‘গিভ লাইফ , গিভ প্লাজমা, শেয়ার লাইফ, শেয়ার অফেন’ এটাই আজ অর্থাৎ ১৪ জুন ‘ওয়ার্ল্ড ব্লাড ডোনার’ ডে বা ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’-এর থিম। সাহস করে এগিয়ে ব্লাড এবং প্লাজমা দানে শামিল হোন মানুষ— এটাই হল এ বছরের বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের বার্তা। গত বছর এই দিনটার থিম ছিল ‘ডোনেটিং ব্লাড ইজ অ্যান অ্যাক্ট অফ সলিডারিটি, জয়েন দ্য এফর্ট সেভ লাইভস’। এমন প্রতি বছর একটা করে থিম থাকে এই বিশেষ দিনটির জন্য। মানুষে-মানুষে , জাত-পাতে ভেদাভেদ থাকলেও রক্ত ভাল, রক্ত দামি, রক্ত মহামূল্যবান এবং জীবনদায়ী, তা সে যারই হোক।
আরও পড়ুন-মুশকিল আসান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, আরামবাগের তেলুয়ায় শুরু হল রাস্তা তৈরির কাজ
রক্তদানের ইতিহাসের সূচনা
ইংরেজ চিকিৎসক ডাঃ উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে ১৬১৬ তে মানুষ প্রথম জানতে পারে যে মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহিত হয়। এরপর ১৬৫৭ সালে স্যার ক্রিস্টোফার রেন ডাঃ উইলিয়াম হার্ভে আবিষ্কৃত যন্ত্র ব্যবহার করে জন্তুর দেহে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তরল পদার্থ প্রবেশ করান। ১৬৬৬ সালে ডাঃ রিচার্ড লোয়ার সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। এরপর পশুর দেহ থেকে মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন করতে গিয়ে অনেক মানুষ মারা যায় তখন পোপ এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।১৯৭৮ সালে অবস্টেট্রিশিয়ান জেমস ব্লান্ডেল রক্ত সঞ্চালনের জন্যে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত সঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়। তিনিই প্রথম বললেন যে, একজন মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেওয়া যাবে। এইভাবে ধাপে ধাপে এগোতে থাকে রক্তদানের ইতিহাস।
আরও পড়ুন-বন্ধ হচ্ছে মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেস,জানাল রেল
ব্লাড গ্রুপের আবিষ্কার
তবে রক্তদানের ইতিহাস যাঁকে বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ তিনি হলেন ব্লাড গ্রুপের আবিষ্কারক চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ড স্টেইনার। যাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এই ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’টি পালিত হয়। কার্ল হলেন অস্ট্রিয়ান, আমেরিকান ইমিউনোলজিস্ট এবং প্যাথোলজিস্ট যিনি এ, বি, ও, এবি ব্লাড গ্রুপের আবিষ্কার, অগ্রগতি এবং মডার্ন ব্লাড ট্রান্সফিউশনের জন্য পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। তিনি জানতে পেরেছিলেন একই রক্তের গ্রুপের ব্যক্তিদের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন রক্তকোষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় না। এছাড়াও রক্তের জমাট বাঁধার সমস্যা সমাধানকারী চিকিৎসক হাস্টিন, রক্তকে দীর্ঘদিন মজুত রাখার কৌশল আবিষ্কারক চিকিৎসক রাউস এবং চিকিৎসক টার্নার এবং রক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থাপক নর্মান বেথুনের আবিষ্কার ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন-কাঁপল দিল্লি-সহ গোটা উত্তর ভারত, উৎসস্থল কাশ্মীর
নেই সচেতনতা
১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবস পালন শুরু হয়েছিল। ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম বিশ্ব রক্তদান বা রক্তদাতা দিবসটি পালন করে। পরিতাপের বিষয়, প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর থেকে মাত্র ৩৮ শতাংশ রক্ত সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে। বিস্ময়ের যেটা তা হল, এই উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এছাড়াও এখনও রক্তদান নিয়ে পৃথিবীতে সচেতনতা তৈরি হয়নি, এখনও বিশ্বের অনেক দেশেই মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর।
আরও পড়ুন-‘আজ আমি আদ্যাপীঠে এসেছি আমার মাকে স্মরণ করে’ আদ্যাপীঠ দর্শনে মুখ্যমন্ত্রী
প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক
১৯৩৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে কুক কানট্রি হাসপাতালে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্কটি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে বেঙ্গল রেডক্রস সোসাইটির উদ্যোগে কলকাতায় স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এ ভারতের প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্কটি স্থাপিত হয়েছিল। যদিও সেটি প্রধানত গড়া হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের চিকিৎসার প্রয়োজনে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পাশাপাশি দুর্ঘটনা, রোগ বেড়ে চলেছে, ফলে বাড়ছে রক্তের চাহিদা। রক্তই একমাত্র যা চাহিদা অনুযায়ী ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা যায় না। একজন মানুষই অপরজনকে দিতে পারেন। মানুষের রক্তেই মানুষের চিকিৎসা সম্ভব। কাজেই রক্তদান অপরিহার্য। স্বেচ্ছা রক্তদান একটি মহৎ কর্ম যা করলে শুধু গ্রহীতার উপকার হয় না, উপকৃত হন রক্তদাতাও।
আরও পড়ুন-প্রতিহিংসা ও বঞ্চনা প্রতিবাদে আজ পথে মহিলা তৃণমূল
কী উপকারিতা রক্তদানের
বছরে তিনবার রক্তদান করলে শরীরে লোহিত রক্তকণিকা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সেই সঙ্গে নতুন রক্তকণিকা তৈরি অনেকটা হারে বেড়ে যায়। এই বিষয় উল্লেখ্য হল, রক্তদানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
রক্তদানের ফলে দাতার অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। দেহে যদি রক্তাল্পতা থাকে তাহলে সেই ঘাটতি পূরণ হতে শুরু করে। কারণ লোহিত রক্তকণিকা তৈরির হার বাড়ে।
আরও পড়ুন-‘আজ আমি আদ্যাপীঠে এসেছি আমার মাকে স্মরণ করে’ আদ্যাপীঠ দর্শনে মুখ্যমন্ত্রী
সম্প্রতি ইংল্যান্ডের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে নিয়মিত রক্তদান করলে ক্যানসার রোগের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
রক্তদানের পর থেকেই কোলেস্টেরলের মাত্রা লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিক ভাবে রক্তচাপ অনেক নিয়ন্ত্রিত থাকে।
হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি রক্তদানে অনেক কমে যায়।
রক্তদাতার রক্তদান করার আগে বেশ কিছু পরীক্ষা- নিরীক্ষা হয়। ফলে তাঁর হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি এডস বা করোনা রয়েছে কি না তা ধরা পড়ে যায়।
রক্তদানে শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি রাডিক্যালসের পরিমাণ কমে যায়। তাই বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেরিতে আসে।
নিয়মিত রক্তদান করলে প্রচুর ক্যালরি বার্ন হয় ফলে দ্রুত ওজন কমে।
রক্তদান করলে আপনা হতেই শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পায়। শরীরে ভারসাম্য বজায় থাকে।
আরও পড়ুন-বাংলায় ২ কোটি ২৩ লক্ষ শিশুর হাম-রুবেলার সফল টিকাকরণ, স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ মুখ্যমন্ত্রীর
কিছু সাবধানতা
রক্ত দিয়ে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ কিন্তু খুব সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন। সামান্য ভুলচুক হলেই বিপদে পড়তে পারেন দাতা এবং গ্রহীতা দু’জনেই।
দাতা এবং গ্রহীতার ব্লাড গ্রুপের অবশ্যই মিল থাকতে হবে।
কোনও রোগীকে রক্ত দেওয়ার আগে দাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ মেলার পরেও গ্রহীতার শরীরের রক্ত যে ধরনের কম্পোজিট চায় তার সঙ্গে দাতার রক্তের কম্পোজিটের মিল হওয়াও অত্যন্ত জরুরি৷
কোনও ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্তের নম্বর খেয়াল রাখতে হবে৷
ব্লাড ব্যাঙ্কের ওই রক্তের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ অবশ্যই খেয়াল করা জরুরি৷ কারণ একটি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সেই রক্ত নিলে রোগীর শরীরে নেগেটিভ প্রভাব পড়বে৷
রক্তের উপাদানের রূপ অর্থাৎ কম্পোনেন্ট ফর্মও ভাল করে দেখে নিয়ে তবে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত আনতে হবে৷
এক জায়গা থেকে অন্যত্র রক্ত নিয়ে যাওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়৷