বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস বা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট— মুখে যে যা দাবি করুক না কেন, বাস্তব তথ্যের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময় ৭০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। ২০০৮ সালে মারা যান ৩৬ জন। আর মা-মাটি-মানুষের সরকারের সময়? উত্তর খুঁজলেই সত্যিটা বেআব্রু।
আরও পড়ুন-আজও পুরীগামী বহু ট্রেন বাতিল
খুব শুনছি, কেন্দ্রীয় বাহিনী, কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু মণিপুরে ওরা কী করেছে, সবাই দেখেছে। ১৫০ জন মানুষ সেখানে মারা গিয়েছেন। ২০১৩ সালে সেন্ট্রাল ফোর্স দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল। সেই সময়ও ৩৯ জন মারা গিয়েছিলেন। গত বিধানসভার ভোট হয়েছিল আট দফায়, হাজার কোম্পানিরও বেশি আধাসেনা মোতায়েন করে। অলিতে-গলিতে আধাসেনা মোতায়েন ছিল নির্বাচন নির্বিঘ্নে সারতে। তবু কি ভোটের ফলে খুব একটা হেরফের ঘটাতে পেরেছে দিল্লির নির্বাচন কমিশন? অতএব, কেন্দ্রীয় বাহিনীর পক্ষে কথা না বলাই শ্রেয়।
যদি পঞ্চায়েত ভোটে গন্ডগোলের খতিয়ান দেখি, তাহলে ২০০৩ সালের অশান্তি, রক্তক্ষয় এবং প্রাণহানির রেকর্ড এখনও কেউ ভাঙতে পারেনি। নিজেদের সেই পুরনো ট্র্যাক রেকর্ডের দিকেও যেন নজর থাকে অধুনা ভাজামাছ উল্টে খেতে না-পারা আগমার্কা বামপন্থীদের।
আরও পড়ুন-উধাও ৮৮ হাজার কোটির ৫০০ টাকার নোট
সত্যি কথাটা বলে ফেলাই ভাল। নির্বাচন লড়তে হয় দলগত শক্তিতে। নেতা-নেত্রীর ভাবমূর্তিকে পুঁজি করে। বহিরাগত নেতা, দল ভাঙানো উচ্ছিষ্ট, কেন্দ্রীয় এজেন্সি এবং আধাসেনার ঘাড়ে বন্দুক রেখে নয়। আব্রাহাম লিঙ্কন লিখেছিলেন, বুলেটের চেয়ে ব্যালটের শক্তি বেশি। ইতিহাস বারবার শিখিয়েছে, গণতন্ত্রে মানুষই শেষ কথা বলে। পোষা দেহরক্ষী, বশংবদ এজেন্সি, অনুগত প্রচারক, তোষামুদে ভৃত্য কিংবা শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠানো প্রকাণ্ড চেহারার লেঠেল, কেউ নন। পঞ্চায়েত স্তরে প্রার্থী দিতে গেলে লাগে সংগঠন। ‘হাওয়া’র জোরে এ-রাজ্যে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হলেও তাদের সংগঠন বলে কিছু নেই। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে। অন্যদিকে, বিধানসভায় সিপিএম একটি আসন না জিতলেও বহু জায়গায় তাদের সংগঠন আছে। সেই কারণেই কয়েকটি জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপির থেকেও বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে শাসক দলের সন্ত্রাসকে ‘ঢাল’ করছে বিজেপি। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, সাংগঠনিক দুর্বলতা।
আরও পড়ুন-নির্দলদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন, আগামী সপ্তাহে প্রচার শুরু
গত একবছর যাবৎ পশ্চিমবঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই এজেন্সিরাজ চলছে। ইডি, সিবিআই বেছে বেছে রোজ রাজ্যের শাসক নেতাদের ঘরে হানা দিচ্ছে আর বিরোধীরা (পড়ুন রাম-বাম নেতারা) উল্লাস করেছেন, প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। ওই প্রতিক্রিয়াতেই আটকে থেকেছে তাঁদের রাজনীতির গতিবিধি।
আর একটা কাজও করেছেন তাঁরা বুক ফুলিয়ে। রাজ্যের গরিব মানুষকে ভাতে মারতে ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে দিতে বলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। গ্রামবাংলা তাই ফুঁসছে। রাজ্যের প্রাপ্য আদায় করে আনার বদলে গরিবের রোজগারে হাত দেওয়া নেতাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে গ্রামের মানুষের সামনে। উত্তর দিতে হবে, রাজনীতির লড়াই করতে নেমে কেন গরিবের এতবড় সর্বনাশ তারা করল।
একুশের বিধানসভা ভোটের পর সেই যে বিজেপির দলীয় কর্মী-নেতারা ঘরে ঢুকেছেন, তাঁদের এখনও বের করা যায়নি। অমিত শাহদের গুঁতো খেয়ে দলবদলু থেকে আগমার্কা সংঘী কিছু নেতা ছুটলেও লোক পাওয়া যাচ্ছে না। লোডশেডিং অধিকারী থেকে শুরু করে একুশের বিধানসভা ভোটের পর দলীয় সভাপতির পদ-খোয়ানো নেতারা যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন, এখনও অর্ধেক পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল স্তরে নির্বাচন লড়ার প্রস্তুতি বঙ্গবিজেপির নেই।
আরও পড়ুন-মুখোশ খুলে গেল আব্বাস-নওশাদদের
আর অধীর-মার্কা বঙ্গকংগ্রেস বামেদের সঙ্গে জোট করে ‘সাগরদিঘি মডেল’ তৈরি করেছিল। কিন্তু অধীররঞ্জনের স্নেহের প্রার্থী যাবতীয় উচ্ছ্বাস ও সাফল্য নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আজ তৃণমূল কংগ্রেসের উন্নয়নমুখী রাজনীতির প্রশ্রয়ে। দিঘি নয়, মজা পানাপুকুরে গুমরে মরেছে সেলিম-অধীরদের জোট মডেল।
অন্য দিকে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু গত দেড় মাসে রাজ্যের প্রায় সব জেলা চষে বেড়িয়েছেন। তাঁর নবজোয়ার যাত্রা সব অর্থেই আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের ময়দান প্রস্তুত করে দিয়েছে। স্থানীয় স্তরে ব্যালটে প্রার্থী নির্বাচনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। যার ক্লাইম্যাক্স আমরা দেখব আগামী ৮ জুলাই, একদফার ভোটে এবং সর্বোপরি ১১ জুলাইয়ের ম্যারাথন নির্বাচনী ফলাফলে। ওই নির্বাচনই হবে চব্বিশের চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে সেমি ফাইনাল।
আরও পড়ুন-যতবার কেন্দ্রীয় বাহিনী-ততবার জয়
২০২১-এ মুখে-মুখে মা-মাটি-মানুষের সরকারের গদি উল্টে দেওয়ার ‘মহাকাব্য’ রচিত হয়েছিল বটে, কিন্তু মানুষের ভোটে সেই খোয়াব দুঃস্বপ্ন হয়েই থেমে গিয়েছে। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের আগেও আর একবার সেই ‘ব্যালট শক্তির’ই মাহাত্ম্য টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ গত দু’বছর এ-রাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রে মানুষ নয়, বিরোধীরাও নয়, ছিল শুধু কেন্দ্রীয় এজেন্সির দৌরাত্ম্য আর দাপাদাপি। বিরোধীরা ঠান্ডা ঘরে বসে এজেন্সির হাতে শাসকের হেনস্থা হওয়া দেখে উল্লসিত হত।
আরও পড়ুন-আরও অনেক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবে, জকোভিচের প্রশংসায় ফেডেরার
প্রশ্ন করত, আজ কোথায় হানা দিচ্ছে রে! গোটা তৃণমূল দলটাকেই জেলে ভরে ক্ষমতা দখলের ঝুটা স্বপ্ন দেখত। যদি পশ্চিমবঙ্গে এবার পঞ্চায়েত ভোটটা ইডি আর সিবিআই মিলে লড়ে দিত তাহলে নিশ্চয় তাদের ক্ষমতা কিঞ্চিৎ বাড়লেও বাড়তে পারত। কিন্তু দূর কল্পনাতেও তা হওয়ার নয়। মানুষ জানেন, তৃণমূল কংগ্রেসকে না জেতালে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী— এসব দেওয়ার কেউ নেই তাঁদের। পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রত্যেক ভোটার এই কথাটি স্মরণে রেখেই ভোট দেবেন। তাঁরা জানেন, পঞ্চায়েতের মূল লড়াইটা বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের। আর সেটা দ্বিতীয় হওয়ার।