বদল করা হল। এখন ওই অংশটা আর কাঠের হয় না, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাক্রিলিকের হয়। এর ফলে সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। টেম্পারেচারের বদলেও হারমোনিয়াম থেকে গেল একইরকম শ্রুতিমধুর। আসলে দেশের গণ্ডি পেরিয়েছিলাম বলেই আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি এবং সফল হয়েছি। এটা খুব বড় দিক। এর পাশাপাশি বর্তমানে যে লেটেস্ট মডিফিকেশনটি করা হয়েছে সেটা হল এবার আমাদের হারমোনিয়ামের মধ্যেই চলে আসছে ইলেকট্রনিক তানপুরা। ব্যাটারি চার্জারের সাহায্যে চলবে তানপুরাটি।

আরও পড়ুন-নতুন করে সংঘর্ষ মণিপুরের চূড়াচাঁদপুরে

জানা গেল এই বছর, ২০২৩-এ নিউজার্সিতে আয়োজিত বঙ্গসম্মেলনে অংশগ্রহণ করছে ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’। সেখানেই শুভ উদ্বোধন হবে নতুন এই হারমোনিয়ামটির। কালের পরিবর্তনে বহু পুরানোই তলিয়ে গেছে অতলে। বাবু হয়ে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইবার শিল্পী কমছে, সিন্থেসাইজারে বাজছে হারমোনিয়াম, নতুন নতুন ইন্সট্রুমেন্ট আসছে, তাহলে একটা সময় তো ব্যবসায় পড়বেই ভাটার টান! সেই চিত্রটা ঠিক কী রকম! বিষয়টার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন না শুভজিৎ পাকড়াশি, তাঁর মতে, যতই নতুন নতুন যন্ত্র আসুক, মানুষ অপশন ভাবুক কিন্তু যা চিরাচরিত তা কখনও হারিয়ে যায় না। হারমোনিয়াম হল সংগীত শিক্ষার বেসিক যন্ত্র। যে শিল্পীরা মঞ্চে এখন মাইক ব্যবহার করছেন তাঁদের রেওয়াজ কিন্তু হারমোনিয়াম ছাড়া অসম্পূর্ণ। গলা তৈরি করা, গলা সাধার জায়গাতে এখনও হারমোনিয়ামই রয়েছে, আগামীতেও তাই থাকবে। হ্যান্ডক্রাফটেড এক হেরিটেজ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের তীব্র আবেগ, সেন্টিমেন্টের সাক্ষী হারমোনিয়াম। তাই যুগের পরিবর্তনে কালের পরিবর্তনেও এর গুরুত্ব বেড়েছে। আজ বিভিন্ন মিউজিকাল শো-গুলো নতুন করে প্রমাণ করে দিয়েছে হারমোনিয়াম কোনওদিন হারিয়ে যাবে না।
শুধু দেশে নয় বিদেশেও ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’-এর জনপ্রিয়তা খুব বেড়েছে। বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকায় খুব বেশি। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, প্রথমত শিল্পীরা আমাদের যন্ত্র সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন, প্রোগ্রাম করেছেন ফলে পরিচিতি বেড়েছে। কোভিডের দৌলতে অনলাইনে এখন শেখার স্কোপ অনেক বেড়েছে তা ছাড়া আমরা হারমোনিয়াম এক্সপোর্ট করেছি। দ্বিতীয়ত, সাউথ আফ্রিকা শুধু নয় সবচেয়ে বেশি ইন্ডিয়ান মিউজিকাল ইনস্ট্রুমেন্টের চাহিদা, চর্চা, প্রচার রয়েছে আরও দুটো দেশে— ফিজি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তার কারণ এই দেশগুলোয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ রয়েছেন প্রচুর। একটা সময় ইংরেজ সরকার বহু মানুষ জাহাজ ভরে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই দেশগুলোয় দাসত্ব করানোর জন্য। তাঁরাই নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন যুগ যুগ ধরে, যা আজও অব্যাহত।

আরও পড়ুন-সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করে শুরু যুদ্ধ, উদ্ধারকাজে জোর

শোনা যায় সুমিত্রা সেন, শ্রাবণী সেন, ইন্দ্রাণী সেন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সুচিত্রা মিত্র— স্মরণীয় দিনের শিল্পীরা প্রায়শই আসতেন এখানে। আসতেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। সুধীর পাকড়াশির আমলে গানবাজনার আসরও বসত শোরুমেই। ২০১৩ সালে সেই হাজার স্কোয়্যার ফিটের শোরুমটি ভেঙে আজকের স্বল্প পরিসরের ‘পাকড়াশি অ্যান্ড কোং’ তৈরি হয়। তখন পিছনে ফ্যাক্টরি এবং সামনে শোরুম নিয়ে বেশ বড় জায়গায় ছিল। সেখানে এক দারুণ সংগীতমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হত। কৈশোরে আলি আকবর খাঁ সাহেবকে দেখেছেন শুভজিৎ পাকড়াশি। উনি শেখানোর সময় হারমোনিয়াম বাজিয়েই শেখাতেন। স্মৃতি সততই সুখের— সেই স্মৃতিচারণে উঠে এল আরও নানা কথা। বললেন, ‘‘অজয় চক্রবর্তী এখানে আসতেন নিয়মিত, দারুণ হারমোনিয়াম বাজাতেন। সুচিত্রা মিত্র এসে অনেক গান গেয়ে গেছেন। সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী আসতেন। তিনি কখনও হারমোনিয়াম বাজিয়ে টেস্ট করতেন না। অন্য কাউকে বাজাতে বলতেন তিনি কানে শুনে টেস্ট করতেন। তবে বিখ্যাত মানুষের মাঝে সেরার স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি মানুষের থেকেই।’’ এখন ফ্রি মিউজিক ট্র্যাকের যুগ, যাকে বলে ক্যারাওকে। তাহলে আর হারমোনিয়াম কেন? উত্তরে বললেন— কারণ, হারমোনিয়ামই সেরা তাই। ক্যারাওকের কনসেপ্টটাই আলাদা। এটা স্কেলে করতে হয়। ট্র্যাকে গাইবার একটা বিশেষ দক্ষতা দরকার। গানের বেসিকটা না জানলে ট্র্যাকে গাওয়াটাও অসম্ভব। তার জন্য অনেক বেশি প্র্যাকটিস দরকার। তাই বাক্সবন্দি এই চিরন্তনী আবেগকে মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়া অসম্ভব।

Latest article