আর রইলেন না মহীনের সেই ঘোড়াগুলি। কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে আর তাঁরা ঘাসের লোভে চরবেন না। আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসবে না ভিড় রাত্রির হাওয়ায়। চলে গেলেন প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র শেষ ঘোড়া তাপস বাপি দাস, সবার প্রিয় বাপিদা। আর সেই সঙ্গে শেষ হল একটা সংগীত যুগের।
আরও পড়ুন-বিশ্বের ক্ষমতাশালী নারীরা
বাংলা গানকে আমূল বদলে দিয়েছিল রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’৷ নকশাল আন্দোলনের কর্মী গৌতম চট্টোপাধ্যায়দের এই গানের দল একটা সময় হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা৷ সেই দলেরই অন্যতম সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাপিদা৷ তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় একটা সময় এই বাংলা ব্যান্ড সাফল্যের ইতিহাস লেখে। মহীনের আদি ঘোড়া বাপি ছিলেন গীতিকার, গায়ক, বাদক। দারুণ গিটার বাজাতেন। সত্তরের দশকে এক নতুন ধারার সংগীতের সূচনা করেছিলেন তিনি এবং তাঁর ব্যান্ড। কলকাতার সংগীতমহলে বাপিদাকে চেনেন না এমন কেউ নেই। আবার এমন সংগীতপ্রেমী নেই যিনি ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গানে মুগ্ধ হননি।
আরও পড়ুন-বাঙালি খাদ্যে মজলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
১৯৭৬ সালে বাংলার সংগীত জগতের নবজাগরণ ঘটিয়েছিল প্রথম স্বাধীন রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। তারপর লেখা হয় একের পর এক কালজয়ী গান। ‘তোমায় দিলাম’, ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’, ‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি’, ‘ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি’ ইত্যাদি যে গানগুলি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তখন নকশাল আন্দোলনের জেরে জেল খেটে বেরলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। এরপরেই সাতজন সদস্য নিয়ে গড়ে তুললেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, আব্রাহাম মজুমদার, তাপস দাস ও তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়— এই সাত শিল্পী হলেন মহীনের সেই সাতটি ঘোড়া। যাঁরা রামধনুর মতো সাতরঙে মিলিয়ে দিয়েছিলেন আধুনিক বাঙালির জীবনের সংগীত চেতনাকে।
আরও পড়ুন-অশান্ত মণিপুরে ইস্তফার সাজানো নাটক মুখ্যমন্ত্রীর
আমেরিকান, লাতিন, রক, জ্যাজ, বাউল আর শাস্ত্রীয় সংগীত— সব রকম গানের ধারাই মিলেমিশে যেত এই ব্যান্ডের গায়কিতে, সুরে, ছন্দে। যে-কারণে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে অনেকেই ‘লোক-রক ব্যান্ড’ বলতেন। তাঁদের গানের বিষয়বস্তু হিসেবে বারবার উঠে এসেছে রাজনীতি, বৈষম্য, দারিদ্র, অর্থনীতি, অন্যায়-অবিচার, বিপ্লব, প্রেম, একাকীত্ব এবং স্বাধীনতা। বাংলা গানের রূপরেখা বদলাতে ঝড় তুলেছিলেন বাপিদা এবং তাঁর ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।
আরও পড়ুন-সাংসদকে ভর্ৎসনা কোর্টের
ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা ও লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল বাপিদার। কিন্তু গানে বাঁধাধরা কোনও তালিম নেননি কখনও। কিশোর বয়স থেকেই বেহালায় পাড়ার অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান করতেন। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তাঁরা সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গান শুনতেন। দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন কলকাতার পথে পথে নতুন গানের সন্ধানে। রক, লাতিন মিউজিক থেকে শুরু করে বেদে, বাউল সব ধরনের গান শুনতেন। পাশ্চাত্যের সঙ্গে বাংলার নিজস্ব ঘরানা রেখেই নতুন নতুন গান বাঁধতেন।
আরও পড়ুন-যারা মানুষকে ভাতে মেরেছে তাদের একটা ভোটও নয়
সালটা ১৯৭৫। কলকাতায় শাস্ত্রীয় সংগীতের কনসার্ট চলছে, ভোর পাঁচটায় বাজনা শেষ করলেন বিসমিল্লা খান। অনুষ্ঠান শেষে, কুয়াশার চাদরে মোড়া গড়ের মাঠ দিয়ে হাঁটছেন বাপি-গৌতম-রঞ্জনরা। সে-সময়েই বাপি লিখলেন— ‘ভেসে আসে কলকাতা/ কুয়াশা তুলিতে আঁকা/শহরতলির ভোর মনে পড়ে’— সুর দিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। এমন কত অচেনা মুহূর্তে চেনা সুরে তৈরি হয়েছে কতশত গান। প্রথমেই জনপ্রিয়তা পায়নি এই ব্যান্ড। ‘সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক’, ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব’ এবং ‘দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি’ প্রথম দিকের এই তিনটি অ্যালবাম খুব সাড়া ফেলেনি। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ স্বীকৃতি ও সম্মান পেল নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯৫ সালে সমসাময়িক বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ শিরোনামে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র একটি কভার সংকলন প্রকাশ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনা, রাজ্যকে অবহেলা, তার মধ্যেও সাফল্য, আবাসে দেশে দ্বিতীয় বাংলা
আশির দশকে শুরুর দিকে ব্যান্ডটি আবার ভেঙে যায়। তখন যে যাঁর মতো কর্মজীবন বেছে নেন তাঁরা। এরপর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আবার তাঁরা ফিরে আসেন তাঁদের সম্পাদিত অ্যালবাম নিয়ে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
দীর্ঘ ৪৭ বছরের যাত্রাপথে একে-একে বিদায় নিয়েছেন এক-একটি ঘোড়া। সাথীহারা হয়েছে মহীনের বাকি ঘোড়ারা। তাপস বাপি দাস ছিলেন শেষ আদি ঘোড়া। থেমে থাকেননি কখনও। ২০০৩ সালে তিনি নতুনদের নিয়ে আবার একটি দল গড়লেন যাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘মহীন এখনও বন্ধুরা’। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছিলেন এই ব্যান্ডেরই প্রধান। চেয়েছিলেন অনেক কিছু করতে। কিন্তু জীবন তো এমনই অনিশ্চিত। মারণ-ক্যান্সার বাসা বাঁধে তাঁর শরীরে। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
আরও পড়ুন-নিছক সমাপতন নাকি অন্য গল্প? ২০২৪-এর নির্বাচন ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি
অনেক শারীরিক জটিলতা, কষ্ট, প্রতিকূলতা নিয়ে স্টেজ পারফরমেন্সও করেছেন। রাইলস টিউব লাগানো অবস্থায় পরিবেশন করেছেন সংগীত। কিন্তু শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানতেই হয় তাঁকে। থেমে গেল বাঙ্ময় এক জীবন, এক যুগ। শেষদিকে চিকিৎসার মাত্রাতিরিক্ত খরচ জোগাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল তাঁর পরিবার। তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন একাধিক ব্যান্ডের সদস্যরা। এরপরেই তাপস দাসের দায়িত্ব নিয়ে নেন স্বয়ং রাজ্য সরকার। তাঁর চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করে সরকার। এসএসকেএম-এ তাঁর চিকিৎসাও চলছিল। ক্যান্সারের থার্ড স্টেজেও গানকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। থেমে গেল মহীনের শেষ ঘোড়াটিও। নিথর দেহের আনাচ-কানাচে হয়তো তখনও অনুরণিত হচ্ছিল—
‘চেনা ছোট খোপ, চেনা ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে,
পেরিয়ে দূরে, বহুদূরে যেতে চাই,
জানি না তাই, শেষ কোথায়…’