দেশবাসী গত ন’বছরে দেখেছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কাজের চেয়ে চমকের উপরেই অধিক আস্থা রাখেন। ২০১৬-র নোটবন্দি কাণ্ডটি নিঃসন্দেহে এমনই এক মোদি-দর্শনের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের এত বড় দৃষ্টান্ত ভারত তো বটেই, সারা পৃথিবী কমই দেখেছে। ১৩০ কোটি মানুষের দেশে নোটবন্দির সিদ্ধান্তটিতে চমকে গিয়েছিল সারা পৃথিবীর মিডিয়া এবং অর্থনৈতিক মহল। জিনপিংয়ের দেশের সরকারি সংবাদপত্র পর্যন্ত মন্তব্য করেছিল, ‘চিনের সরকারও এই দুঃসাহস দেখাতে পারত না!’ অন্যদিকে, দেশের মানুষ আর্তনাদ করে উঠেছিল।
আরও পড়ুন-কর্নাটকের ধাঁচে মধ্যপ্রদেশেও একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি কংগ্রেসের
প্রধানমন্ত্রীর হাততালি কুড়ানোর নিষ্ঠুর নেশা বহু মানুষের প্রাণ অকালে কেড়ে নেয়। বিরাট আঘাত নেমে এসেছিল দেশীয় অর্থনীতির উপর। কালো টাকা এবং জঙ্গি তহবিল—এই দুটির কোনওটাই ধ্বংস, এমনকী সামান্যও সংকুচিত হয়নি। অথচ, অর্থনীতি, কালো টাকা ও জঙ্গি তহবিল সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সদর্প ঘোষণাটি ছিল উল্টো। অতিদর্পের পরিণাম কি মেঘমুক্ত দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে আসছে সরকারের সামনে? নোট বাতিলের পর জাল নোটের দাপট উল্টে বেড়ে গিয়েছে। আর সেটা হয়েছে মোদিজির সাধের গোলাপি নোটের সৌজন্যে। নয়া ২০০০ টাকার নোটের মজুতদারিও হয়েছে মাত্রাছাড়া।
আরও পড়ুন-রফতানির আগে সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করাতে হবে কাফ সিরাপ
অতএব, আতান্তরে সরকার। বছর চার আগেই এই নোট ছাপা এবং ক্রমে গণহারে বাজারে ছাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের ক্যাশ কাউন্টার এবং এটিএমগুলি থেকে দু’হাজারি নোট হাওয়া হয়ে যেতেই জনমানসে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, এবার কি তবে গোলাপি জাদুর পাততাড়ি গোটাবার পালা? জনগণের প্রশ্নের দ্রুত অবসান ঘটে গেল আরবিআইয়ের ১৯ মে, ২০২৩ এর ঘোষণায়: ২৩ মে থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশের যেকোনও ব্যাঙ্কে গোলাপি নোট জমা করা কিংবা বদলে নেওয়া যাবে— তবে একলপ্তে ১০টির বেশি নোট নয়। ২০১৬ সালের মতো এবার অবশ্য সরাসরি ‘নোট বাতিল’ বলা হয়নি। মানুষ কিন্তু এই পদক্ষেপকে ইতিমধ্যেই দু’হাজারি ‘নোট বাতিল’ বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সেটাকেই তাদের ‘ক্লিন নোট পলিসি’র অন্তর্গত সিদ্ধান্ত বলে দাবি করেছে। সে যাই হোক, এই পলিসিকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, যে-সরকার অহরহ ব্যয়সংকোচের বুলি আওড়ায়, সে এবার জানাক, গোলাপি নোট ছাপতে রাজকোষের কতটা হালকা হয়েছিল? এরকম তুঘলকি সিদ্ধান্তের খেসারত জনগণকে আর কতবার দিতে হবে?
আরও পড়ুন-নেইমারকে পেতে আসরে ম্যান ইউ
কেবল অর্থনীতির পরিসরে নয়, রাজনীতির বৃত্তেও এই ভেলকিবাজি অহরহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
সোজা পথে কাজ না-হলে বাঁকা পথ নেওয়ার কথা শোনা যায়। মোদি জমানায় প্রশাসন, শাসক দল বা তার নেতা-নেত্রীদের কর্তৃত্ব জারি বা ক্ষমতা দখলের জন্য এই চোরাপথ নেওয়ার উদাহরণ অজস্র। কখনও রাজ্য বিধানসভা ভোটে হেরে গিয়েও অসৎ উপায়ে বিরোধী শিবিরের বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা, কখনও নির্বাচিত সরকারকে পিছন থেকে ছুরি মেরে ক্ষমতা দখল করা। প্রায় সাড়ে ন’বছরের শাসনকালে এই খেলায় যথেষ্ট হাত পাকানোর পর এবার সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের উপরেও ছড়ি ঘোরাতে তৎপর হয়েছে গেরুয়াবাহিনী। রাজধানী দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলেও সেখানে একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকার রয়েছে। যেখানে রাজ্যপালের মতো আছেন কেন্দ্রের প্রতিনিধি উপরাজ্যপাল। মোদি-অমিত শাহদের বুকের উপর দাঁড়িয়ে প্রশাসন চালাবেন বিরোধী আপ সরকার না উপরাজ্যপাল—কে শেষ কথা বলবেন, সেই টানাপোড়েন চলছে ২০১৫ সাল থেকে। প্রথমে দিল্লি হাইকোর্ট, পরে সুপ্রিম কোর্ট—দীর্ঘ আট বছরের আইনি লড়াইয়ের শেষে গত ১১ মে সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, আমলাদের রদবদল থেকে যাবতীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নির্বাচিত সরকারের।
আরও পড়ুন-প্রথম দফার ভারতীয় দল ইংল্যান্ড পৌঁছল
সংবিধান প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার এই সহজ-সরল সত্যটা মেনে নিতে পারেনি মোদিবাহিনী। তাই আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে সরিয়ে দিয়ে কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্টকে যে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছিল মোদি সরকার, তারাই আবার এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পরেও নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করেছে! অর্থাৎ, উপরাজ্যপালের মাধ্যমে দিল্লির রাশ হাতে রাখার মরিয়া চেষ্টা মোদি সরকারের। নির্বাচিত সরকারের অধিকার কেড়ে নেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা চলছে সমানে। ঘটনা পরম্পরা বলছে, মূলত কর্নাটক নির্বাচনে বিজেপির বিপুল পরাজয়ের পর থেকে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি একছাতার তলায় আসার চেষ্টা করছে। এমনকী, বিরোধীদের মধ্যে বিবদমান দলগুলিও এক সুর, একভাষায় মোদিশাহীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। অর্ডিন্যান্স ইস্যুতে সব বিরোধী দলের সঙ্গে নিজে কথা বলা শুরু করেছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্ডিন্যান্স ইস্যুতে রাজ্যসভায় বিজেপি বিরোধী সাংসদরা এককাট্টা হয়ে ভোট দিলে কেজরিওয়াল সরকারের এক্তিয়ার খর্ব করে ক্ষমতা দখলের লালসা অধরাই থেকে যাবে মোদি সরকারের। সেটা হলে ’২৪ এর লোকসভা ভোটের আগে এই বার্তাই দেওয়া যাবে যে, শাসক দলকে সংসদের ভিতরেও হারানো যায়। সেজন্যই ভয় পাচ্ছে মোদি পক্ষ। নতুন চমকমাখা দুষ্টুমির ফিকির খুঁজছে।
আরও পড়ুন-৪ জুলাই মোহনবাগানে পেলে-মারাদোনা-সোবার্সের সম্মান, কিংবদন্তিদের গেট উদ্বোধনে মার্টিনেজ
কিন্তু এসব করেও বাজিগর মোদি পার পাবেন কি?
সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দু’দিন পর সোমবার থেকে ফের জনসংযোগ যাত্রা শুরু হয়েছে। সারদা, নারদ, কয়লা, গরুপাচার এবং নিয়োগ দুর্নীতি—রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর গেরুয়া পক্ষের অপচেষ্টা সফল হবে না। কারণ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ময়দান তিনি ছাড়বেন না। কারণ এই লড়াইয়ে ভরসা জুগিয়ে চলেছে বাংলারই মানুষ। তিনি বলেছেন, ‘‘আপনারা মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিয়েছেন, তাই পথে নেমেছি পরিবর্তনের জন্য।’’
ভেলকিবাজ, চমকপ্রিয় মোদিজিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস, এজেন্সি না নামিয়ে জনতার মাঝে এসে লড়াই করুন। বিজেপির বিচার হবে বাংলার মানুষের দরবারে।
বাজিগর প্রধানমন্ত্রীর হিম্মত আছে এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়ার?