২০১৪ থেকে শুনে আসছি কথাটা। অতীতের কোনও সরকার প্রকৃত উন্নয়নের কাজ করেনি। মানুষের যা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা পায়নি। আমরা দেশবাসীকে প্রকৃত সম্মান দেব। সাধারণ মানুষের দেশের কাছে যেটা প্রাপ্তি সেটা পৌঁছে দেব। আগে কিছুই হয়নি।
কিন্তু বাস্তবে কী হল?
আরও পড়ুন-পর্যটক টানতে সাজছে দিঘা মেরিন ড্রাইভ
মিথ্যা ইতিহাস রচনা করা হল, হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে ফেক নিউজ ছড়ানো হল এবং এসব নিয়ে উন্নয়নবাদী মোদিভক্তদের বিশেষ হেলদোল দেখা গেল না। নতুন পার্লামেন্ট উদ্বোধনে কেন শুধুই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দু সাধু সন্ন্যাসীদের নিয়ে এসে হিন্দু ধর্মমতে যাগযজ্ঞ, পুজো করে মন্ত্র-শ্লোক উচ্চারণের মাধ্যমে প্রায় নিজের রাজ্যাভিষেক করলেন মোদি, সেটা নিয়ে দেশ জুড়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে। সমালোচনাও করা হচ্ছে। কিন্তু এটা ভেবে দেখা দরকার যে, মোদি আর কী করতে পারতেন? তিনি যদি হিন্দু মুসলিম পার্সি খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকলকে ডেকে সর্বধর্মসমন্বয়ের একটি ছবি উপহার দিতেন অথবা দেশের বেঁচে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে এসে তাঁদের হাত দিয়ে উদ্বোধন করাতেন কিংবা রাষ্ট্রপতি গোটা অধ্যায়ের মধ্যমণি, মোদি নিছক একজন দর্শক— এরকম করতেন, সেটা কি তাঁর কাছে প্রত্যাশিত?
আরও পড়ুন-আমটি আমি খাব পেড়ে
এগুলো হলে আমরাই তো অবাক হতাম! আমরা তো জানি যে মোদি এরকম নন। যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজ সেই নোটবাতিল ঘোষণা তিনি টানটান থ্রিলারের ভঙ্গিতে রাত ৮টায় করেন। আবার পুরী- হাওড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধনও তিনি করেন। সুতরাং সংসদ ভবন উদ্বোধন করার মতো হাইপ্রোফাইল ইভেন্ট তিনি হাতছাড়া করবেন, এটা হয় নাকি? তাঁর ইমেজের সঙ্গে যা স্বাভাবিক সেটাই তিনি করেছেন। সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মোদির নিজের এবং হিন্দুত্বের জয়জয়কার দেখে একটি বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়া গিয়েছে। সেটি হল, মোদি নিজে বুঝে গিয়েছেন যে, আসলে তিনি সরকারের উন্নয়ন কার্য বলতে যা বোঝায় তার কিছুই করে উঠতে পারেননি। তাই মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য সিনেম্যাটিক ইভেন্ট হিসেবে মোদিজিকে দেখা গেল সোনালি রাজদণ্ড নিয়ে। ধর্ম ও নাটকীয় ইভেন্টের সংমিশ্রণে এক মেগা ওয়ান ম্যান শো।
আরও পড়ুন-আমপাতা জোড়া জোড়া
নোটবাতিল করে মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি অর্থনীতি বোঝেন না। অকস্মাৎ লকডাউন করে মোদি জানিয়েছেন যে, তিনি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অজ্ঞ। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি আটকাতে না পারায় মোদির বিষয়ে মানুষের উপলব্ধি হয়েছে তিনি সরকার চালনায় ব্যর্থ।
অন্য দিকে, নবজোয়ার কর্মসূচি। তাকে ঘিরে জনজোয়ার। কেউ নাক সিঁটকে ছিলেন, কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন খরচ নিয়ে। অনেকে ভেবেছিলেন, মাঝপথেই রণে ভঙ্গ দেবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। ইডি তাঁকে ডাকার পর নবজোয়ার কর্মসূচির জনজোয়ার কার্যত তুফানে পরিণত হয়েছে। কোথাও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভেসেছেন অসহায় সন্তানহারা জননী। কোথাও প্রতিবন্ধী যুবক রাস্তায় বসে শুনিয়েছেন তাঁর কষ্টের কথা। কোথাও আবার বছর দু’য়েকের ছোট্ট শিশুকে কাঁধে নিয়ে হেঁটেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সামনে ও পিছনে অগনতি মানুষের মিছিল। সব মিলিয়ে, ‘নবজোয়ার’ হল তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়, অনিশ্চয়তা তৈরির গেমপ্ল্যান ভেস্তে দেওয়ার মোক্ষম ‘অস্ত্র’।
আরও পড়ুন-উদার আকাশের দুই নক্ষত্র
তারুণ্যের উচ্ছ্বাস না থাকলে সেই দল হয়ে যায় বদ্ধ জলাশয়। অস্তিত্ব কোনও রকমে টিকে থাকলেও তা কাজে লাগে না। তাই কেউ ফিরেও তাকায় না। সেই তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নবজোয়ারে স্পষ্ট।
ইতিহাস বলে, শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার রাজনীতিতে ধর্ম, জাতপাত সেভাবে কখনও থাবা বসাতে পারেনি। তাই ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে পরিষেবা ও সরকার-বিরোধী আন্দোলন। সেইসব আন্দোলনই সাফল্য পেয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিল যুবসমাজ। ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তির জন্য অপেক্ষমাণ বঙ্গসমাজ। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিটি কর্মসূচিতেই আছড়ে পড়ছে যুবকদের উচ্ছ্বাস। রোড শোয়ে বয়ে যাচ্ছে জনস্রোত। তিনি যেখান দিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিটি রাস্তার ধারে মানুষের লম্বা লাইন। জনসভায় মহিলাদের বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রভাব এখনও অটুট। ‘অর্গানাইজড’ বা পেশাদারি সংস্থার সাজানো চিত্রনাট্যের সুবাদে মে মাসে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাজার হাজার মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না। এটা পরিষ্কার।
আরও পড়ুন-মনের ডাক্তার
কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে না হটালে সুদিন ফিরবে না— এই ধারণা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে কন্যাকুমারিকা থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত আমজনতার মধ্যে। সর্বস্তরে ওঠা এই আওয়াজকে সরাসরি রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে তুলে আনছে তৃণমূল কংগ্রেস। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত। মোদি-শাহের বিরুদ্ধে ভোটবাক্সেই ঘটবে জন-বিস্ফোরণ। নবজোয়ার কর্মসূচি কার্যত গেরুয়া শিবিরের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। তাঁর দাবি, ‘কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের মেয়াদ আর এক বছর। জনসংযোগ যাত্রায় বেরিয়ে মানুষের কথাবার্তা থেকে এটা বুঝেছি যে তাঁরা আর বিজেপিকে চাইছেন না। সেই জন্যই কর্নাটকে বিজেপিকে হারতে হয়েছে। চব্বিশের লোকসভায় বিজেপির ভরাডুবিও স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।’ এই মূল্যায়নে কোনও ভুল নেই। কারণ, বিভাজন ভাঙে, গড়ে না। আর মানুষ সতত নির্মাণের পক্ষে, ধ্বংসের নয়।