‘‘জানো না তো কেউ পৃথিবী উঠেছে কেঁপে
ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুটি চেপে।”
—বিক্ষোভ কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য
আরও পড়ুন-চলতি বছরে রেকর্ড আয় এনবিএসটিসির
শুক্রবার সন্ধ্যায় বালেশ্বরের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায় তিনশো জনের মৃত্যুর পিছনে ‘পয়েন্টের বিভ্রাট’ মূল কারণ বলে প্রাথমিকভাবে দাবি করলেন রেলের মন্ত্রী-সহ রেলের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। কিন্তু দুর্ঘটনার পরেই রেল মন্ত্রকের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা স্বীকার করে নিয়েছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনগুলিতে কিংবা সার্বিকভাবে এই রুটে ‘কবচ’ ব্যবস্থা—অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন (এপিটি) সিস্টেম অথবা অ্যান্টি কলিশন সিস্টেম—চালু হয়নি। তাঁর আক্ষেপ, হাওড়া চেন্নাই রুটে ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু থাকলে এই দুর্ঘটনা হত না এবং এই মৃত্যুর তাণ্ডব ঘটত না। মোদ্দা কথা, পয়েন্টের ভুল হলেও ‘কবচ’ সিস্টেমে দুর্ঘটনার এই ভয়াবহতা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হত। কার্যত ‘মিথ্যার’ বেসাতি করে প্রকৃত সত্যের টুটি চেপে ধরা হল। এটাই প্রচার সর্বস্ব মোদি সরকারের আসল মুখোশ।
আরও পড়ুন-বিপন্নদের পাশে তৃণমূল, কালনা-কাটোয়ায় চিকিৎসা তদারকিতে মন্ত্রী-বিধায়ক
প্রশ্ন, কেন বসানো হল না কবচ? কোনটা বেশি জরুরি ‘কবচ’ না প্রচার সর্বস্ব মোদির ‘বন্দে ভারত’? গত বছর (২০২২ সালে) ১ ফেব্রুয়ারি দেশের অর্থমন্ত্রী ঘটা করে সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনবছরের মধ্যেই সারা ভারতে দ্রুতগতিসম্পন্ন ৪০০টি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন চালানো হবে। আরও বলা হয়েছিল, যাত্রী সুরক্ষার স্বার্থে ভারতে নিজেদের তৈরি বিশ্বমানের কৌশলসম্পন্ন ‘কবচ’ (অ্যান্টি কলিশন পদ্ধতি) চালু করা হচ্ছে। দু’হাজার কিলোমিটার রেলপথ এই ব্যবস্থায় আনা হবে এ বছরেই।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় ৫০টি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন ও দেড় হাজার কিলোমিটার রেলওয়ে লাইনে ‘কবচ’ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের রেলমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে ৩টি করে ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন তৈরি করা হবে। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ সালে ভারতে কত কিলোমিটার রাস্তাতে ‘কবচ’ চালু করা হবে তা ঘোষণা হল না।
আরও পড়ুন-ভাবাবেগকে আঘাত ক্ষমা চাক বিজেপি
কোনটি সরকারের অগ্রাধিকার? ‘কবচ’ না ‘বন্দে ভারত’? ‘কবচ’ বা অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম চালু করতে হলে প্রতি কিলোমিটারে ৫০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। এর অর্থ হল, ভারতে ৬৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে এই ব্যবস্থা রূপায়িত করতে গেলে খরচ হওয়ার কথা ৩২ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর দেড় হাজার কিলোমিটার করে বাস্তবায়িত হলে ভারতীয় রেলকে ‘কবচ’ পদ্ধতি চালু করতে ৪২ বছর সময় লাগবে। বছরে দু’হাজার কিলোমিটার করে হলে অন্তত ২১ বছর সময় লাগবে।
অথচ ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশের অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ৩ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ৪০০টি ‘বন্দে ভারত’ চালু হবেই। বর্তমান অর্থবছরেই অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দেশের মধ্যে ৪টি কারখানায় সপ্তাহে তিনটি করে প্রায় ১৬০১টি বন্দে ভারত তৈরি হবে বলে দাবি করেছেন রেলমন্ত্রী। একটি বন্দে ভারত তৈরি করতে খরচ কত?
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনার জন্য কাজ হারাচ্ছেন অনেকে
রেল দফতরেরই হিসাব হল, ১৬ কামরার একটি ‘বন্দে ভারত’ তৈরিতে খরচ হচ্ছে ১১৫ কোটি টাকা। কার্যত বর্তমান অর্থবছরে ১৬০টি বন্দে ভারত তৈরির খরচ ১৮,৪০০ কোটি টাকা। মোদি সরকার যাত্রী নিরাপত্তার জন্য ‘কবচ’-এর পরিবর্তে যে ‘বন্দে ভারত’ চালু করতে একশো শতাংশ বদ্ধপরিকর তা গত অর্থবছর ও বর্তমান অর্থবছরের রেল বাজেট থেকে স্পষ্ট। তালিকায় এটা দেখানো হল। তালিকা থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি স্পষ্ট।
(১) গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) রেলে মূলধনী ব্যয় ছিল ২,৪৫,৩০০ কোটি টাকা। এই ব্যয়ে ১৭টি খাত রয়েছে (যেমন নতুন লাইন নির্মাণ, ডবল লাইন নির্মাণ, রোলিং স্টক ইত্যাদি)। এই খাত থেকে গত অর্থবছরে প্রায় ৫০টি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন তৈরি হয়েছে এবং প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার অর্থাৎ মোট রেলের প্রায় ৫% অংশে ‘কবচ’ নির্মাণ হয়েছে।
আরও পড়ুন-কর্মীদের ফোন কেড়ে নিয়ে গোপন বৈঠক শিলিগুড়িতে
বর্তমান অর্থবছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় বেড়েছে। যেহেতু এ বছরই মোদি সরকার ১৬০টি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন নির্মাণ করবেই বলে ঘোষণা করেছে, সেহেতু ‘বন্দে ভারত’ নির্মাণে এই বছর খরচ হবে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে বাজেটের তথ্যে স্পষ্ট এ বছর যাত্রী নিরাপত্তার জন্য ‘কবচ’ প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না সন্দেহ। তাছাড়া এই বছর কবচ নির্মাণের কোনও লক্ষ্যমাত্রাই নেই।
(২) কংগ্রেস সরকারের শেষ বছরে যাত্রী ভাড়া থেকে যে আয় এসেছিল, বর্তমান অর্থবছরে এই খাত থেকে প্রায় দ্বিগুণ আয় হতে চলেছে; অথচ যাত্রী সুরক্ষা ও যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য কার্যত অবহেলিত। সমস্ত ভরতুকি তুলে দেওয়া সত্ত্বেও যাত্রী সুরক্ষার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি এখনও কার্যকরী করা হয়নি। ট্রেন দুর্ঘটনা কমেনি। গত ১০ বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায় ৩ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটেছে।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুললেও দেশদ্রোহ আইন বহাল রাখার সুপারিশ জাতীয় ল’ কমিশনের, বিতর্ক
তাই দুর্ঘটনাগ্রস্ত লাইনে আধুনিক প্রযুক্তির ‘কবচ’ পদ্ধতি কার্যকরী হলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর লেলিহানশিখা যে অনেকাংশে এড়ানো যেত সেটা রেল কর্তাদের অভিমত থেকেও স্পষ্ট। অথচ যাত্রী সুরক্ষাকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে এবং হাজার হাজার মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আত্মপ্রচারের লক্ষ্যে ‘কবচ’-এর পরিবর্তে ‘বন্দে ভারত’ চলবেই। এটাই মোদির লক্ষ্য। ছিঃ এ ক পরিহাস!