সন ১৮৬৮, কলকাতায় নবগোপাল মিত্র একটি শরীরচর্চার আখড়া প্রতিষ্ঠা করলেন। শরীর সঞ্চালনার কৌশল ও পশুর খেলাকে একত্রিত করে তাঁর উদ্যোগে জন্ম নিল ন্যাশনাল সার্কাস। ভারতের প্রথম দেশজ সার্কাস। কলাকুশলী ছাড়া তাঁর দলের একমাত্র সম্বল ছিল টাট্টু ঘোড়া। কিন্তু বেশিদিন টেকেনি সেই দল। এর ক’দিন পরেই বোম্বেতে বিষ্ণুপন্থ ছত্রে প্রতিষ্ঠা করলেন গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস। পরবর্তীকালে বেশ কিছু বিদেশি এই দলে যোগদান করেন।
আরও পড়ুন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন যেন সাধারণ কবিতাও নয়
জাতীয়তাবাদের জোয়ার তখন চতুর্দিকে। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠছে শরীরচর্চার আখড়া। নবগোপাল মিত্রের বন্ধু ছিলেন মনোমোহন বসু। তিনি নাট্যকার। মনোমোহনের ছেলে প্রিয়নাথ। তিনি অল্পবয়স থেকেই শরীরচর্চায় আগ্রহী। আহিরিটোলার এক বিখ্যাত আখড়ায় ছিল তাঁর যাতায়াত। একদিন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তিনি কলকাতার সিমলে পাড়ায় খুলে ফেললেন একটা আখড়া। সেখানে যাঁরা যাতায়াত শুরু করলেন, তাঁদের অন্যতম বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালের স্বামী বিবেকানন্দ।
নাট্যকার মনোমোহন ছেলের এই শরীরচর্চার বিষয়টাকে খুব সুনজরে দেখেননি। ছেলেকে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি। বাবা চেয়েছিলেন আর্টকেই কেরিয়ার করুক ছেলে। কিন্তু প্রিয়নাথ শরীর সঞ্চালনার সঙ্গে জুড়ে দিলেন এক শৈল্পিক মাত্রা। একুশ শতকে সেটাকেই আমরা পারফরমিং আর্টস বলতে পারি।
আরও পড়ুন-জামাই-বন্দনা
কলকাতায় বসেই প্রিয়নাথ দেখেছিলেন উইলসনের ‘গ্রেট ওয়ার্ল্ড সার্কাস’ আর চিয়ারিনির ‘রয়েল ইটালিয়ান সার্কাস’। বিদেশি সার্কাস দেখে অভিভূত তিনি। জিমন্যাস্টিক্সে পরদর্শী বেশ কিছু সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে তৈরি করলেন একটা নতুন দল।
বাবার আপত্তি ছিল তীব্র। ফলে, বাড়ি ছাড়তে হল প্রিয়নাথকে। হাতে সামান্য অর্থ, বুকে অদম্য জেদ। জোরকদমে শুরু হল সার্কাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সার্কাস দলে প্রশিক্ষণের কাজ, প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করা, যন্ত্রপাতির নকশা তৈরি, সব একা হাতে সামলাতেন প্রিয়নাথ।
প্রথম প্রথম পশুপাখি কিছুই ছিল না তেমন। ভরসা জিমন্যাস্টিক্স। সেই ভরসাতেই প্রিয়নাথ বসুর সার্কাসের দল ঘুরতে লাগল মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, বীরভূমে। জমিদারদের আমন্ত্রণে শো করতেন। সেই রোজগার থেকেই কেনা হল কুকুর, বাঁদর, ঘোড়া ইত্যাদি। নতুন শোয়ের জন্য তাঁবু কেনা হল। শ্যামবাজারে নন্দ ঘোষের আখড়া থেকে ধার করা হল ঘোড়া। ব্রিটিশরা প্রিয়নাথের কর্মকুশলতায় মুগ্ধ। তারাই তাঁকে ‘প্রফেসর’ আখ্যা দিল। সেই থেকে প্রিয়নাথ হয়ে উঠলেন প্রফেসর বোস। ১৮৮৭-তে প্রতিষ্ঠিত হল প্রফেসর বোসের ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’। বাঙালির সার্কাস যৌবনে পদার্পণ করল।
আরও পড়ুন-সাত বছরের মাথায় ফের কেন নোট বাতিল
সেই সার্কাসের দল একের পর এক শো করতে লাগল বাংলা জুড়ে। বরিশাল, নৈহাটি, মুর্শিদাবাদ, কাটোয়ায়। বাংলা ছাড়িয়ে সার্কাসের দল পৌঁছে গেল কাশী, গোয়ালিয়র, রেওয়া, এমনকী কাশ্মীরেও। দেশীয় রাজাদের আমন্ত্রণেই অনুষ্ঠিত হত এইসব শো। সেই রাজারা ব্যক্তিগত পশুশালা থেকে প্রফেসর বোসের সার্কাসের দলকে উপহার হিসেবে দিলেন হাতি, ঘোড়া, বাঘ ইত্যাদি।
১৮৯৯, কলকাতায় প্রথম বড় আকারে সার্কাসের আয়োজন। তাঁবু পড়ল ময়দানে। দর্শক আসনে দেখা গেল কাপুরথালা, কোচবিহার এবং বর্ধমানের রাজাদের। দেশের আনাচে-কানাচে প্রফেসর বোসের গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।
আরও পড়ুন-যুদ্ধ বন্ধ করুন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জি-৭ গোষ্ঠীর
মেয়েরা তখন বাড়ির বাইরে পা রাখত না। সেই সময়ে প্রিয়নাথ বোস তাঁর সার্কাসের দলে নিয়ে এলেন এক মহিলা জিমন্যাস্টকে। নাম সুশীলা সুন্দরী। সেই মহিলা জিমন্যাস্ট বাঘের সঙ্গে একই খাঁচায় খেলা দেখালেন। বাঘকে চুম্বন করলেন প্রকাশ্যে। একযোগে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন বন্যবাঘ আর পুরুষশাসিত সমাজকে। শেষ পর্যন্ত বাঘের আক্রমণেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে সার্কাসজীবনে ইতি টানতে বাধ্য হন সুশীলা।
প্রফেসর বোস ভারত ছাড়িয়ে বিদেশেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস খেলা দেখায় শ্রীলঙ্কা, ইয়াঙ্গন, মালয়, জাভা, সিঙ্গাপুর-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে। বাঙালির সাফল্যের ধ্বজা উড়েছিল দিকে দিগন্তে।
সন ১৯২০, সিঙ্গাপুরে দল নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়েছেন প্রিয়নাথ। আচমকা আক্রান্ত হন জন্ডিসে। ২১ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
আরও পড়ুন-যুদ্ধ বন্ধ করুন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জি-৭ গোষ্ঠীর
এসব বিজেপির মিথ্যা পরম্পরার বিদ্বেষ ছড়ানোর ঢেকুর নয়।
এসব অনৃতবাক্যের অদ্ভুত উচ্চারণে ফেকু জাতীয়তাবাদের প্রচার নয়।
এসব বিকৃত ইতিহাসের মোচড়ানো তথ্যের বেকুব পরিবেশনে গা-গরমের চেষ্টা নয়।
এ-সব হল চেনা বাঙালির অজানা গৌরবগাথা। ইতিহাসনিষ্ঠ ঔজ্জ্বল্যের পরম্পরার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।